নতুন মুদ্রানীতি সময়ের চাহিদা পূরণে কতটা সক্ষম?
দেশের অর্থনীতিতে নানা টানাপোড়নের মধ্যে গত ১৭ জানুয়ারি নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এটি হচ্ছে চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২০২৪) অর্থবছরের দ্বিতীয় এবং নতুন সরকারের প্রথম মুদ্রানীতি। টানা চতুর্থবারের জন্য নির্বাচিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের নবঘোষিত মুদ্রানীতি নানা কারণেই ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ কিছু জটিল সমস্যা মোকাবিলা করে চলেছে, যা তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্ট নয়। সমস্যাগুলো আগে থেকেই অর্থনীতিতে বিরাজমান। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ডামাডোলে সরকার এতদিন হয়তো সমস্যাগুলোর প্রতি সঠিক দৃষ্টি দিতে পারেননি।
বিশেষ করে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অর্থনীতিতে বিরাজমান অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা, বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার সময়োপযোগী করা, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্ফীতি বাড়ানো, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যাংক ঋণ প্রবাহ বাড়ানো, খেলাপি ঋণ সংস্কৃতির টুঁটি চেপে ধরা ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে সরকার বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন। এমনই এক অবস্থা বা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত নতুন মুদ্রানীতির প্রতি অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি এবং আগ্রহ থাকবে–এটাই স্বাভাবিক।
নতুন মুদ্রানীতিতে দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান এসব সমস্যাকে ভালোভাবে এড্রেস করা হবে–এটাই অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা প্রত্যাশা করেছিলেন; কিন্তু ঘোষিত মুদ্রানীতি গতানুগতিক এবং সংকোচনমূলক। এ মুহূর্তে আমাদের দেশের আরও কার্যকর ও বাস্তবস্মত মুদ্রানীতি ঘোষণা করা প্রত্যাশিত ছিল। ঘোষিত মুদ্রানীতি সময়ের চাহিদা পূরণে কতটা সহায়ক হবে, তা বিশ্লেষণ করলেই অনুধাবন করা যাবে।
প্রত্যেকটি মুদ্রানীতির কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। এসব বৈশিষ্ট্যদৃষ্টে বুঝা যায় ঘোষিত মুদ্রানীতি সময়ের চাহিদা পূরণে কতটা সক্ষম হবে। নতুন মুদ্রানীতিতে দেশের অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এটা খুবই ভালো কথা; কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। যদি পাশাপাশি মুদ্রানীতি বহির্ভূত ইস্যুগুলোকে সঠিকভাবে হ্যান্ডেল করা না হয়। আমাদের দেশের অর্থনীতি সাধারণ কোনো নীতি বা আদর্শ মেনে চলে না। যেমন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কথাই ধরা যাক। আমরা কথায় কথায় ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের কথা বলে থাকি। নীতি নির্ধারক পর্যায় থেকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দেয়া হয়। বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবার কারণে স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী যে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়, তার পেছনে প্রোডাকশন লস যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে সাপ্লাই চেইন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে। এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। সেই অবস্থায় পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পায়ে বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে; কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৭৫ থেকে ৮০ মার্কিন ডলারে নেমে আসে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য মূল্যের ওপর তার কোনো প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়নি। বাংলাদেশ তার মোট জিডিপির ২৫ শতাংশ পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবেই উৎপাদিত হয়। তাহলে সব পণ্যের মূল্য এতটা বৃদ্ধি পেলো কেন?
স্থানীয় বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি খুব একটা প্রভাব বিস্তার করার কথা নয়; কিন্তু অর্থনীতির কোনো সূত্রই আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা মেনে চলছে না। বাজারে তৎপর শক্তিশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট (যারা সব সময়ই সরকারি দলের ছত্রছায়ায় থাকে) মহল বিশেষের সঙ্গে যোগসাজশ করে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে ফায়দা লুটে নিচ্ছে কিন্তু সরকার বা কোনো কর্তৃপক্ষই এদের দমন করার ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে না। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজধানীর বাজারে গরুর গোশতের মূল্য ৮০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকায় নেমে আসে। গরুর গোশত ৬০০ টাকা মূল্যে বিক্রি করলেও নিশ্চয়ই ব্যবসায়ীদের লোকসান হয়নি। নির্বাচন চলে যাবার পর সেই গরুর গোশত আবারও ৭০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। নিশ্চিত করে বলা যায়, অচিরেই প্রতি কেজি গরুর গোশত আবারও ৮০০ টাকায় উন্নীত হবে। এভাবে গরুর গোশতের মূল্য যৌক্তিক কারণ ছাড়াই কেন হ্রাস পেলো আবার কেনই বা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা কি আমরা কখনো খতিয়ে দেখেছি। গরুর গোশতের মূল্য ওঠানামা করার ঘটনাই হচ্ছে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মূল কারণ। কোনো সরকারই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, তা সফল হতে পারে না। মুদ্রানীতিতে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দৃশ্যত যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য অকার্যকর, তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি রেট হার (সিডিউল ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য ঋণ নেবার ক্ষেত্রে যে সুদ প্রদান করে) দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। বছর দেড়েক আগে পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ। বিশ্বের অন্তত ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি তাদের পলিসি রেট বারবার বৃদ্ধি করে তাদের অর্থনীতিতে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে এক পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি বিগত ৪০ বছরের রেকর্ড ভেঙে ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) বড় দুই বছরের মধ্যে পলিসি রেট অন্তত ১৩ বার বৃদ্ধি করেছে। এতে দেশটির অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেবার আশঙ্কা সৃষ্টি হলেও তারা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানও পলিসি রেট বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসমে পেরেছে। শ্রীলঙ্কার মতো বিপর্যস্ত অর্থনীতিও তাদের উচ্চ মূল্যস্ফীতি ৩৫ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে; কিন্তু আমরা কেনো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না? বাংলাদেশ ব্যাংকতো অনেকবারই পলিসি রেট পরিবর্তন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট পরিবর্তন করেছে ঠিকই কিন্তু তারা ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর কোনো সুযোগ দেয়নি। কিছুদিন আগ পর্যন্তও ব্যাংক ঋণের (সিডিউল ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তা বা সাধারণ ঋণ গ্রহীতাদের ঋণদানের জন্য যে সুদ আরোপ করে) সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে রেখেছিল। এতে সিডিউল ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদের ধার বা ঋণ নিলেও সেই ঋণের অর্থ উদ্যোক্তাদের নিকট ঋণদানের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় বেশি সুদ আরোপ করতে পারেনি। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ অনেকটাই সস্তা হয়ে যায়। অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা নির্দিষ্ট খাতের পরিবর্তে অন্য খাতে ব্যবহার করেছেন। এমনকি বিদেশে পাচার করেছেন বলেও অনেকে অভিযোগ করে থাকেন।
অর্থনীতির সূত্র মোতাবেক মনে করা হয়, পলিসি রেট বৃদ্ধি করা হলে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণকালে আগের তুলনায় বেশি সুদ প্রদান করতে হবে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা হ্রাস পাবে। বাজারে অর্থ প্রবাহ কমে যাবে। এতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু পলিসি রেট বাড়ানোর পরও ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়াতে দেয়নি ফলে উদ্যোক্তা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। গৃহীত ঋণের একটি বড় অংশই নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজারে চলে আসে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পায়। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার তুলে দিয়ে বন্ডের সুদ হারের ৬ মাসের গড় সুদের সঙ্গে অতিরিক্ত তিন শতাংশ সুদ যোগ করে ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারণের সুযোগ দিয়েছে। এই সিস্টেমে বর্তমানে ব্যাংক ঋণের সুদের হার প্রায় ১২ শতাংশ। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা অনেক দিন ধরেই ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দিয়ে আসছেন; কিন্তু তাদের সেই পরামর্শের বিষয়ে কোনো পাত্তা দেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে ব্যাংক ঋণের সুদের হার যদি বাজারভিত্তিক করা হতো, তাহলে সুদের হার ১৫/১৬ শতাংশে উন্নীত হতো।
নতুন মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করা হচ্ছে ১০ শতাংশ। আগে এটা ছিল ১১ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবাহ কমে গেলে বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। এতে উৎপাদন কমে যাবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি কমানোর চেয়ে গৃহীত ঋণের অর্থ যাতে সঠিকভাবে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয়িত হয় তা নিশ্চিত করাই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও কমানো হয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। আগের মুদ্রানীতিতে এটা ছিল ৩১ শতাংশ।
মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক তা অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশেরই পছন্দ নয়। তারা বলছেন, কিছুটা ধীরে হলেও মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকাকে অতিমূল্যায়িত করে রাখার কারণে হুন্ডি বাজারের রমরমা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বাজারে মার্কিন ডলারের একাধিক মূল্য চালু রয়েছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি মার্কিন ডলার ১১০-১১১ টাকা মূল্যে বিক্রি হলেও কার্ব মার্কেটে প্রতি মার্কিন ডলার ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজার সঠিকভাবে পরিচালনা করতে না পারার কারণে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা। কথায় বলে,ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে বেশি দিন নৈতিকতা আশা করা যায় না।’ ঠিক একই কথা প্রযোজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে। তারা যদি হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করে প্রতি মার্কিন ডলারে ১২-১৪ টাকা বেশি পায়, তাহলে কেন তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ করবে? অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বাজারই নির্ধারণ করবে মার্কিন ডলারের মূল্য কত হবে। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের তৎপরতা এমনিতেই কমে যাবে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে জনশক্তি খাত থেকে। গত এক বছরে মোট ১৩ লাখ বাংলাদেশি কর্মসংস্থান উপলক্ষে বিদেশে গিয়েছে। তাহলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ এত কম কেনো? এর কারণ হচ্ছে যেহেতু হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ করলে স্থানীয় মুদ্রায় বেশি অর্থ পাওয়া যায় তাই তারা ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমেই রেমিট্যান্স প্রেরণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে বিকল্প উপায়ে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা মার্কিন ডলারের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেবে। ব্যাংকগুলোকে সেই বেঁধে দেয়া দামের মধ্যেই ডলার বিক্রি করতে হবে। এই পদ্ধতি পরিস্থিতির কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করতে পারবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা না হলে রিজার্ভ থাকত না। আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ রক্ষা করা যাবে না। রিজার্ভ রক্ষা করার জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া। আর ঢালাওভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফল কখনোই ভালো হতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে যে পরিমাণ লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা হয়েছিল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এলসি কম খোলা হয়েছে ১৪ দশমিক ০৬ শতাংশ। এর মধ্যে ভোগ্য পণ্য আমদানির জন্য এলসি কম খোলা হয়েছে ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি কম খোলা হয়েছে ১৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। জ্বালানি খাতে এলসি কম খোলা হয়েছে ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। কাঁচামাল খাতে এলসি কম খোলা হয়েছে ১১ দশমিক ৬২শতাংশ এবং মধ্যবর্তী পণ্য খাতে এলসি কম খোলা হয়েছে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। ভোগ্য পণ্য এবং বিলাসজাত পণ্য আমদানি কমে গেলে কোনো ক্ষতি নেই। এতে বরং দেশ উপকৃত হবে; কিন্তু শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, মধ্যবর্তী পণ্য এবং জ্বালানি আমদানি কমে গেলে দেশের উৎপাদনশীল খাতের ওপর তার অনিবার্য প্রভাব পড়বে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়াটা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।
অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, ঘোষিত মুদ্রানীতি দিয়ে উদ্দীষ্ট সাধিত হবে না। অনেকেই আরও বলছেন, এতে মূল্যস্ফীতি কমবে না বরং আরও বেড়ে যেতে পারে, যদি বাজারে তৎপর সিন্ডিকেটের কার্যক্রম বন্ধ না করা যায়।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে