রেলের ‘ভুলে’ ৪ হাজার কোটি টাকা জলে
অদূরদর্শিতার কারণে জনগণের আর কত অর্থ জলে যাবে
ঢাকার পাশেই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ আর গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার ৬ হাজার ১৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে গড়ে তোলা হচ্ছে পূর্বাচল নামে একটি নতুন শহর। পূর্বাচলে ২৬ হাজার প্লট, ৬২ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট, আধুনিক স্টেডিয়াম, খেলার মাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সুউচ্চ আইকনিক টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। ১৯৯৫ সালে নেয়া পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পটি প্রায় ৩০ বছরেও পুরোপুরি বাসযোগ্য হয়নি। অথচ পূর্বাচলের পাশেই রূপগঞ্জে ২০১০ সালে নেয়া জলসিঁড়ি আবাসন প্রকল্প এরই মধ্যে ব্যস্ততায় মুখরিত। মূলত সেনা কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য গড়ে ওঠা এই প্রকল্পটি এরই মধ্যে ঢাকার সবচেয়ে পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। একদম পাশাপাশি দুটি আবাসিক প্রকল্পের এই চিত্র বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্রেরই একটি ছোট্ট ছবি মাত্র। সরকারি উদ্যোগের আবাসন প্রকল্পটি ৩০ বছরেও বাসযোগ্য হয়নি। আর বেসরকারি উদ্যোগে ও সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় জলসিঁড়ি প্রকল্পটি এর অর্ধেক সময়েই প্রায় তৈরি।
পূর্বাচলের সঙ্গে ঢাকার নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করতে কুড়িল থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণ করা হয়। যেটি ৩০০ ফুট সড়ক নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। নতুন এই রাস্তা এবং নির্মীয়মাণ পূর্বাচল আবাসিক এলাকা হয়ে ওঠে ঢাকার মানুষের বেড়ানোর এক নতুন গন্তব্যে। পূর্বাচলের বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর, বিস্তৃত লেক, সবুজ- সব মিলে মানুষের শ্বাস নেয়ার নতুন জায়গা হয়ে ওঠে পূর্বাচল। কিন্তু পূর্বাচলে মানুষের বসবাস শুরুর আগেই ছুটির দিনে ৩০০ ফুট সড়ক যানজটে স্থবির হয়ে যায়। ফলে ব্যবহার শুরুর আগেই পরিত্যক্ত হয়ে যায় ৩০০ ফুট। এখন সেখানে গড়ে উঠেছে ১৪ লেনের আধুনিক এক্সপ্রেসওয়ে। কাগজে-কলমে যার নাম ‘শেখ হাসিনা সরণি’, তবে সাধারণ মানুষ এখনো একে ৩০০ ফুটই বলে। যদিও এটি এখন আর ৩০০ ফুট নেই।
শেখ হাসিনা সরণিতে গেলে মন ভালো হয়ে যায়। বাংলাদেশ মনেই হয় না; কিন্তু এই চাকচিক্য দেখলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। চালুর আগেই পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়া ‘৩০০ ফুট সড়ক’, আর নতুন করে বানানো ‘শেখ হাসিনা সরণি’তে কত হাজার কোটি টাকা অপচয় হয়েছে, তার হিসাব কে জানে। আমার খালি আফসোস, যারা পূর্বাচল নতুন শহরের পরিকল্পনা করলেন, যারা ৩০০ ফুট সড়ক বানালেন; তারা কি একটু সামনের দিকে তাকাননি। তারা কি তখন বুঝতে পারেননি, পূর্বাচল পুরোপুরি চালু হলে একটি ৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে সেটি সচল রাখা সম্ভব নয়। যারা এসব পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত, তারা নিশ্চয়ই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন। তাহলে তাদের মধ্যে এতটুকু দূরদর্শিতা থাকবে না কেন? কেন তাদের পরিকল্পনায় ৫০ বছর, ১০০ বছরের পরবর্তী অবস্থাটা থাকবে না।
শুধু পূর্বাচল বা ৩০০ ফুট সড়ক নয়; দূরদর্শিতার এমন আকাল, পরিকল্পনার এমন অভাব আমাদের পদে পদে। ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলছে বছরের পর বছর ধরে। এই প্রকল্পের কারণে গাজীপুরের মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। কবে নাগাদ এই প্রকল্প শেষ হবে, কবে মানুষ এর সুফল পাবে; এখনো কেউ জানেন না! নির্ধারিত সময়ে, নির্ধারিত ব্যয়ে শেষ হয়েছে এমন প্রকল্পের উদাহরণ বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। প্রথমে একটা সময় এবং ব্যয় দিয়ে প্রকল্প শুরু হয়। তারপর সময় বাড়তে থাকে, পাল্লা দিয়ে বাড়ে ব্যয়। এটা আমার কাছে অদ্ভূত লাগে। একটা প্রকল্পের ব্যয় এবং সময় কখনোই ঠিক করতে পারবেন না কেন আমাদের প্রকৌশলীরা।
আমাদের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে; কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এখনো এমন হয়নি যে, আমরা সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই অর্থের অপচয় করতে পারব। তার চেয়ে বড় কথা হলো, অর্থ থাকলেই সেটা অপচয় করতে হবে কেন। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেন, প্রকল্প নেয়ার আগে যেন, সেটা জনগণের কতটা কাজে লাগবে, সেটা আগে বিবেচনা করা হয়; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনগণ বিবেচনায় আসে না। ঠিকাদারদের লাভ, প্রকৌশলীদের কমিশনই প্রকল্পের ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য হয়ে যায়। অনেক হাসপাতালে কেনা যন্ত্রপাতি বছরের পর বছর পরে থাকার অসংখ্য উদাহরণ আছে। এসব যন্ত্রপাতি জনগণের কথা ভেবে কেনা হয়নি। কেনা হয়েছে ঠিকাদারদের ব্যবসার কথা ভেবে। প্রায়ই পত্রিকায় বিভিন্ন সেতুর ছবি ছাপা হয়, যার দুই পাশে কোনো রাস্তা নেই। তার মানে পছন্দের ঠিকাদারকে কিছু টাকা দেয়ার জন্যই এই সেতু বা কালভার্ট বানানো হয়েছে। এই সেতু জনগণের কোনো কাজে আসেনি কখনোই।
বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠান মানেই যেন শ্বেতহস্তী। চাহিদা থাকার পরও বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাবে। বিমানের টিকিট কিনতে গেলে পাবেন না; কিন্তু বছরের পর বছর লোকসান দিতে হবে জনগণের টাকায়। ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশের রেল নেটওয়ার্ক। সবচেয়ে আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত রেলওয়ে। বাংলাদেশেও রেলের চাহিদা ব্যাপক। টিকিট চাইতে গেলে পাবেন না; কিন্তু বছরের পর বছর লোকসান গুনতে হয় রেলওয়েকে। বর্তমান সরকার রেলওয়েকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। রেলওয়ের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় বানিয়েছে; কিন্তু রেলওয়ের কালো বেড়ালের গল্প সবার জানা।
লেখার শুরুতেই যে অদূরদর্শিতা আর পরিকল্পনাহীনতার কথা বলেছি, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশ রেলওয়ে। অথচ দেশজুড়ে রেলওয়ের যে নেটওয়ার্ক, যে সম্পদ, যে চাহিদা; তাতে রেলওয়ের হওয়ার কথা সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কেন ভিন্ন তার উদাহরণ হতে পারে অদূরদর্শিতা আর পরিকল্পনাহীনতার সর্বশেষ ঘটনাটি। গাজীপুরের টঙ্গী থেকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব পর্যন্ত শতবর্ষী মিটারগেজ রেললাইনের পাশে ২০১৬ সালে নির্মাণ করা হয় ৬১ কিলোমিটারের আরেকটি মিটারগেজ রেললাইন। এতে সিঙ্গেল লাইন থেকে ডাবল লাইন মিটারগেজে উন্নীত হয় সেকশনটি। প্রকল্পে খরচ হয় ২ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। একই সময়ে কুমিল্লার লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের পাশে তৈরি করা হয় ৬৪ কিলোমিটারের আরেকটি মিটারগেজ পথ। এ প্রকল্পে খরচ হয় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে ৪ হাজার কোটি টাকায় বানানো হয় ১২৫ কিলোমিটার নতুন রেলপথ। এতে গতি আসে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলরুটে; কিন্তু মাত্র ৮ বছরের মাথায় ৪ হাজার কোটি টাকার ১২৫ কিলোমিটার রেলপথ তুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, মিটারগেজ রেলপথকে ব্রডগেজে রূপান্তরের জন্যই রেলপথ দুটির তুলে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেনেশুনেই অর্থের অপচয় করা হচ্ছে; কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, উন্নয়নের স্বার্থেই মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রূপান্তর করা হচ্ছে; কিন্তু জনগণের অর্থ লোপাট করে এ কেমন উন্নয়ন ভাবনা। মাত্র ৮ বছরের ভবিষ্যৎ যারা দেখতে পারে না, তারা কেমন পরিকল্পনাবিদ। মানলাম রেলওয়ের উন্নয়নের স্বার্থেই মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে উন্নীত করা জরুরি; কিন্তু এই জরুরি বিষয়টি যারা মাত্র ৮ বছর আগেই বুঝতে পারলেন না, তাদের কি কোনো জবাবদিহি করতে হবে, তাদের কি কোনো শাস্তি হবে?
বাংলাদেশে একটা সাধারণ ধারণা আছে, ‘সরকারকা মাল দরিয়া মে ঢাল’। তারমানে সরকারের অর্থ নদীতে ঢেলে দেয়া যায়। এর জন্য কাউকে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না, কারও কোনো শাস্তি হয় না। সবচেয়ে মেধাবীরাই সরকারি চাকরি করার সুযোগ পান; কিন্তু কাজে গিয়ে তারা সেই মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারেন না। আমার খালি মনে হয়, এত অদক্ষ, এত অযোগ্য, এত অদূরদর্শী হয়ে তারা কীভাবে সরকারি চাকরি পান এবং বছরের পর বছর সেটা চালিয়ে যেতে পারেন। একবার ভাবুন, কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৮ বছরের মধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প তুলে ফেলা সম্ভব! যদি এটা করতেও হয়, তাহলে অবশ্যই দায়ীদের চাকরি যাবে, শাস্তি হবে। সরকারি অর্থকে যতদিন আমরা নিজেদের অর্থ ভাবতে না পারব, ততদিন এই অপচয় চলতেই থাকবে। এভাবেই সরকারের অর্থ নদীতে চলে যাবে।
লেখক: কলামিস্ট ও হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে