প্রতিদিন ব্যবহার করা ডিভাইসগুলো যেভাবে বোমায় পরিণত হচ্ছে
লেবাননের সশস্ত্র যোদ্ধা গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অনলাইন মেসেজিং টুলস টিএলডিআর। এর সঙ্গে থাকে পেজার আর রেডিও। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ওই আক্রমণের বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল এই টিএলডিআর প্রযুক্তিকে। এই প্রযুক্তিতে একটি ‘চিট মেসেজ (প্রতারণামূলক বার্তা) পাঠিয়েই বিস্ফোরণ ঘটানো হয় অসংখ্য পেজার ডিভাইসের। সন্দেহ করা হচ্ছে এর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কারণ ইসরায়েলে হিজবুল্লাহর আক্রমণের ঝুঁকি তীব্র হতেই এই অস্বাভাবিক পেজার হামলার শিকার হলো হিজবুল্লাহ। ফলে প্রতিদিনের ব্যবহার করা ডিভাইস যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা নিয়ে বড় উদ্বেগের সৃষ্টি হলো।
সেদিন যা ঘটেছিল:
গত ১৭ সেপ্টেম্বর লেবাননজুড়ে এই ভয়ংকর ঘটনা ঘটে, যখন হিজবুল্লাহর যোগাযোগ ডিভাইস ‘পেজার’ ও ‘রেডিও’ সমানে বিস্ফোরিত হতে থাকে। এতে নিহত হয় ৩৭ জন। আহত হয় কয়েক হাজার মানুষ। আর এই ডিভাইসগুলো বিস্ফোরিত হয় হিজবুল্লাহর নেতৃত্বের কাছ থেকে একটি বার্তা পাওয়ার পর। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পেজারটি বেজে ওঠার পর পরই এগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে।
বিশেষ করে বৈরুত, বেকা উপত্যকা এবং দামেস্কসহ প্রধান হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটিতে ডিভাইসগুলো বিস্ফোরিত হয়। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ মনে করে, ডিভাইসগুলো হিজবুল্লাহর কাছে পৌঁছানোর আগেই উৎপাদনের পর্যায়েই এগুলোর মধ্যে গোপনে বিস্ফোরক ভরা হয়েছিল।
পেজার কী?
পেজার হলো একটি ছোট ডিভাইস যা টেক্সট মেসেজ আদান-প্রদানে ব্যবহৃত হয়। খুদে বার্তা এলেই পেজারটি কেঁপে ওঠে বা শব্দ করে জানান দেয়। যেখানে ফোনের যোগাযোগ সুগম নয়, সেসব অঞ্চলে যোগাযোগের জন্য হিজবুল্লাহ পেজার ব্যবহার করত। এই ক্ষেত্রে পেজার কোম্পানির সঙ্গে কোনোভাবে গোপন যোগসাজশের মাধ্যমে পেজার ডিভাইসে ব্যবহার করা ব্যাটারির ভেতরে বিস্ফোরক যুক্ত করা হয়েছিল। ফলে ছোট্ট ডিভাইসগুলো পরিণত হয়েছিল প্রাণঘাতী বোমায়।
ওয়াকিটকি কী?
দুজন দুপ্রান্ত থেকে মোবাইলের মতো কথা বলতে ওয়াকিটকি ব্যবহৃত হয়, তবে এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় রেডিও তরঙ্গ। এগুলো সাধারণত সামরিক এবং জরুরি অপারেশনগুলোতে ব্যবহৃত হয়। কারণ তারা মোবাইল নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করে না। হিজবুল্লাহর ওই ঘটনায় পেজার এবং ওয়াকিটকি দুটোই বিস্ফোরণের আওতায় ছিল। তবে ওয়াকিটকির ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আরও ভয়ংকর, কারণ ওয়াকিটকির ব্যাটারির আকার বড় বলে এগুলোতে শক্তিশালী বিস্ফোরক ব্যবহার করা গিয়েছিল।
হিজবুল্লাহর ডিভাইসগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল?
ধারণা করা হচ্ছে, ডিভাইসগুলোর ব্যাটারিতে বিস্ফোরণ ঢুকানো হয়েছিল উৎপাদন পর্যায়েই। এরপর সেই ডিভাইসগুলো হিজবুল্লাহকে সরবরাহ করা হয়। শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল ডিভাইসগুলো হ্যাক করা হয়েছিল; কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটা অসম্ভব। কারণ উৎপাদনের সময়ই বা পরবর্তী পর্যায়ে কোনোভাবে ডিভাইসের ব্যাটারিতে বিস্ফোরক ভরা হয়, না হলে নেটওয়ার্ক হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পেজার ডিভাইসে এ ধরনের বিস্ফোরণ ঘটানো প্রযুক্তিগতভাবে একেবারেই অসম্ভব।
হিজবুল্লাহর তথ্য অনুযায়ী এই পেজার ডিভাইসগুলো উৎপাদিত হয়েছিল তাইওয়ানের গোল্ড অ্যাপোলো ইলেকট্রনিক্স পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে; কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ জানায়, তাইওয়ানের কারখানাতে নয়, বরং পেজারগুলো তৈরি হয়েছিল একটি হাঙ্গেরিয়ান ফার্মে। তারা গোল্ড অ্যাপোলোর ট্রেডমার্ক লাইসেন্স ব্যবহার করেছিল। কিছু প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই প্রতিষ্ঠানটি ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের একটি ফ্রন্ট বলে জানা যায়। ফলে ধারণা করা যায়, ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের জটিল সমীকরণে ডিভাইসগুলো হিজবুল্লাহর অজান্তেই মৃত্যুঘাতী বোমায় পরিণত করা হয়।
তবে ডিভাইসগুলো বিস্ফোরণের মূল কারণ বা উৎস এখনো অস্পষ্ট। প্রাথমিক কিছু তদন্তে দেখা যায়, পেজার ডিভাইসের রেডিও ইক্যুইপমেন্ট ছিল একটি জাপানি কোম্পানির। কিছু রেডিও নকঅফ আইসিওম আসি-ভি৮২ মডেলের। আইসিওএম নিশ্চিত করেছে যে তারা এক দশক আগে এ ধরনের রেডিও ইক্যুইপমেন্ট উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। তারা নিশ্চিত করেছে ডিভাইসগুলোতে আগে থেকেই বিস্ফোরক ভরা হয়েছে। তবে আরও প্রযুক্তিগত নিবিড় অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিস্ফোরণের উৎস বের করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
সাপ্লাই চেইন আক্রমণের ভূমিকা:
সাপ্লাই চেইন আক্রমণ ঘটে তখনই যখন উৎপাদন ও বণ্টনের সময় এর সঙ্গে অব্যবস্থাপনা বা দুষ্টচক্র জড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অনুপ্রবেশ করে হামলার আয়োজন করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পিইটিএন এবং আরডিএক্সসহ ক্ষুদ্র বিস্ফোরকগুলো লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির পাশে পেজারের ভেতরে রাখা হয়েছিল। ডিভাইসগুলো তারপর পৌঁছে দেয়া হয়েছিল হিজবুল্লাহর হাতে। গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের এ এক ভয়ানক দুর্বলতা। বিশেষ করে প্রতিরক্ষার মতো স্পর্শকাতর প্রযুক্তি মাধ্যমে এ ধরনের ডিভাইসগুলো বিপর্যয়কর পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পার
যেভাবে ঘটেছিল বিস্ফোরণ:
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিভাইসগুলো দূর থেকে একটি ‘ইলেক্ট্রনিক বার্তা’ দ্বারা ট্রিগার করা হয়েছিল, যা হিজবুল্লাহর নেতৃত্বের বলে মনে হয়েছিল। ডিভাইসগুলোতে বার্তা আসামাত্রই এগুলো বাজতে শুরু করেছিল। ব্যবহারকারীদের সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট বোতাম চাপতে, বোতাম চাপতেই লুকানো বিস্ফোরক সক্রিয় হয়, সঙ্গে সঙ্গে ডিভাইসগুলো বিস্ফোরিত হয়।
প্রতারণামূলক একটি বার্তার মাধ্যমে বিস্ফোরণের এ পদ্ধতি হিজবুল্লাহর পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। লেবাননের কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে যে, বার্তাটি ইচ্ছাকৃতভাবে একই সময়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পাঠানো হয়েছিল, ফলে একসঙ্গে সব ডিভাইসে বিস্ফোরণে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
কীভাবে ডিভাইসের আকার বিস্ফোরণকে প্রভাবিত করেছে:
ডিভাইসের আকার বিস্ফোরণের তীব্রতাকে প্রভাবিত করে। ওয়াকিটকির মতো বড় ডিভাইসগুলো বেশি বিস্ফোরক বহন করতে পারে, যার ফলে এগুলোতে শক্তিশালী বিস্ফোরণ এবং বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে। পেজারগুলো ছোট হওয়ায়, বিস্ফোরণের তীব্রতা কম হয় এবং ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়। তার মানে ভয়ংকর দুর্ঘটনার জন্য ডিভাইসের আকারও দায়ী। কিছু ডিভাইস বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটায়, অন্যগুলো কম দুর্ঘটনা ঘটালেও ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
ইউনিট ৮২০০-এর ভূমিকা কি সত্যিই আছে?
ইসরায়েলের এলিট মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স, ইউনিট ৮২০০। সাইবার এবং ইলেকট্রনিক যুদ্ধের দক্ষতার জন্য তারা কাজ করে। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন ধরনের সাইবার অপারেশন চালাতে তারা এবার সাধারণ পেজার এবং রেডিওকে প্রাণঘাতী অস্ত্রে পরিণত করেছে। এর আগে এই ইউনিটের সুপরিচিত অপারেশনগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে স্ট্যাঙ্কনেট। যা একটি অত্যাধুনিক সাইবার হামলা, যার মাধ্যমে ইরানের ইউরেনিয়াম সেন্ট্রিফিউজগুলোকে সংক্রামিত এবং নিষ্ক্রিয় করে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল ইসরায়েল।
ইউনিট ৮২০০-এর জন্য দায়ী আরেকটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যা। একটি রিমোট-নিয়ন্ত্রিত মেশিনগান ব্যবহার করে তা নির্ভুলতার সঙ্গে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছিল ইসরায়েল। এর মাধ্যমে ইউনিট ৮২০০ এটাও প্রমাণ করে, উচ্চ-প্রযুক্তিগত কৌশলগত হামলায় তারা কত ভয়ংকর ক্ষমতার প্রদর্শন করতে পারে।
হিজবুল্লাহর পেজার বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে সন্দেহ করা হয়, ইউনিট ৮২০০ তার সাইবার দক্ষতাকে সাপ্লাই চেইনে অনুপ্রবেশ করতে, ডিভাইসগুলোকে বিস্ফোরক দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে এবং দূর থেকেই তারা এগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা এগুলো সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর করতে পারে।
সোলার প্যানেল, ইভি বা স্মার্টফোনের মতো ডিভাইসগুলো কি ভবিষ্যতে নাশকতার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে?
এমন আরও অনেক ডিভাইস আছে, যেগুলো আন্তঃসংযুক্ত এবং জটিল সরবরাহ চেইনের ওপর নির্ভরশীল। ফলে এগুলোতেও নাশকতার আশঙ্কা আছে বটে। সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক যান (ইভি) এবং স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের মতো ডিভাইসগুলো যদি উৎপাদনের সময় বেহাত হয় বা গোপন কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয় তাহলে সহজেই এগুলোও নাশকতার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও সাধারণ মানুষ যেসব ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য ব্যবহার করেন অতিরিক্ত গরমের কারণে এগুলোও কখনো কখনো বিস্ফোরিত হতে পারে। হিজবুল্লাহর ঘটনা এটাই দেখা যে, এসব ডিভাইস ইচ্ছাকৃতভাবে অস্ত্রে পরিণত করা যেতে পারে।
হিজবুল্লাহর ক্ষেত্রে বিস্ফোরকগুলো ব্যাটারির পাশে রাখা হয়েছিল, ফলে বিস্ফোরণ তুলনামূলকভাবে কমই হয়েছিল; কিন্তু বড় ডিভাইসগুলোতে আরও শক্তিশালী বিস্ফোরক ব্যবহার করা যেতে পারে। তাহলে বিস্ফোরণও ঘটবে আরও বড় আকারে। এখন উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ভবিষ্যতের সংঘর্ষে হয়তো সরাসরি বোমা হামলার পরিবর্তে এসব ডিভাইসই ব্যবহৃত হবে।
অসম যুদ্ধের এক নতুন রূপ:
আধুনিক যুদ্ধে প্রযুক্তিকে কীভাবে অস্ত্রে পরিণত করা যেতে পারে হিজবুল্লাহর পেজার বিস্ফোরণ তার একটি উদাহরণ। সাপ্লাই চেইন আক্রমণের মাধ্যমে কোনো দুষ্টচক্র সহজেই এগুলো মারাত্মক অস্তে পরিণত করতে পারে। এমন কি সবচেয়ে সংস্থাগুলোও এর হাত থেকে রেহাই নাও পেতে পারে। কারণ, সাপ্লাই চেইনে এ ধরনের পণ্য সাধারণত বহুবার হাত বদল হয়ে গ্রাহকের হাতে পৌঁছায়।
এই হামলাটি তাই ইসরায়েলের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তোলে তা নয়, বরং আগামীর যুদ্ধে প্রযুক্তির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। পেজার, ওয়াকিটকি এবং এমনকি স্মার্টফোনের মতো ডিভাইসগুলো যোগাযোগের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। ফলে এগুলোর মাধ্যমে নাশকতার শঙ্কাও বাড়ছে। ভবিষ্যতে প্রযুক্তিবিশ্বের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া নির্ভর করে বিশ্বব্যাপী এর সাপ্লাই চেইনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর। কীভাবে ডিভাইসগুলো দুষ্টচক্রের হাত থেকে বাঁচবে তা-ই এখন চিন্তার বিষয়।
আমরা এমন একটি বিশ্বে বাস করছি, যেখানে যে কোনো ডিভাইস অস্ত্র হতে পারে। প্রশ্ন হলো, আমরা যদি এর জন্য এখনই সাবধান না করি, তাহলে কখন হবে? হয়তো আপনার পকেটের মোবাইল ফোনটিই হতে পারে পরবর্তী মারণাস্ত্র বা সমরাস্ত্র?
মুস্তাফা মাহমুদ হুসাইন: টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে