ভাষা আন্দোলনের কতটুকু ইতিহাস আমরা সংরক্ষণ করেছি?
আজ থেকে ৭২ বছর আগে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জান্তা সরকার রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির আন্দোলনে উত্তাল শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল। রক্তাক্ত সে আন্দোলনের ফসল, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি।
তবে আজ প্রশ্ন জাগে, জাতির ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া সেই আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণ নিয়ে। কারণ আন্দোলনে অংশ নেয়া সেইসব তরুণ প্রাণ আজ প্রবীণ এবং সেই একই কারণে দেশ হারাবে অগ্নিঝরা দিনের সব সাক্ষীকেও।
ভাষা আন্দোলনের সৈনিক ও গবেষক আহমেদ রফিক সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন, খুব কম গবেষকই ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করেছেন। তবে যে কোনো আন্দোলন শেষ হওয়ার পরপরই এর ইতিহাস সংরক্ষণ অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। অন্তত মুক্তিযুদ্ধের পর গৌরবোজ্জ্বল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য আলাদা গবেষণা হওয়া খুব জরুরি ছিল বলেই মনে করেন তিনি।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য গবেষণা করেছেন বদরুদ্দীন উমর। এ প্রসঙ্গে তার মত হলো, বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাস ভুলে যেতে ভালোবাসে এবং জাতি হিসেবে তারা ইতিহাস সম্পর্কে খুবই অজ্ঞ। যে কারণে ইতিহাস সংরক্ষণের অবস্থা এত ভয়াবহ।
প্রবীণ ইতিহাসবিদ ও গবেষক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘জাতি হিসেবে আমরা হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করতে পারব না। আর সে তুলনায়, ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে অবস্থা আরও খারাপ।’
তিনি বলেন, ‘যদিও ভাষা আন্দোলনের ফসল বাংলা ভাষার স্বীকৃতি এবং ঘটনাবহুল দিনটিকে আমরা শহীদ দিবস হিসেবে পালন করি। এবং দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও স্বীকৃত। এটিই প্রথম ঘটনা যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন করেছিল; কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস গবেষণার দুঃখজনক দিক হলো, এই ঘটনার গবেষক খুব কম এবং গবেষণা শেষ হলেও আমরা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছে দিতে পারছি না।’
ভাষা আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছেন?
বাংলাদেশই বিশ্বের প্রথম দেশ ও একমাত্র জাতি, যারা মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের রক্ত ঝরিয়েছে। এ পর্যন্ত আটজন শহীদের মধ্য থেকে শহীদ আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
তবে এ তালিকায় আরও তিনজনের নাম যুক্ত করেছেন প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক এম আর আখতার মুকুল, যারা সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। তারা হলেন- আব্দুল আউয়াল, ১০ বছরের ওহিদুল্লাহ ও অজ্ঞাতপরিচয় এক কিশোর।
‘দৈনিক আজাদ পত্রিকা’ ৯ জনের মৃত্যু ও বহু মৃতদেহ নিখোঁজ হওয়ার খবর প্রকাশ করেছিল। অন্যদিকে ‘সৈনিক’ বলেছে সাতজন। কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ জানিয়েছে, বিক্ষোভে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
একই সঙ্গে, ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেটের প্রতিবেদন অনুযায়ী নিহতদের সংখ্যা ১৪, পাকিস্তানি লেখক লাল খান জানান, সংখ্যাটি ২৬ এবং ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া কবির উদ্দিন আহমেদ নিহতের সংখ্যা আটজন বলে জানিয়েছেন।
তাজউদ্দীন আহমদ তার ডায়েরিতে, ২১ ফেব্রুয়ারি চারজনের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হলেও, অনানুষ্ঠানিক সূত্রমতে, সংখ্যাটি ১০ থেকে ১১ জন হবে বলে উল্লেখ করেন। পরদিন হাইকোর্ট, বিচারকের আদালত ও পুরান ঢাকার অন্যান্য এলাকায় পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পাঁচজনকে হত্যা করে। যদিও, বেসরকারি তথ্য বলছে, সংখ্যাটি ছিল ১২।
ভাষাসৈনিক ও গবেষক আহমেদ রফিক এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনি নিজে দেখেছেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল থেকে একটি লাশ টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেছে এবং তিনি ওই ব্যক্তির সন্ধান করতে পারেননি। অন্য একটি এলাকায় ঘটা একই রকম একটি ঘটনার কথা বদরুদ্দিন উমরও উল্লেখ করেছিলেন।
ভাষা আন্দোলনে নারীর অবদান অস্বীকৃতই রয়ে গেছে
সাক্ষরতার হার ১৫ শতাংশের কম নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে খুব কমসংখ্যক নারী শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন। অনেক লেখকের মতে, ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ জনেরও কম নারী শিক্ষার্থী দেখা যেত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেম আয়োজিত ‘তমদ্দুন মজলিসে’ যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সর্বপ্রথম বাঙালি সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করেন। ড. সুফিয়া খাতুন ছিলেন ভাষা আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের পথিকৃৎ। তিনি ১৯৫০-৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মহিলা হল ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫২ ও ১৯৫৩ মেয়াদের ভিপি ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর তার ‘ভাষা আন্দোলন ও নারী’ শীর্ষক লেখায় উল্লেখ করেন, ১৯৪৮ সাল থেকে আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনের তৎকালীন অন্যতম নেত্রী বেগজাদী মাহমুদা নাসিরের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুর রহমান চৌধুরী নারী শিক্ষার্থীদের রাজপথে নেমে ভাষা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুরুষ শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামতে দিচ্ছিল না এবং তারা উদ্বিগ্ন ছিল যে সেই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তাদের আন্দোলন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন নারী শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্দোলন বেগবান রাখেন।
যশোরের হামিদা রহমান ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামে কমিউনিস্টপন্থি পত্রিকা ‘স্বাধীনতা’য় সাহসের সঙ্গে লিখেছিলেন, ‘বাংলা কেন সাড়ে চার কোটি মানুষের রাষ্ট্রভাষা হবে না?’ শামসুন্নাহার মাহমুদ, লীলা রায় এবং আনোয়ারা চৌধুরীর মতো অনেক নারী অধ্যাপক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।
বদরুদ্দীন উমর তার ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ড. হালিমা খাতুন ও ড. সুফিয়া খাতুনসহ অনেক নারী শিক্ষক ও অধ্যাপক পুরান ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েদের সংগঠিত করে আন্দোলনে অংশ নেন।
বাংলাদেশের প্রথম নারী জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদের উদ্ধৃতি দিয়ে সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির লিখেছেন, ‘যখন পুরুষ আন্দোলনকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আক্রমণের শিকার হন এবং গ্রেপ্তার হন, তখন সর্বজনীন ভাষা আন্দোলন পরিষদের (ভাষা আন্দোলন পরিষদ) নেতারা পুলিশের প্রতিক্রিয়া কী হয়, তা দেখার জন্য নারী আন্দোলনকারীদের বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; কিন্তু পুলিশ তাদের ছাড়েনি।’ রাস্তায় নারী বিক্ষোভকারীদের মারধর করে পুলিশ।
১৯৫২ সালে ভাষাসৈনিক প্রতিভা মুৎসুদ্দী, প্রথমে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেন। পরে তিনি ঢাকায় আন্দোলনে যোগ দেন এবং তাকেও কারাগারে পাঠানো হয়। বরেণ্য এই ভাষাসৈনিক এখন টাঙ্গাইলে বসবাস করছেন।
তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ঐতিহাসিক এই ঘটনার ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও নারীদের সাহসী ভূমিকার রেকর্ড খুব কমই পাওয়া যায় এবং তাই নারী ভাষাসৈনিকরা তাদের প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে