দেশে গৃহযুদ্ধের শঙ্কা কতটা যৌক্তিক?
সম্প্রতি একজন ঘনিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানালেন, তার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মেয়ে জানতে চেয়েছেন, দেশে কি সিভিল ওয়ারের (গৃহযুদ্ধ) পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে? কারণ তিনি শুনেছেন, দেশে বেশ কিছু সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো যাদের প্রধান হাতিয়ার। তারা নানাভাবে দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে নির্বাচন ভণ্ডুল করে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে যায়। শুধু তাই নয়, ওই ভদ্রলোক বললেন, তার প্রবাসী মেয়ে তাকে গ্রামে গিয়ে থাকার প্রস্তুতি নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন।
বলা হয়, মানুষ যখন বিদেশে থাকে তখন তার কাছে দেশ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সে তখন দেশকে অনেক বেশি ফিল করে, মিস করে। প্রবাসে থাকা কবি মুজিব ইরমের একটি কবিতার লাইন: ‘পরদেশে থাকি করি নিজ দেশে বাস।’
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ওই তরুণী হাজার মাইল দূরে বসে যে শঙ্কায় ভীত এবং তার বাবাকে সতর্ক করছেন, সেই মানসিক অবস্থা এখন সম্ভবত আরও অসংখ্য মানুষের—যারা দেশের পরিস্থিতি খুব কাছ থেকে দেখছেন বা যারা ভেতরের কিছু খবর রাখেন। বিশেষ করে কট্টরপন্থি ও উগ্রবাদীদের তৎপরতা এবং তার বিপরীতে সরকারের নমনীয় অবস্থান জনমনে সেই শঙ্কা আরও বাড়াচ্ছে।
প্রায় ২০ কোটি মানুষের দেশে সত্যি সত্যিই গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হোক সেটি কারোরই কাম্য নয়। কারণ যদি শেষ পর্যন্ত এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে তার ভিকটিম হবে দলমত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রাজধানীর বনানীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে এক আলোচনায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘দেশের মানুষের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার কোনো নিরাপত্তা দিচ্ছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকেও যেতে পারে। (যমুনা টেলিভিশন, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
সম্প্রতি রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক এবং সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীও বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যার বিচার করতে ব্যর্থ হলে মানুষ আবার রাস্তায় নামবে এবং তখন দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে।
গৃহযুদ্ধ কী ও কেন?
গৃহযুদ্ধ মানে গৃহ তথা ঘরে ঘরে যুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ এমন একটি সংকটময় পরিস্থিতি, যেখানে একটি দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়। যখন পুরো জাতি রাজনৈতিকভাবে এতটাই বিভাজিত হয়ে যায় যে, তারা প্রত্যেকে নিজের মত ও আদর্শকেই সঠিক মনে করে এবং ভিন্ন মত ও আদর্শের মানুষকে নির্মূল করাকে বৈধ মনে করে। এই লড়াই ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সহকর্মী দাঁড়ায় সহকর্মীর বিরুদ্ধে। গৃহযুদ্ধ এভাবে একটি দেশের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। এটি শুধুমাত্র রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে না, বরং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তাও হুমকির মুখে ফেলে। ইতিহাসে গৃহযুদ্ধ বহু দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
গৃহযুদ্ধের পরিণতি কী হতে পারে তার বড় উদাহরণ আফ্রিকার দেশ সুদান, রুয়ান্ডা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন। এইসব দেশের গৃহযুদ্ধ নিয়ে বেশ কিছু সিনেমাও আছে। যেমন রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে নির্মিত Hotel Rwanda (২০০৪) এবং Sometimes in April (২০০৫)। দক্ষিণ সুদানের গৃহযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত The Good Lie (২০১৪)। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত For Sama (২০১৯) ও The Cave (২০১৯)। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত Taxi to the Dark Side (২০০৭)। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত Hunger Ward (২০২০)। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত Glory (১৯৮৯) ও Lincoln (২০১২) ইত্যাদি।
গৃহযুদ্ধের প্রধান কারণ
একটি দেশে নানা কারণেই গৃহযুদ্ধ হতে পারে। যেমন:
১. ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, স্বৈরতন্ত্র বনাম গণতন্ত্রের লড়াই এবং নির্বাচন সংক্রান্ত অনিয়মের ফলে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হতে পারে।
২. বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধের ফলে অনেক দেশে গৃহযুদ্ধ হয়েছে।
৩. সম্পদের অসম বণ্টন, দারিদ্র্য ও বেকারত্বও গৃহযুদ্ধের একটি বড় কারণ।
৪. কিছু দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির পর রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হয়েছে, যা গৃহযুদ্ধের কারণ হয়েছে।
৫. কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ অনেক সময় গৃহযুদ্ধকে উসকে দেয়।
থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো কোথায়?
বাংলাদেশে যেসব কারণে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে জুলাই আন্দোলন চলাকালীন বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অনেক অস্ত্র এখনও উদ্ধার করা যায়নি। নিশ্চয়ই কোনো সাধারণ বা নিরপরাধ লোক থানা লুটের সঙ্গে জড়িত নন বা কোনো সাধারণ মানুষ তার বাড়িতে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র রাখবেন না। তাহলে থানা লুট করলো কারা এবং সেই অস্ত্রগুলো কোথায়? এই অস্ত্রগুলোই কি এখন বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে? এই অস্ত্রগুলো দিয়ে এখন দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে? থানা জ্বালিয়ে দিয়ে অস্ত্র লুট কি দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ?
গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে পুলিশ সদর দপ্তরের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বিভিন্ন থানা ও প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ হাজার ৮২৯টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৪২টি গুলি লুট হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৭৬৩টি অস্ত্র এবং দুই লাখ ৮৬ হাজার ৮২টি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। অর্থাৎ দুই হাজার ৬৬টি অস্ত্র এবং তিন লাখ ২০ হাজার ৬৬০টি গুলি নিখোঁজ রয়েছে। অস্ত্রের মধ্যে রাইফেল (চীনা), এসএমজি, পিস্তল, শটগান, টিয়ারগ্যাস লঞ্চার এবং সিগন্যাল পিস্তল। (ডেইলি স্টার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
এর তিন মাস পরে গণমাধ্যমের খবর, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের লুট হওয়া প্রায় দেড় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র ও আড়াই লাখের বেশি গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার হয়নি। লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গেছে, অপরাধেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে মুন্সিগঞ্জে এক তরুণীকে হত্যায় থানা থেকে লুট হওয়া পিস্তল ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অক্টোবর-নভেম্বর মাসে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলিসহ একাধিক হত্যাকাণ্ডে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গুলি ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা পুলিশের।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে খবরে বলা হয়, লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ জেলপলাতক আসামি, দাগি সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থী, চরমপন্থী, কিশোর গ্যাংয়ের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টি ভয় ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। (প্রথম আলো, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪)।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরুর পরে গত ১২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও বলেছেন, এই অপারেশনে আশানুরূপ অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। তবে ধীরে ধীরে সব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হবে। যতদিন ডেভিল থাকবে, ততদিন অভিযান পরিচালনা করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। (ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
গৃহযুদ্ধ ঠেকানোর কৌশল
কীভাবে একটি দেশ ও জনপদকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচানো যায়, তা নিয়ে অনেক গবেষণা আছে। অধিকাংশ গবেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন, কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়ে গৃহযুদ্ধ এড়ানো যায়। যেমন:
১. গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা তথা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা।
২. জাতিগত ও ধর্মীয় সহনশীলতা বাড়ানো। আন্তঃগোষ্ঠী সম্প্রীতি গড়ে তোলা।
৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন। দারিদ্র্য হ্রাস ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
৪. কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ তথা আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে সংঘাত নিরসনের প্রচেষ্টা নেওয়া।
৫. বহিরাগত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। অর্থাৎ বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ কমিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা স্থানীয়ভাবে সমাধান করা।
আশাবাদ কোথায়?
বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত—এই অভিযোগ বেশ পুরোনো। পক্ষান্তরে এটিও ঠিক যে, এই দেশে ধর্মপ্রাণ মানুষ যেমন আছে, তেমনি আছে বাউল ও সুফিবাদে বিশ্বাসী মানুষ। দল ও মতের ভিন্নতা সত্ত্বেও এই দেশের মানুষ যথেষ্ট সংসারী। পারিবারিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। এখনও অধিকাংশ মানুষ যৌথভাবে বেঁচে থাকে। একজনের বিপদে আরেকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যেহেতু এখানে চিকিৎসা ও নিরাপত্তার মতো মৌলিক অধিকারগুলো এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে শত ভাগ নিশ্চিত নয়, ফলে মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা এখনও বিরাট শক্তি। মহানগরীর কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এখনও একজন মানুষ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে লোকের অভাব হয় না। সুতরাং মানুষের এই পারস্পরিক ভালোবাসা, সংবেদনশীলতা, সহযোগিতামূলক সম্পর্কই হয়তো দেশকে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতির হাত থেকে বাঁচাবে।
মনে রাখতে হবে, এই দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মান্ধ বা উগ্রবাদী নয়। ফলে ধর্মীয় ইস্যুতে যারা উগ্রবাদ ছড়ানোর চেষ্টা করছেন, তারা শেষ পর্যন্ত পরাজিতই হবেন। রাজনৈতিক মত ও আদর্শ যাই থাকুক না কেন, দিন শেষে মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়াবে—এই বিশ্বাস আমাদের আছে।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে