Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে নেতানিয়াহুর বিচার কতটা সম্ভব?

Mohshin  Habib

মহসীন হাবিব

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪

০২৪ সালের ২৪ মে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ইসরায়েলকে মিশর সীমান্তের কাছে দক্ষিণ গাজা অঞ্চলের রাফায় অভিযান বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। তা সত্ত্বেও, রাফায় হামলা বন্ধ করেনি দেশটি। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের প্রেসিডেন্ট নওয়াফ সালাম নির্দেশ দিয়েছেন, ‘ইসরায়েলকে অবিলম্বে সামরিক আক্রমণ বন্ধ করতে হবে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতিতে রাফায় যে কোনো পদক্ষেপ ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করতে পারে।’ এই মন্তব্যেই বোঝা যায় গাজাবাসীর ওপর ইহুদি জাতির অন্তহীন ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা কতটা নিষ্ঠুরভাবে চলছে। যদিও আদেশ দেয়াই আইসিজের সার। তা কার্যকর করার ব্যাপারে তেমন এখতিয়ার তাদের নেই। ইসরায়েল কারও কথাই কানে তুলছে না এখন। বিশ্বের কোনো নীতি-আইনই তারা আর মানছে না।

ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কথারও তারা মূল্য দেয়নি। বাইডেনের অনুরোধ অমান্য করেই তারা রাফায় আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। দক্ষিণ আফ্রিকাও যখন ইসরায়েলে বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার’ অভিযোগ তুলেছিল নেতানিয়াহুর অফিস সেই অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, ‘এগুলো মিথ্যা ও আপত্তিকর মন্তব্য।’ অবশ্য ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রকাশিত একটি যৌথ বিবৃতিতে নেতানিয়াহুর অফিস থেকে বলা হয়েছে, ‘আইন অনুযায়ী’ গাজায় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি অব্যাহত থাকবে।

এই রায়ের আগেই, ২০ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি নেতানিয়াহু ও তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং হামাসের শীর্ষ তিন নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার, মোহাম্মদ দাইফ এবং ইসমাইল হানিয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়েছিলেন। ইয়াহিয়া সিনাওয়ার গাজা উপত্যকার হামাস প্রধান, মোহাম্মদ দাইফ আল কাসাম ব্রিগেডের প্রধান এবং ইসমাইল হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান। আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আবেদনকে নেতানিয়াহু ‘অপমানজনক’ এবং ‘ইহুদিবিদ্বেষের নতুন ধরন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাওয়ার কারণে হামাসও আইসিসির কৌঁসুলির প্রতি নিন্দা প্রকাশ করেছে। তাদের মন্তব্য, ‘এই চাওয়া হত্যাকারী আর হত্যার শিকার ব্যক্তিকে এক করে ফেলে।’ আইসিসির কৌঁসুলি করিম এ খান গ্রেপ্তারের জন্য আবেদন চেয়ে দাবি করেছিলেন, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য উক্ত ব্যক্তিরা দায়ী, এটা প্রমাণের যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং লিবিয়ার প্রয়াত কর্নেল মোহাম্মর গাদ্দাফিকের কাতারে ফেলেবে। ইউক্রেন থেকে রাশিয়ায় শিশুদের বেআইনিভাবে সরিয়ে নেয়ার জন্য এবং নির্বাসন দেয়ার জন্য পুতিন গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মুখোমুখি হয়েছিলেন। বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হওয়ার আগে নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা ও নিপীড়নের জন্য কর্নেল গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। এ কারণে নেতানিয়াহু খুবই অপমান বোধ করেন। নেতানিয়াহুর প্রতিক্রিয়াও ছিল দেখার মতো। নেতানিয়াহুর মতে এই যুদ্ধের পেছনে ইতিহাস আছে এবং এটা তাদের নৈতিক যুদ্ধ। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং তার বিরুদ্ধে আনীত এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাওয়ার দাবিকে ‘অত্যন্ত অসম্মানজনক’ এবং যুদ্ধ বন্ধের এক পাঁয়তারা হিসেবে দেখছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এই সিদ্ধান্তকে ‘আপত্তিকর’ মনে করেছেন। ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ বলেছেন, যারা ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধ করার দাবি করছে তারা আসলে ইসরায়েলের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে চায়। ইসরায়েল কোনোভাবেই এটা মেনে নিবে না। ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার ল্যাপিড এই আদেশটিকে ‘একটি নৈতিক পতন এবং একটি নৈতিক বিপর্যয় বলে অভিহিত করেছেন। কারণ যুদ্ধ বন্ধের দাবির সঙ্গে সঙ্গে এটি হামাসের জিম্মিদেরও মুক্তির দাবি প্রকাশ করে। তার মানে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নৈতিক সমর্থন রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর।

‘গাজা যুদ্ধে ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে’ এবং ‘রাফাহ অভিযানের ওপর জরুরি স্থগিতাদেশ’ চেয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার করা মামলার এক সপ্তাহ পরে এই আদেশটি হস্তান্তর করা হয়েছিল। এত কিছুর পরও, দেখা যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বা ইসরায়েল রাষ্ট্র রাফার বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ চালিয়ে যাবে। কারণ তাদের বিশ্বাস, রাফায় হামাস জঙ্গিরা লুকিয়ে আছে।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) হলো জাতিসংঘের প্রধান বিচার বিভাগীয় অঙ্গ। এটিকে বিশ্ব আদালতও বলা হয়। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের সনদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আইসিজে ১৯৪৬ সালে তার কার্যক্রম শুরু করে।

আমার প্রশ্ন, আইসিজে কি আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে? রায় কার্যকর করার কোনো প্রত্যক্ষ উপায় আইসিজে-এর না থাকা সত্ত্বেও? ১৯৮৬ সালে নিকারাগুয়া প্রজাতন্ত্র বনাম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র-এর মধ্যে মামলাটির ক্ষেত্রে কী হয়েছিল? এই মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) বলেছিল, অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে, তার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে, তার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্যান্ডিনিস্তাদের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহে এবং নিকারাগুয়ার পোতাশ্রয় খনন করে কনট্রাসদের সমর্থন করে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। আইসিজে মামলার শুনানির এখতিয়ার নেই, এই যুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই মামলায় অংশ নিতে অস্বীকার করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রায়ের প্রয়োগকেও বাধা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিকারাগুয়াকে কোনো ক্ষতিপূরণও পেতেও বাধা দেয়।

ইসরায়েলও এখনো রাফায় আকমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তার জন্য সমালোচনারও শিকার হচ্ছে। অন্য দিকে নির্দোষ নাগরিকরা সমানে মারা যাচ্ছে দেখেও হামাস কোনো শান্তিপূর্ণ আলোচনায় যেতে রাজি নয়। গত বছর ৭ অক্টোবর হামাসের হাতে জিম্মি হয়েছে নিরীহ কিছু মানুষ। তাদের মুক্তির জন্য কোনো পক্ষই তেমন চেষ্টা চালাচ্ছে বলা যাবে না। তাই এটা স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মাধ্যমে শান্তি অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। এটা কেবলই এক ফ্যান্টাসি।

মহসীন হাবিব: লেখক ও সাংবাদিক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ