বাংলাদেশে কত বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন?
রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি নিয়ে সরকারের কমিটি গঠনের আশ্বাসে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করছেন তারা। মঙ্গলবার বিকেলে কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল আলোচনার জন্য সচিবালয়ে যায়। আলোচনায় দাবির বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটি গঠনের আশ্বাস দেওয়া হয়। এর আগে সোমবার দিনভর শিক্ষার্থীরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। এতে পুরো রাজধানী প্রায় অচল হয়ে যায়। এমনকি বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ চলন্ত ট্রেনে ইট-পাটপকেল ছুড়লে শিশুসহ বেশ কয়েকজন রক্তাক্ত হয়েছেন বলেও গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
প্রসঙ্গত, পুরান ঢাকায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়, তখন ওই তালিকায় তিতুমীরের নামও ছিল। ঢাকা শহরকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করলে দেখা যাবে দক্ষিণ অংশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ- এই দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে; কিন্তু উত্তরাংশে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এই যুক্তিতে তিতুমীরের বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করা হয়তো অযৌক্তিক নয়।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পরে সাত বছর ধরে তারা নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চশিক্ষায় নানাবিধ সংকট উত্তরণে সাত কলেজকে নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি করছেন তারা। প্রসঙ্গত, এই কলেজগুলো একসময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। এগুলো হচ্ছে ঢাকা কলেজ, সরকারি ইডেন মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ও সরকারি বাঙলা কলেজ।
২০১৭ সালে যখন এই সিদ্ধান্ত হয় তখন বলা হয়েছিল, অধিভুক্ত এই কলেজগুলোর ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী এগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এর তিন বছর আগ ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপ কমাতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকার সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেন; কিন্তু এই কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলেও তারা নানাবিধ বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার। ফলে তারা ঢাবির অধীনে থাকতে চান না। সেজন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় চান; কিন্তু এর মধ্যে তিতুমীরে শিক্ষার্থীরা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করছেন। প্রশ্ন হলো তিতুমীরের এই দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে এরপরে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভুক্ত বাকি ছয় কলেজ এবং রাজধানীর তেজগাঁও কলেজসহ ঢাকা ও সারা দেশে আরও যেসব বড় কলেজ আছে, সেখানের শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?
কত বিশ্ববিদ্যালয় দরকার?
একটি দেশে কতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন? কতগুলো পাবলিক, স্বায়ত্তশাসিক ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি দরকার? তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়কে এভাবে পাবলিক, স্বায়ত্তশাসিত ও প্রাইভেট- এরকম আলাদা আলাদা ভাগ করাও এই সময়ের পৃথিবীতে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
স্মরণ করা যেতে পারে, বিগত সরকারের সময়ে একটি অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হবে। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এখন দেশের অধিকাংশ জেলাতেই সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে; কিন্তু প্রতিটি জেলায় কেন বিশ্ববিদ্যালয় লাগবে এবং বাংলাদেশের মতো একটি ছোট্ট আয়তনের দেশে প্রতিটি জেলায় কেন বিশ্ববিদ্যালয় লাগবে তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বুঝায়, সেই সংজ্ঞায় বাংলাদেশের কতগুলো প্রতিষ্ঠানকে আসলেই বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় বা কতটি প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা গেছে?
বাংলাদেশে এত এত বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অতি উৎসাহীরা ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে অভিহিত করেন, সেই প্রতিষ্ঠানটিও বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় কেন থাকে না? গত মাসেই টাইমস হায়ার এডুকেশন ২০২৫ সালের বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তার প্রথম ৮০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এমনকি সেরা ১ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও দেশের অন্যতম দুই বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের জায়গা হয়নি। অথচ তালিকায় সেরা ৮০০ এর মধ্যে ভারতের ২২টি এবং পাকিস্তানের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে।
কেন প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় লাগবে? সহজ উত্তর হলো প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় একেকটি প্রকল্প। অবকাঠামো প্রকল্প। বিরাট জমি অধিগ্রহণ। অধিগ্রহণের আগে থেকেই চলে সেখানে ব্যবসার প্রস্তুতি। অধিগ্রহণকৃত জমির মালিক কত পাবেন, যারা জমি কেনায় মধ্যস্থতা করলেন তারা কত পাবেন, বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের অংশ কত- এসব ঠিক হয়ে যায় প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুর আগেই। তারপর নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কত টাকার প্রকল্প কে ঠিকাদার, কে নির্মাণ সামগ্রীর সরবরাহকারী, কার কত ভাগ ইত্যাদি।
অবকাঠামো নির্মাণ চলাকালীনই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু। কারা নিয়োগ পাবেন, কোন কোন বিবেচনা সেখানে কাজ করবে, কোন পদের বিপরীতে কত টাকা ঘুষ নেয়া হবে- এসব নিয়ে চলে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। আবার বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়ে যাওয়ার পরেও একের পর এক প্রকল্প। অর্থাৎ পুরো বিষয়টিই টাকা-পয়সার খেলা। এখানে জাতিকে উচ্চশিক্ষিত করা, শিক্ষার মান বাড়ানো, নিত্য নতুন বিষয়ে গবেষণা করা মুখ্য বিষয় নয়। দলীয় লোকদের চাকরি এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার প্রকল্প। অথচ বাংলাদেশের মতো আয়তনে ছোট্ট একটি দেশে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটিই হাস্যকর, অবাস্তব ও অপ্রয়োজনীয়।
কেন জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় লাগবে? জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ, চিন্তাশীল জনগোষ্ঠী তৈরি, নতুন নতুন গবেষণার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা এবং সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়নের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন আছে? বরং যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন রয়েছে, সেগুলো প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারছে কি না; না পারলে তার সংকটগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর দ্রুত সমাধান করাই যৌক্তিক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা কি পরিষ্কার?
সম্ভবত আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটিই পরিষ্কার নয়। ধারণা পরিষ্কার হলে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার কথা বলতেন না। বরং জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার চেয়ে ভালো মানের মাধ্যমিক স্কুল এবং উন্নত মানের সরকারি হাসপাতাল গড়ে তোলা যে অনেক বেশি জরুরি- সেদিকে আমাদের রাষ্ট্রের নজর কম। বলা হয়, স্কুলে পড়ানো হয়। কলেজে শিক্ষার্থীরা পড়ে। আর বিশ্ববিদ্যালয় নতুন জ্ঞান তৈরি করে। পুরোনো জ্ঞান ও ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু এই অভিযোগ বহু পুরোনো যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কলেজেরই উন্নত সংস্করণ। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ যে গবেষণা, কিছু বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোথাও আসলেই কী গবেষণা এবং সেসব গবেষণা নিয়ে কতটা আলোচনা হয়, তা দেশবাসীর অজানা নয়।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে চোখ বুলালে দেখা যাবে যে, প্রায়ই বিভিন্ন সময়ে গবেষণার ফল প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং তা নিয়ে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম হয়। গবেষণার জন্য আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় এবং স্বনামখ্যাত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরে কতবার সংবাদ শিরোনাম হয়? বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের একজন অধ্যাপক বাজারে পাওয়া দুধের মান নিয়ে গবেষণা করে যে ফল প্রকাশ করেছিলেন, সেটি ভুল প্রমাণ করার জন্য খোদ রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীও প্রশ্ন তুলেছিলেন।
আন্দোলনের নেপথ্যে কী?
জনপরিসরে এই আলোচনও রয়েছে যে, গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে যেভাবে অসংখ্য মানুষ রাস্তায় নেমেছেন, তার পেছনে কি শুধুই দাবি আদায় নাকি অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে? অর্থাৎ এইসব গ্রুপকে রাস্তায় নামিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী ইন্ধন দিচ্ছে কি না বা কেউ এমন কোনো ফাঁদ তৈরি করছে কি না যে ফাঁদে শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ না বুঝেই পা দিচ্ছেন? এসব দাবি নিয়ে রাস্তায় নামার আগে তারা কি এটা ভেবেছেন যে একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে তাদের সব দাবি পূরণ করা সম্ভব নয় বা তাদের সব দাবি পূরণের ম্যান্ডেট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই?
বাস্তবতা হলো, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোনে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের যে সমর্থন ছিল, উৎসাহ ছিল, সেই বাস্তবতা এখন নেই। বরং এখন তারা বা অন্য যে কোনো গোষ্ঠী রাস্তায় নেমে যে জনদুর্ভোগ তৈরি করছে তাতে জনগণ ক্ষুব্ধ হচ্ছে। বিরক্ত হচ্ছে। রাস্তায় চলাচলের সময় মানুষের তীর্যক মন্তব্যও কানে আসে। সুতরাং জুলাইয়ের আন্দোলনের সময় যে ক্ষমতাসীনদের বলা হয়েছিল যে ‘দেয়ালের লিখন পড়ুন’- একইভাবে এখন যারাই দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামছেন তাদেরও এই কথা বলা প্রয়োজন যে, মানুষের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করুন। কারণ সাধারণ মানুষের সমর্থন ছাড়া কোনো দাবি আদায় করা যে কঠিন তার বড় উদাহরণ জুলাই অভ্যুত্থান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গৌতম রায়ের একটি ফেসবুক পোস্টের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক: ‘আমরা অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছি, যাতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে না ওঠে। সেই সঙ্গে রোপণ করেছি প্রত্যেকের নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় মনে করার আকাঙ্ক্ষা।’
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে