সংস্কার কতটা প্রয়োজন, কতটা টেকসই
‘সংস্কার’ শব্দটি ছোট; কিন্তু এর অর্থ এবং তাৎপর্য অশেষ, অসংখ্য। সংস্কারের ইংরেজি প্রতিশব্দ Reform. অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজ ডিকশনারিতে লেখা আছে, to make an improvement, especially by changing a person's behavior or the structure of something: এক কথায় বলা যায়, কোনো বিদ্যমান কাঠামো, কোনো বিদ্যমান সিস্টেম বা কোনো ব্যক্তির বিদ্যমান আচরণকে পরিবর্তন করে উন্নীত করাই হচ্ছে সংস্কার। তাই সংস্কার শব্দটি শুনলে পোড় খাওয়া জনগণ আশান্বিত হয়।
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গঠিত ৬টি সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশ চূড়ান্ত করে প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছেন এবং তা প্রকাশিত হয়েছে। খুবই ভালো কথা। সংস্কার কমিশনে যথেষ্ট বোদ্ধা লোকরাই নিয়োজিত ছিলেন এবং কেউ কেউ মনেপ্রাণেই সংস্কার চাচ্ছেন বলেই মনে করি। দেশের চিরাচরিত রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এবং নীতি আদর্শের যে ঘাটতি, তা থেকে সংস্কারের মাধ্যমে বের হয়ে আসতে পারলে দেশবাসী স্বস্তি পাবে। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনে শুধু নয়, স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও অনেক জঞ্জাল জমে স্তূপাকৃতি হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই জঞ্জাল প্রশাসন, রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই জমা হয়েছে। ৫৪ বছরের বিভিন্ন সরকারের সময় থেকে শেখ হাসিনার সর্বশেষ ১৫ বছরের নির্বাহী আদেশ, প্রজ্ঞাপন এবং আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এক দল অথবা এক গোষ্ঠীর শাসনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়েছিল। এর থেকে বের হওয়া জরুরি, কোনো সন্দেহ নাই।
প্রকাশিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। ধরে নিতে হবে সদিচ্ছা নিয়েই সংস্কার প্রস্তাবগুলো করা হয়েছে; কিন্তু সংস্কার প্রক্রিয়ায় কিছু দুর্বলতা চোখে পড়েছে, যা আরও জটিল অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। যেহেতু জনপ্রশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই এই একটি সংস্কার নিয়েই কিছু আলোচনা হতে পারে। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী একজন অভিজ্ঞ সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন এবং এ কাজের জন্য তিনি উপযুক্ত মানুষ এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে ইতিমধ্যে দু-একটি সংগঠন সংস্কার কমিশনের সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেটা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। সুপারিশে বেশ কিছু বিষয় সংযুক্ত হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। যেমন ই-সেবা চালুর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, ওয়েবসাইট হালনাগাদ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য জেলা নাগরিক কমিটি, উপজেলা নাগরিক কমিটি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, ৪৩টি মন্ত্রণালয় কমিয়ে ২৫টি করার সুপারিশ রয়েছে। রয়েছে পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে না চাওয়ার সুপারিশ। এ ছাড়াও প্রাদেশিক ব্যবস্থা চালু, ফরিদপুর ও কুমিল্লাকে বিভাগ করা, জেলা পরিষদ বাতিল, উপজেলাকে শক্তিশালী করা, ইউনিয়ন পরিষদকে অধিক দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ, যা প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণেরই নামান্তর। আরও বেশ কিছু আশা জাগানো সুপারিশ আছে।
কিন্তু সুপারিশে কিছু বেসিক দুর্বলতা চোখে পড়ছে, যা ভবিষ্যতে জনপ্রশাসনের কর্মপন্থাকে সুগম না করে আরো জটিল করে তুলতে পারে। পরিসরের বিবেচনায় আমরা দু-একটি উদাহরণ রাখতে চাই। যেমন ৬ দশমিক ১২ ক্রমে বলা হয়েছে ‘জেলা কমিশনারকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিআর মামলা প্রকৃতির অভিযোগগুলো গ্রহণের ক্ষমতা দেয়ার সুপারিশ করা হলো। তিনি অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য উপজেলার কোনো কর্মকর্তাকে বা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে সালিশি বা তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলে থানাকে মামলা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবেন।’ সিআর মামলা হলো নালিশি মামলা। নিঃসন্দেহে এই সুপারিশের বাস্তবায়ন হলে ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট’-এর ক্ষমতা অনেক বেশি সম্প্রসারিত হবে; কিন্তু দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে এটি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। নাগরিকদের মধ্যে বিচার পাওয়া নিয়ে, জুডিশিয়ারি এবং প্রশাসন নিয়ে একটি দ্বিধা তৈরি হবে। বিগত দিনে আমরা দেখেছি, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন, তা নিয়ে আদালতপাড়ায় একটি অনীহা বা বিরক্তি ছিল।
আরেকটি বিষয় হলো: ৯ দশমিক ৬ ক্রমে বলা হয়েছে,‘অতীতে দেখা গেছে যে, সিভিল সার্ভিসের অনেক অফিসার মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস)/সহকারী একান্ত সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালনের কারণে পরবর্তী সরকারের আমলে হয়রানির শিকার বা পদোন্নতি বঞ্চিত বা ওএসডি হয়েছেন। এরূপ পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব/সহকারী একান্ত সচিব মন্ত্রীদের অভিপ্রায় অনুসারে সিভিল সার্ভিসের বাইরে থেকে নিয়োগ করা যেতে পারে।’
দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই ধরনের সিদ্ধান্ত উল্টো প্রশাসনিক কাজে রাজনীতিবিদদের অধিক সম্পৃক্ত করবে। এটি সত্যি কথা যে একজন সচিব প্রশাসনিক কাজ যত বোঝেন তার অভিজ্ঞতা দিয়ে, একজন রাজনৈতিকভাবে নিয়োজিত ব্যক্তি তা বুঝবেন না, সে তিনি যত মেধাবীই হন না কেন। আমাদের দেশের বাস্তবতায় এই সুপারিশ গৃহীত হলে প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়বে। কথা হলো দেশ থেকে মাল প্র্যাকটিস দূর করা। আপনি যত সংস্কার করুন, যত কমিশন, সার্চ কমিটি, টাস্কফোর্স করুন, পাইলট প্রকল্প করুন- সততা, সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক কাজে দলনিরপেক্ষতার সংস্কৃতি গড়ে না উঠলে কোনো কিছুতে কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে না।
এখন একটি গল্প বলি। বছর ২৫ আগের কথা। মিউনিখ শহরের একটি রেস্টুরেন্টে বসে আছি। সুনসান নীরবতা। দু-একজন ঢুকছে, বের হচ্ছে। আমার দুই টেবিল দূরেই দুজন ভদ্রলোক বসে স্যুপ জাতীয় কিছু খাচ্ছেন। রেস্টুরেন্টে যারা ঢুকছেন এবং বের হচ্ছেন তাদের কেউ কেউ ওই টেবিলের লোকটিকে ডয়েচ ভাষায় শুধু হ্যালো বলছেন, তিনিও ‘হ্যালো’ বলে উত্তর দিচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে দীর্ঘদিন জার্মানিতে বসবাস করা যে বাঙালির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তিনি আসলেন। তিনিও লোকটিকে ‘হ্যালো’ বললেন। প্রশ্ন নিয়ে তার দিকে তাকালাম। বাঙালি বললেন, ওনাকে চেন? আমি না সূচক মাথা নাড়তেই তিনি বললেন, উনি মিউনিখ শহরের মেয়র ক্রিশ্চিয়ান উদে। অত্যন্ত জনপ্রিয়।’ অনভ্যস্ত চোখ দিয়ে তাকিয়ে ভাবলাম, লোকজনের ভিড় নেই, দেনদরবার নেই, এ কেমন মেয়র! তাও মিউনিখের মতো ভুবনবিখ্যাত শহরের?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের নির্বাচনে হেরে যান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিয়মানুযায়ী কংগ্রেসের জয়েন্ট সেশনে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিজয় আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করতে ইলেকটোরাল ব্যালট গণনার সময় ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা হামলা চালায়। ট্রাম্প সেই নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এ নিয়ে অনেক কাণ্ড, অনেক হৈচৈ ঘটে গেছে দেশটিতে তা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। অনেক বাগযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক বৈরিতার পর এবার জো বাইডেনের দলের মনোনীত প্রার্থী কমলা হ্যারিস খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হন। ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়ার সময় ঠিক নিয়মানুযায়ী পরাজিত প্রার্থী কমলা হ্যারিস এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঠিকই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। তারা আরেকটি ৬ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তির কথা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেননি। শান্তিপূর্ণভাবে পালাবদল হয়। গণতান্ত্রিক সমস্ত নর্ম অনুসরণ করে তারা দীর্ঘসময় ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। এই গণতান্ত্রিক নর্মের জন্য সংস্কারের চেয়েও বেশি প্রয়োজন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মানসিকতার পরিবর্তন।
আমাদের সংস্কার সফল হোক আশা করি; কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই উদার মনোভাব যতদিন চর্চায় না আসবে, ততদিন কোনো সংস্কার খুব সফলতা আনতে পারবে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, এটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে বর্তমান সরকার যে সংস্কার করবেন তা পরবর্তী নির্বাচিত সরকার বহাল রাখবেন। যদি তা না রাখেন এবং সংসদে গিয়ে উল্টে পাল্টে ফেলেন, তাহলে সংস্কার অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। এই নিশ্চয়তা আমাদের দিচ্ছে কে?
মহসীন হাবিব: সাংবাদিক, সাহিত্যিক, আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে