নতুন রাজনৈতিক দলের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কতটা হওয়া উচিত
নতুন একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হলো রাজপথ থেকে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া তরুণদের নেতৃত্বে এই রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে। এখন বড় প্রশ্ন উঠছে, এই নতুন দল সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক দল কি না? কিংবা দলটির কর্মসূচিতে বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা কতটা প্রতিফলিত হয়েছে?
দলটির নেতৃত্বে বিভিন্ন বিরুদ্ধ রাজনৈতিক ও দার্শনিক মতাদর্শের ব্যক্তিরা সমবেত আছেন। দলের আঙ্গিক এবং কর্মসূচিতে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ নির্মাণকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। নতুন রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য ও আদর্শ সম্পর্কে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানিয়েছেন। তার বক্তব্যে বলা হয়েছে, ‘আমরা মনে করি, জুলাই ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই সূচনা করেছে। একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা ও তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারব।’
তার এই বক্তব্য থেকে দলটির রাজনৈতিক কর্মসূচি সম্পর্কে মোটামুটি সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তিনি তার ঘোষণায় আরও বলেছেন, ‘ভারত কিংবা পাকিস্তানপন্থি নয় বরং দলটি হবে বাংলাদেশের মানুষের।’ তার এই বক্তব্য বাংলাদেশের গত ৫৩ বছরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রাসঙ্গিক। কারণ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের’ এই দুই ভাগে ভাগ হয়েছে। কারণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বৈশ্বিক রাজনীতির বিভক্তি থেকেই এই দুটি পক্ষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় নিজের স্বার্থ সংরক্ষণে ভারত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অন্যদিকে যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, সে কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি অনিবার্যভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধী হিসেবেই বিবেচিত হয়। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া রাজনৈতিক শক্তি ভারতপন্থি এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধী শক্তিরা পাকিস্তানপন্থি হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চিহ্নিত হয়। এই বিভাজন এখনো শেষ হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে নতুন রাজনৈতিক দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের ভারত ও পাকিস্তানপন্থি রাজনৈতিক বিভক্তির বেড়াজাল ভেঙে দিয়ে নতুন করে তার ভাষায় বাংলাদেশকে সামনে রেখে এবং বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থকে সামনে রেখে সেকেন্ড রিপাবলিক নির্মাণের ঘোষণা বাস্তবায়নই হবে নতুন রাজনৈতিক দলটির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
যে কোনো দেশের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি সামনের দিকে এগিয়ে যায় ইতিহাসের ধারাবাহিকতা থেকেই। সেই ধারাবাহিকতা পুরোপুরি বদলে দেয়া কখনো সম্ভব হয় না। ভারতের রাজনৈতিক দল ও সামাজিক কাঠামোর রূপান্তর নিয়ে আমাদের সামনে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় গবেষণা জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ‘পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন ইন্ডিয়া।’ তার গবেষণাপত্রটি বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলের গঠন, বিকাশ এবং দলগুলোর সাফল্য-ব্যর্থতার নির্মোহ বিশ্লেষণ সম্পর্কে জানার সবচেয়ে বড় সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই গবেষণাতেও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক দেখিয়েছেন, স্বাধীন ভারতে সত্যিকার অর্থে কোনো রাজনৈতিক দলের বিকাশ ঘটেনি। তার বিশ্লেষণে খুব স্পষ্ট করেই দেখিয়েছেন, ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে ইতিবাচক পথে বদলে দেয়ার চেয়ে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ গোষ্ঠী স্বার্থ, বৈশ্বিক রাজনীতির মোড়লদের পক্ষভুক্ত হয়ে ক্ষমতায় যাওয়া ও পাকাপোক্ত করা, পারিবারিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মাধ্যমে পুরো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বড় ধরনের বিভ্রান্তির চোরাবালির মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। ফলে ভারতে জনআকাঙ্ক্ষার সমর্থক কোনো সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেনি নয়, বরং বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী একটি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সেই গবেষণার বাস্তবতা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতেও দেখা যায়। স্বাধীন দেশের যাত্রার শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার রাজনৈতিক দল থেকে দ্রুতই একটি “পারিবারিক” স্বার্থ রক্ষার দলে বদলে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অসামান্য। তার নেতৃত্বকে সামনে রেখেই মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে; কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তার সরকারের যাত্রার শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখা রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাদ পড়েছে। বিশেষ করে ১৯৭২ সালের ২১ থেকে ২৩ জুলাই যখন তৎকালীন ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি সম্মেলন ডাকা হয়, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার আত্মীয়স্বজনদের (শেখ ফজলুল হক মনি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগের সম্মেলনেই অংশ নেন। এর মধ্য দিয়েই ওই বছর ৩১ অক্টোবর নতুন রাজনৈতিক দল জাসদের জন্ম হয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখা ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে বড় বিভাজন এখান থেকেই শুরু হয়। সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ, হাসানুল হক ইনুর মতো বঙ্গবন্ধুর একান্ত অনুগত ছাত্রনেতারাই তার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া শুরু করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের এই পারিবারিকীকরণের রাজনীতিই প্রকৃতপক্ষে দলটির ভবিষ্যৎ দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি নির্ধারণ করেছিল।
১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের স্পষ্ট বিভাজনের যে রাজনীতি শুরু হয়েছিল, সেটাই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে “ভারতপন্থি ও পাকিস্তানপন্থি” স্লোগানকে জনপ্রিয় করে। বিশেষ করে ছাত্রলীগের একাংশের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাসদ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সমর্থন দেয়া ভারতের বিরোধিতার স্লোগানকে সামনে রেখেই বাংলাদেশে ‘পারিবারিক আওয়ামী লীগ’বিরোধী রাজনীতিকে জনগণের কাছে জনপ্রিয় করতে থাকে। আর তখনই মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক শক্তিও ‘ভারতবিরোধী” স্লোগানকে পুঁজি করে রাজনীতিকে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পায়। পরবর্তী সময়ে এই বিভাজনের রাজনীতি দ্রুতই বিকশিত হতে থাকে।
সেই বিভাজনের রাজনীতির পথ ধরেই সে সময়ে সশস্ত্র বাহিনীতে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন এবং সামরিক শাসকদের রাজনীতিতে আসাটাও অনিবার্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের রাজনীতিতে আসাটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সেই ভয়ংকর গণহত্যার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমানের কণ্ঠেই দেশের মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিল। যে কারণে তিনি ক্ষমতায় এসে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলে দলটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়; কিন্তু সেই রাজনৈতিক দলটিও সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি সে সময়ে সশস্ত্র বাহিনীতে একের পর এক ক্যু ও পাল্টা ক্যুর কারণে। একপর্যায়ে জিয়াউর রহমানও নির্মমভাবে নিহত হন। ক্ষমতায় আসেন সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
এরশাদও দ্রুতই নিজেকে সেনাশাসক থেকে জাতীয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করলেন এবং দলটিকে রাতারাতি দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীন করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলেন। অর্থাৎ নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার “যন্ত্র” হিসেবেই এই রাজনৈতিক দলের জন্ম দেন, এটা প্রমাণিত হয়ে যায়। এই সময়ে আওয়ামী লীগ ও জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলনে থাকার কারণে জাতীয় রাজনীতিতে আবারও বড় ঐক্য সৃষ্টির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সেই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নেয় ১৯৯০ সালে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর শুরু হয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ভয়ংকর বিভাজনের রাজনীতি। বিশেষ করে দুটি দলেরই মূল রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ; কিন্তু দুটি দলই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নিজেদের বলয়ে নেয়ার টানাহেঁচড়ায় মেতে ওঠে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের আর সব গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বাদ দিয়ে এক অর্থে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক অর্জন হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে শেখ হাসিনার হঠকারী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নতুন প্রজন্মের সামনে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ পায় মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীরা।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকার সময়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও দলিল সংরক্ষণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবি ও গবেষক হাসান হাফিজুর রহমানের মাধ্যমে সাত খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র সংগঠিত করেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে সেই বিএনপির কতিপয় কেন্দ্রীয় নেতার অদূরদর্শী বক্তব্য সেই দলিলপত্র সংরক্ষণের উদ্যোগকেও গুরুত্বহীন করে তোলে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-উভয় দলের হঠকারী রাজনৈতিক অবস্থান মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশে জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার সব পথ বন্ধ করে দেয়। এরপর বাংলাদেশে আরও নানাভাবে রাজনৈতিক দলের জন্ম হতে দেখা গেছে। ধর্মীয় আদর্শের অনেক রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়েছে। পীরের দরবার থেকে একাধিক রাজনৈতিক দলের জন্ম হতে দেখেছেন দেশের মানুষ। আবার ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলের পর ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে বিভিন্ন নামে রাজনৈতিক দলের জন্ম হতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভেঙেও কোনো কোনো নেতা নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছেন। তবে তারা কেউই জাতীয় রাজনীতিতে সফল হননি। এর বাইরে স্বাধীন বাংলাদেশে কমিউনিস্ট মতাদর্শের রাজনৈতিক দল সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে সবসময়ই রাজপথে থাকলেও কখনই জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। বরং কমিউনিস্ট নেতাদের বড় একটা অংশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিতেই নিজেদের বিলীন করেছেন। আর যারা স্বকীয় রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে থেকেছেন তারা অত্যন্ত উঁচুমানের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য সম্মানিত হলেও জাতীয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কোনো অবস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিরোধী হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামী ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশে জাতীয় রাজনীতিতে বার বার তাদের রাজনৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে নামের কারনেই দলটিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী রাজনৈতিক দল হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না, ধর্মীয় সংগঠন হিসেবেই বিবেচিত হয়। এ ছাড়া একাত্তরে তাদের ভূমিকার বিষয়ে দলের রাজনৈতিক অবস্থান কেন্দ্রীয় নেতারা গত ৫৩ বছরে স্পষ্ট করতে পারেননি। ফলে বিভাজনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জামায়াতে ইসলামী কখনো কখনো শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক হলেও দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দলটির ভূমিকা বিএনপি-আওয়ামী লীগের সমপর্যায়ে যেতে পারেনি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দলকে ক্রমাগত তার আত্মীয়স্বজন এবং তাদের চাটুকারদের সুবিধাভোগীদের ‘ক্লাবে’ পরিণত করেছেন। আওয়ামী লীগ থেকে দলটি ‘শেখ হাসিনা লীগে’ পরিণত হয়। ফলে শুধুমাত্র ‘আওয়ামী লীগ সরকার’ থেকেছে; কিন্তু গত ১৬ বছরে দেশের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগ ক্রমাগত বিলীন হয়েছে। তারই প্রতিফলন আমরা জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেখেছি। অভ্যুত্থানের পর পরই আওয়ামী লীগ কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। দলটির বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও উঠে দাঁড়ানোও সুদূরপরাহত বলেই বিবেচিত হয়।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের গবেষণা থেকে আমরা দেখেছি, কীভাবে ভারতে কংগ্রেস ক্রমাগত পারিবারিক নেতৃত্বের বলে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল, কীভাবে কংগ্রেস একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার দলে বদলে গিয়েছিল। তার গবেষণার পথ ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের কাঠামো এবং বিকাশকে আমরা বিবেচনা করতে পারি। সেক্ষেত্রে আবারও বলতেই হবে দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ভারতের কংগ্রেসের মতোই পারিবারিক বলয় এবং ক্ষমতার সুবিধাভোগী গোষ্ঠীকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চার ভেতরেই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। তবে বড় পার্থক্য হচ্ছে ভারতে আমলাতন্ত্র কখনই রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করেনি, তাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃঢ় ভিত্তির কারণে; কিন্তু বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র সবসময়ই রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করেছে। ফলে রাজনীতিবিদরা বেশিরভাগ সময়ই আমলাতন্ত্রের অনিয়ম-দুর্নীতির দায়, নিজেদের দায় নিজেদের মাথায় নিয়ে অজনপ্রিয় হয়েছেন, বিতর্কিত হয়েছেন। আবার সাবেক আমলারা রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়ে রাজনীতিবিদদের বিপথে পরিচালিত করেছেন এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেই চরমভাবে দুর্বল করে দিয়েছেন। দেশে বিরাজনীতিকীকরণের যে কথা বলা হয়, সেই সুযোগও তৈরি হয় মূলত রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতার কারণেই। অধ্যাপক রাজ্জাকের গবেষণার কথা বললে, পাকিস্তানের রাজনীতির প্রসঙ্গও আসে; কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক উদাহরণ আমি টানব না। কারণ পাকিস্তানে মূলত ১৯৪৭ সালের পর থেকে কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বই ছিল না। সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থেকেছে এবং রাজনীতিবিদদের কোনো ভূমিকাই প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিতে ছিল না। ফলে ‘সেনা নিয়ন্ত্রিত’ রাজনীতির ইতিহাস গবেষণায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে পাকিস্তান একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে, এর বাইরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো কিংবা রাজনীতির ইতিহাস আর কোনো গুরুত্ব বহন করে না।
এই প্রেক্ষাপটেই জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া তরুণদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ হওয়া রাজনৈতিক দলের কাছে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। অনেকেই এই রাজনৈতিক দলের জন্মকে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে দেখছেন। তবে চট করেই এই দলকে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কারণ রাজপথে একটি সফল অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীরা রাজপথে থেকেই একটি দলের জন্ম দিয়েছেন। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের যে দুর্বলতা, সেটিই দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। জুলাই অভ্যুত্থানের আগে দেশের মানুষের কাছে এর মূল নেতৃত্ব এবং ইশতেহার কোনো সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। শেখ হাসিনার অপশাসনে অতিষ্ঠ বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ কোনো ইশতেহার ছাড়াই ছাত্র নেতৃত্বের আহ্বানে সরকার পতনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার ওপর বারবার গুলির ঘটনা দেশের সব মানুষ এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থকের একটা বড় অংশকেও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।
অভ্যুত্থানের আগে সুনির্দিষ্ট ইশতেহার না থাকার কারণেই যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে তা বাস্তবে সফল হয়নি। অনেক বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবী বলছেন, অভুত্থানের দিনেই শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হলে অভ্যুত্থান সফল বলে বিবেচিত হতো। তা না হওয়ার কারণে অভ্যুত্থান আবারও ধারাবাহিকভাবে চলে আসা রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরেই চলে গেছে; কিন্তু এর বিপরীতে এই সত্যও মানতে হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর জাতীয় সরকার গঠনের জন্য যে মতাদর্শিক ঐক্য জরুরি ছিল, সেটা একেবারেই সম্ভব ছিল না। কারণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্বে দেখা গেছে সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের তিন থেকে চারটি পক্ষ। সে সময় শহীদ মিনারে শপথ নিয়ে সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে তা রাজনীতিতে ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী সংকটের জন্ম দিতে পারত এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান অংকুরেই শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে সুস্পষ্ট নেতৃত্ব এবং সুনির্দিষ্ট ইশতেহার ছাড়া একটি গণঅভ্যুত্থানকে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া এই মুহূর্তে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃত্বের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এই চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই নতুন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের কাছে আমাদের খুব বেশি প্রত্যাশা এখনই থাকা উচিত নয়। বরং তাদের সময় ও সুযোগ দিতে হবে এবং দল পরিচালনায় তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এই নতুন নেতৃত্বের এখনই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ‘শটকাট’ রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ ঠিক হবে না। বরং রাষ্ট্র সংস্কারের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ করতে হবে। তাদের ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’-এর ঘোষণা খুবই ইতিবাচক; কিন্তু এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ আর মুক্তিযুদ্ধ এক নয়। আওয়ামী লীগ সময়ের প্রয়োজনে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিলেও মুক্তিযুদ্ধ ছিল দেশের সব মানুষের, সব মতের, সব পক্ষের। আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য গর্বিত, সেই স্বাধীন দেশ আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই পেয়েছিলাম। সময়ের পরিক্রমায় আওয়ামী লীগ বিপথে গেছে; কিন্তু সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এতটুকুও ম্লান হয় না। গুরুতর অপরাধের জন্য শেখ হাসিনাসহ দায়ীদের বিচারের কাঠগড়ায় অবশ্যই তুলতে হবে; কিন্তু লাখো শহীদের মুক্তিযুদ্ধকে কখনোই নয়। ফলে নতুন দলের নেতাদের বক্তব্যে, আচরণে, কর্মকাণ্ডে কখনই একাত্তরকে প্রতিপক্ষ করা যাবে না। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, যদি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতারা কোনোভাবে একাত্তরকে প্রতিপক্ষ করে তোলার চেষ্টা করেন তাহলে তারা রাজনৈতিক সমীকরণে সবেচেয়ে বড় ভুল করবেন। তাদের জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কোনোটিই সফল হবে না। কারণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে অতীতে কোনো রাজনৈতিক দলই মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা প্রতিপক্ষ করে জাতীয় রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে না।
রাশেদ মেহেদী, সম্পাদক, ভিউজ বাংলাদেশ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে