বিএনপির ভারত বিরোধিতা কতটা যৌক্তিক
২০০৮ সালের পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশের সরকারপ্রধান যতবার ভারত সফরে গিয়েছেন ততবারই সফর বিশ্লেষণ করে সংবাদ সম্মেলন করেছে বিএনপি। প্রত্যেকবার বিএনপি সফরের বিরোধিতা করে বিবৃতি প্রদান করেছে। বিবৃতিতে সফরের সমঝোতা ও দুই দেশের মধ্যকার চুক্তিকে নিয়ে বিএনপি নেতিবাচক মন্তব্য উপস্থাপন করেছে। আচ্ছা সম্মানিত পাঠক আপনারাই বলুন তো ২০০৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সব কিছুই কি অযৌক্তিক ও দেশবিরোধী? বিএনপির দৃষ্টিতে অন্তত এমনই, আচ্ছা এমন কি হতে পারে? বিএনপি এমন একটা অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে ভারতের বিরোধিতাও করে ফেলছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরকে ‘একপক্ষীয়’ দাবি করে বিরোধী দল বিএনপি বলছে, ‘বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের গোলামি চুক্তির ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আওয়ামী লীগ’। ফলে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দলটি। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিএনপির এ ধরনের বক্তব্য শুনে বাংলাদেশের মানুষ অভ্যস্ত। সে কারণেই বাংলাদেশের আম জনতা বিএনপির এ ধরনের বক্তব্যকে তেমন একটা গ্রহণ করছে না। একটা সময় বিএনপি মনে করেছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের মজবুত সম্পর্ক থাকায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকার ও কংগ্রেস শাসিত সরকারের সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
কংগ্রেস সরকারের পরবর্তী সময় বিজেপি জোটের বিজয়ে বিএনপি মিষ্টি বিতরণ করেছে। তারা মনে করেছিল মোদি সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের উন্নত সম্পর্ক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তারা মনে করেছিল বিজেপি সরকার বিএনপিকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করবে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে অসহযোগিতা করবে। পরে দেখা গেল মোদি সরকারের সঙ্গে আগের সরকারের তুলনায় আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক কাগজে কলমে আরও সুদৃঢ় হয়। বিশ্লেষক ও গবেষকরা বলে থাকেন, মোদি সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক আরও উন্নত ও মজবুত হয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে মোদি সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বার্থ আরও বেশি পরিমাণে সুরক্ষিত হয়েছে। সম্প্রতি মোদি সরকার আবারও রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করলে বিএনপির মধ্যে তেমন উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন এবং বিদেশি সরকারপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত সরকার সর্বপ্রথম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানান। এ সফরের গুরুত্ব তুলে ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দপ্তর নিয়ে কাজ করা অভিজ্ঞদের মতামতে জানা যায়, বাংলাদেশকে ভারত অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করছে। কেননা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে স্বাভাবিক ও সহযোগিতার সম্পর্ক ব্যতিরেকে সীমান্ত সুরক্ষা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
তাছাড়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির প্রসারতার কারণে ভারত সরকারও বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিয়ে পারস্পারিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করার দিকে তাগিদ প্রদান করছে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে অমীমাংসিত ইস্যুগুলোকে সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়াই প্রতিবেশী দুই দেশের লক্ষ্য। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘চুক্তি ও সমঝোতার নামে এদেশের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে ভারতের জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার অংশে পরিণত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক।’ দলটি বলছে, ভারতের সঙ্গে যে সাতটি সমঝোতা স্মারক নতুন করে সই করা হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই বাংলাদেশের ‘উত্তরাঞ্চল কেন্দ্রিক’।
এই চুক্তির মাধ্যমে রংপুর অঞ্চলকে বাংলাদেশকে থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র চলছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছে বিএনপি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ‘নতজানু’ বলে বর্ণনা করে দলটি বলছে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে সামরিক ও বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহার করতে চায় বলেই রেল ট্রানজিট নিয়েছে ভারত। গত প্রায় দেড় দশক ধরে তিস্তা চুক্তি না হওয়াকেও বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছে বিএনপি। অথচ খবরে জানা যায়, তিস্তা চুক্তি না হওয়ার পেছনে ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বিরোধকে বিশ্লেষকরা দায়ী করেছেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তিস্তার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছে। এর মানে হচ্ছে এ সফরেও তিস্তা নিয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হয়েছে। ভারতের সাংবিধানিক নিয়ম হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের লিখিত অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চুক্তিতে রাজি করানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। মোদি সরকার এখন সে পথেই হাঁটবে কেননা তিস্তা চুক্তি না হওয়ার কারণে অনেক উজ্জ্বল অর্জন অন্ধকারে পড়ে যায়।
কাজেই মোদি সরকারের অন্যতম কাজ হচ্ছে তিস্তার চুক্তিকে বাস্তবে রূপদান করা। আবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতেও ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য ভারত চীন দুই দেশের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগ বেশি, ভারতও বিনিয়োগ করছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী উভয় পক্ষের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক রয়েছে বলে আলোচনা ছড়িয়েছে। ভারতও জান্তা সরকার ও অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। সে লক্ষ্যেই দুই দেশের ভূমিকা থাকবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায়।
বাংলাদেশ সরকারও সব দিক বিবেচনা করে দুই দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করছে। আর এদিকে বিএনপি কেবলমাত্র সমালোচনায় মুখর। ভারতের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে যাচ্ছে- এমন ঘোষণাও বিএনপির নেতারা প্রদান করছে। আচ্ছা এমন বক্তব্য কি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? ভারতের অনুমতি নিয়ে চীন সফর স্পষ্টতই ভারত বিরোধিতা উঠে এসেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বিএনপির নেতাদের দূতাবাসগুলোতে দৌড়াদৌড়ি স্পষ্টতই বিএনপির বিদেশ নির্ভরতাকে তুলে ধরে। বাংলাদেশের মানুষ একটি রাজনৈতিক দলের এমন আচরণ কোনোভাবেই প্রত্যাশা করেনি। ভারতের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর, এ ধরনের বক্তব্য প্রদান করে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অবিবেচকের পরিচয় দিয়েছে।
একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির উচিত হবে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকার ও দেশের জন্য কল্যাণমূলক কর্ম সম্পাদন করা। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিএনপির দৃষ্টিতে সরকার কোনো ভালো কাজ করেনি। সব কাজেই বিএনপি দেশ বিক্রির গন্ধ পেয়েছে, দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর দলটির কাছে ব্যাপারটি তাদের সাফল্য হিসেবে ধরা দিয়েছিল। তারা মঞ্চে বক্তৃতায় সরকারের মারাত্মক বিষোদ্গার করেছে।
পরে যখন প্রমাণিত হলো পদ্মা সেতুতে সরকার কোনোরূপ দুর্নীতি করেনি কেননা বিশ্ব ব্যাংক সেতুর জন্য কোনো অর্থ ছাড় দেয়নি, সে সময়ে বিএনপি নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। বিএনপির উচিত ছিল তাদের দলের ভুল স্বীকার করা; কিন্তু উল্টো তারা সরকারকে কীভাবে বক্তব্যের মাধ্যমে খাটো করা যায় সেই পথ বেছে নিয়েছে। এ ধরনের মানসিকতা থেকে বের হয়ে এসে জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করার দীপ্ত শপথে জনগণের সঙ্গে মিশতে হবে। আর যদি ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি কিংবা সমঝোতা হয়, সেখানে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির প্রসঙ্গ টেনে আনে বিএনপি। সরকারের বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি এখন ভারত বিরোধিতায় নেমেছে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির এ জায়গা থেকে সরে আসা উচিত। এদিকে বিএনপিতে নতুন করে কাউন্সিল ব্যতিরেকে কমিটি প্রদান করা হচ্ছে, এতে দলে অসন্তোষ বাড়ছে এবং নেতাদের মধ্যে পদ হারিয়ে ফেলার একটি আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বিএনপির উচিত হবে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি প্রণয়ন করে দলের অভ্যন্তরে স্বচ্ছতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা।
মো. সাখাওয়াত হোসেন: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে