Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ আরবি শব্দ ভান্ডার হয়ে যেভাবে উপকূলে আঘাত হানতে যাচ্ছে

Shimul  Zabaly

শিমুল জাবালি

বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য,
অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা।’

কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা কবিতাটি অপ্রাসঙ্গিক হয়েও যেন প্রাসঙ্গিক এখানে। কবি বেড়ে উঠেছেন এমন এক অঞ্চলে যেখানে বছরের পর বছর ঘূর্ণিঝড় এসে ভেঙে দিয়েছে মানুষের স্বপ্ন, কেড়ে নিয়েছে জীবন। তবে যতবারই আঘাত আসুক, মানুষ ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে স্বমহিমায়। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ‘মোখা’ আঘাতের পর এবার আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’। তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে আজ বৃহস্পতি ও আগামীকাল শুক্রবার ভারতে ওড়িশার পুরী ও পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপের মাঝ দিয়ে উপকূলে উঠে আসতে পারে। এতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব বাংলাদেশের সুন্দরবন ও আশপাশের এলাকায় পড়তে পারে।

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’:

‘দানা’ নাম এসেছে আরবীয় অঞ্চল থেকে। এর আগে আরবীয় শব্দের মধ্যে সৌদি ও কাতারের দেয়া নামের কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের উপকূলে আঘাত হানা শক্তিশালী ‘মোখা’ সৌদি আরবের দেয়া নাম। যার অর্থ ‘সুগন্ধী’ বা ‘মিষ্টি’। সৌদির অন্য নাম হলো- ‘সুবাহ’, ‘দ্রার’, ও ‘শুরুক’। কুয়েতের নামগুলোর মধ্যে ‘নওর’ আর ‘যারা’ উল্লেখযোগ্য। আরব আমিরাতের নামের মধ্যে ‘জাজিরা’ ও ‘শামাল’ উল্লেখযোগ্য। আর বাংলাদেশ-ভারতে আঘাত হানা প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ ছিল ওমানের দেয়া নাম। যার অর্থ ‘স্যান্ডি’ বা ‘বালু’।

অন্যদিকে এবারই প্রথম কাতারের দেয়া নাম ‘ডানা’ ঘূর্ণিঝড় আলোচনায় এসেছে। ‘ডানা’ একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ ‘দান’ অর্থে ‘দয়া দেখানো’ এমনকি ‘বড় মুক্তার দানা’ও বুঝায়। এ শব্দটি মানবিক প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয় এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবেও হয়। আরবি অনেক নামের সঙ্গেই এ ‘দানা’ শব্দটি দেখা যায়। এ ছাড়া শব্দটির নানা ধরনের প্রায়োগিক ব্যবহার রয়েছে। আরবিতে সৃজনশীলতা, অনুপ্রেরণা, মানবিক আবেগ ও ভাবনাকেও প্রকাশ করে ‘দানা’ শব্দটি দিয়ে। আবার আরব সাংস্কৃতিক গানে ‘দানা’ শব্দটির ব্যবহার উল্লাসের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। আর ফ্যান্টাসি গল্পে ‘দানা’ শব্দটি কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা যুক্ত থাকে। কাতার এ নাম প্রস্তাব করে ২০২৩ সালে।

ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ:

আগে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম ছিল না, সময় বা সাল উল্লেখ করে ঘূর্ণিঝড়কে চিহ্নিত করা হতো। ২০০২ সালে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর আবহাওয়া সংস্থা ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের ব্যাপারে সম্মত হয়। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ, ভারত, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার একটি কমিশনের মাধ্যমে নামের প্রস্তাব শুরু করে, যা বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার অনুমতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়। পরে ২০০৫ সালে শ্রীলঙ্কা, ২০০৬ সালে মিয়ানমার এবং ২০০৭ সালে থাইল্যান্ড যুক্ত হয়। ২০১৮ সালের মধ্যে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমান যুক্ত হয়। প্রতি চার বছর পর পর সদস্য দেশগুলো বৈঠক করে আগে থেকেই পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের নামগুলো সাধারণত নিজ নিজ দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও প্রতীককে তুলে ধরে। প্রক্রিয়াটি মূলত আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থার (WMO) দ্বারা পরিচালিত হয়।

বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের দেয়া নাম:

বাংলাদেশের প্রস্তাবিত নামগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘বিপদ’ ও ‘বুলবুল। ভারতের দেয়া উল্লেখ করার মতো নাম হলো ‘আম্ফান’, ‘বায়ু’, ‘ফণী’। আর পাকিস্তানের নাম ‘আসনা’, ‘জোহ’, ‘তেহরক’ উল্লেখযোগ্য।

বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়:

গত একশ বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা শতাধিক। কোনো কোনটি মারাত্মক আকার ধারণ করে উপকূলবাসীর সবটুকু কেড়ে নিয়েছিল। এর আগে মধ্যযুগে, বিশেষ করে মোগলদের শাসনামলে ১৭০০ সালের এক ঘূর্ণিঝড় বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছিল। এমনকি প্রাচীন বাংলায় ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য সাধারণত পুঁথি, ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও পৌরাণিক কাহিনিতেও পাওয়া যায়।

বিশ্বের ইতিহাসে যত ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হেনেছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে এই বঙ্গোপসাগরে। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ৩৫টি মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ২৬টিই বঙ্গোপসাগরে! এর মধ্যে ১৯টি বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করেছে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের ভোলায় যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল, সেটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়। এতে মারা গিয়েছিল প্রায় ৫ লাখ মানুষ। চট্টগ্রাম উপকূলে ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে ১ লাখেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। এ ছাড়া ২০০৭ সালের ‘সিডর’ প্রায় ৩ হাজার ৪০০ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। এর আগে ১৯৩১ সালের ঘূর্ণিঝড়টি বরিশাল অঞ্চলের ২৫ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটায়। এর পাশাপাশি অসংখ্য শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আছড়ে পড়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ ও প্রাণহানি ঘটায়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ