Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

সাফ মুকুট ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ

কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০২৪

বিমানবন্দর থেকে ছাদখোলা বাসে চড়ে মতিঝিল যাত্রায় নারী ফুটবলারদের বরণ করতে পথে নেমে এসেছিলেন লাখো মানুষ, লাইন দিয়েছিলেন সেলিব্রিটিরাও। নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পরের দৃশ্যগুলো নিশ্চই ভুলে যাননি দেশের ফুটবলামোদিরা। আবেগের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ২০২২ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। প্রায় ২৫ মাসের ব্যবধানে আরেকটি সংস্করণ দুয়ারে কড়া নাড়ছে।

দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে স্বাগতিক নেপালের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। আসর থেকে জয় করা প্রথম মুকুট ধরে রাখার চ্যালেঞ্জের সামনে এবার লাল-সবুজরা। সাফল্যের রঙে দেশকে রাঙানো সেই দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামেই চ্যালেঞ্জটা নিচ্ছে পিটার বাটলারের দল। প্রশ্ন হচ্ছে, সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটুকু প্রস্তুত বাংলাদেশ? নিজেদের জায়গায় বাংলাদেশ হয়তো পুরোপুরি প্রস্তুত; কিন্তু লাল-সবুজদের চেয়ে আরও ভালো প্রস্তুতি নিয়েছে এ অঞ্চলের দুই প্রতিষ্ঠিত শক্তি- নেপাল ও ভারত। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের শিরোপা ধরে রাখার কাজটা আক্ষরিক অর্থেই কঠিন বলে মনে হচ্ছে।

সাফ মিশনে ইনজুরি এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার কারণে সতীর্থদের চেয়ে খানিকটা পিছিয়ে আছেন কৃষ্ণা রানী সরকার। নেপালের বিপক্ষে ফাইনালে জোড়া গোল করা ফরোয়ার্ডের চূড়ান্ত দলে জায়গা পাওয়াটা নিশ্চিত নয়। সম্প্রতি অনুশীলনে ফিরেছেন এ ফরোয়ার্ড। লড়ছেন ফিটনেস এবং ইনজুরির কারণে হারিয়ে ফেলা মনোবল ফিরে পেতে। কৃষ্ণা রানীকে স্কোয়াডে রাখা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে নারী জাতীয় দলের প্রধান কোচ পিটার বাটলার। ফিটনেস এবং আত্মবিশ্বাস শতভাগে না পৌঁছালেও কোচ হয়তো এ ফুটবলারকে নিয়ে একটা বাজি ধরবেন। সেটা অনুশীলন পর্বে কৃষ্ণা রানীর দেখানো দক্ষতার কারণে। আক্রমণভাগে কোচের হাতে যথেষ্ট বিকল্প থাকার কারণে মূল স্কোয়াডে আসতে হলে কৃষ্ণাকে অনুশীলনে দেখানো দক্ষতার ‘সিরিজ’ চালিয়ে যেতে হবে।

আক্রমণভাগ ছাড়াও কোচের হাতে যথেষ্ট বিকল্প রয়েছে অন্যান্য পজিশনেও। বিভিন্ন পজিশনের লাইনআপ সাজাতে বিকল্প রসদ থাকার কারণে প্রধান কোচ পিটার বাটলার হয়তো একাধিক ফরমেশনে খেলানোর মতো স্কোয়াড নিয়েই নেপাল যাবেন। প্রতিভায় ঠাসা একটি গ্রুপ থাকার পরও বাংলাদেশ কি সাফ মুকুট ধরে রাখার বিষয়ে নির্ভার থাকতে পারছে? সম্ভবত উত্তরটা নেতিবাচক। কারণ সাফ জয়ের পর বাংলাদেশ ধরেছিল উল্টোরথ। বিপরীতে লাল-সবুজদের প্রধান প্রতিপক্ষ নেপাল ও ভারত শক্তিশালী একাধিক দলের বিপক্ষে নিয়মিত খেলেছে, দেশ দুটির বিচরণ ছিল প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে। যেখানে বাংলাদেশ আবদ্ধ ছিল প্রীতি ম্যাচের গণ্ডিতে।

এবার বাংলাদেশ এবং প্রধান দুই প্রতিপক্ষের পরিসংখ্যানে একটু চোখ বোলানো যাক। ২০২২ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের পর ভারত ১৯ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে। ম্যাচগুলোতে প্রতিপক্ষের তালিকায় ছিল কসোভো, উজবেকিস্তান, মিয়ানমার, এস্তোনিয়া, ভিয়েতনাম, জাপান, থাইল্যান্ড, চাইনিজ তাইপে ও জর্ডান। নেপাল খেলেছে ১৪ ম্যাচ। দলটির প্রতিপক্ষ তালিকায় ছিল জর্ডান, লেবানন, ফিলিস্তিন, ইরাক, ভারত, ভিয়েতনাম, জাপানের মতো দল। এ সময়ের মধ্যে নেপাল দুটি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশের বিপক্ষেও। অন্যদিকে ২০২২ সালের সাফ জয়ের পর বাংলাদেশ খেলেছে ১১ ম্যাচ। যার তিনটি ছিল প্রতিযোগিতামূলক, বাকি ৮ ম্যাচের স্ট্যাটাস হচ্ছে ‘ফিফা প্রীতি’। চলতি বছর বাংলাদেশ ৪ ম্যাচ খেলেছে, সব ছিল ফিফা প্রীতি ম্যাচ। ২০২৪ সালে ভারত খেলেছে ৭ ম্যাচ, অংশগ্রহণ করেছে তুর্কিশ কাপের মতো আসরে। চলতি বছর নেপাল খেলেছে ৫ ম্যাচ। সবই ছিল পশ্চিম এশিয়া নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে।

ওপরের পরিসংখ্যানেই পরিষ্কার- প্রধান দুই প্রতিপক্ষ প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলে নিজেদের পরখ করে রেখেছে, আগামীর চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশ বন্দি ছিল প্রীতি ম্যাচের গণ্ডিতে, যা আসন্ন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপাল, ভারত এবং বাংলাদেশের মাঝে পরিষ্কার তারতম্য ফুটিয়ে তুলতে পারে। খোদ দলের অভ্যন্তর থেকেই এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাফ শিরোপা ধরে রাখার মিশনে নামার আগে দল সংশ্লিষ্টদের প্রীতি ম্যাচ খেলার দাবি ছিল; কিন্তু বাংলাদেশ ফুটবলের নিয়ন্তারা ফেডারেশনের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সে দাবি পূরণ হয়নি।

এক যুগের বেশি সময় জাতীয় দলের কোচ হিসেবে কাজ করা গোলাম রাব্বানী ছোটনের চাওয়া ২০২২ সালে জেতা ট্রফি এবার ধরে রাখুক বাংলাদেশ; কিন্তু কাজটা যে কঠিন সেটাও স্মরণ করিয়ে দিলেন সেনাবাহিনীর নারী দল নিয়ে কাজ করা এ কোচ, ‘আমি মনে-প্রাণে চাইব মেয়েরা সাফ শিরোপা ধরে রাখুক। কাজটা অবশ্য বেশ কঠিন। কারণ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সবাই বাংলাদেশকে টার্গেট করবে। তাছাড়া গেল ২৫ মাসে আন্তর্জাতিক কার্যক্রমের দিক থেকে ভারত ও নেপাল আমাদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। এ সময়ের মধ্যে আমাদের তুলনায় প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচও বেশি খেলেছে দেশ দুটি। সে দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত ও নেপাল আমাদের তুলনায় গোছালো দল নিয়ে নামবে।’

দীর্ঘদিনের কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটনের দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি দলের ওপর বেশ প্রভাব ফেলছে বলেই মনে করা হচ্ছে। কোনো দলের কোচের পদই স্থায়ী নয়, বরং এ জায়গায় পরিবর্তন আসে নিয়মিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসাটা স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে; কিন্তু এখানে কিছু বিষয় উল্লেখ করা জরুরি, গোলাম রাব্বানী ছোটন যে প্রক্রিয়ায় দলটি নিয়ন্ত্রণ করেছেন; সেটা অন্যদের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। এ কোচের প্রধান মুনশিয়ানা বোধ করি ম্যাচ চলাকালে মেয়েদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা। দেখা গেল কোনো ম্যাচের শুরুতেই গোল হজম করে বাংলাদেশের খেই হারানোর দশা! ওই অবস্থায় আবেগের লাগাম টেনে ধরে স্বাভাবিক ফুটবল খেলে ম্যাচ নিয়ন্ত্রণে নেয়াটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সাবিনা-কৃষ্ণাদের সাবেক এ কোচ নিয়মিতই সে চ্যালেঞ্জে সফল ছিলেন।

গোলাম রাব্বানী ছোটনের সঙ্গে মেয়েদের সম্পর্ক ছিল সন্তান-অভিভাবকের মতো মধুর। যেখানে শাসনের সঙ্গে ছিল নানা বায়না-আবদারও। দিন শেষে গোটা দল ছিল সুশৃঙ্খল পরিবারের মতো একটি ইউনিট। গোলাম রাব্বানী ছোটন দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়ার পর উত্তরসূরিরা কিন্তু দলটি সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। যে কারণে দলের অভ্যন্তরে গ্রুপিংয়ের অস্তিত্বও খুঁজে পাচ্ছেন কেউ কেউ। সিনিয়র ফুটবলারদের মাঝে গ্রুপিংয়ে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমান প্রধান কোচ পিটার বাটলারের একটি বার্তা পরিষ্কার- কোনো সিনিয়র-জুনিয়র নেই, নৈপুণ্যই দলে সুযোগ পাওয়ার একমাত্র সূত্র। এ কোচের কথা এবং কাজে মিলও পাওয়া গেছে নিকট অতীতে। কোচের এ তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সিনিয়র খেলোয়াড়দের বিদ্রোহের আশঙ্কাও কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না! সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের আগে ভাবতে হচ্ছে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় নিয়েও।

এবার আসা যাক, দলের বিভিন্ন পজিশনের প্রসঙ্গে। কৃষ্ণা রানী সরকারের থাকা না থাকা আক্রমণভাগের জন্য বড় কোনো সমস্যা মনে করা হচ্ছে না। তার পরও ফিটনেস এবং ইনজুরি-পরবর্তী আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলে দলে এ উইঙ্গারের অন্তর্ভুক্তি প্লাস পয়েন্ট হতে পারে। সেটা জাতীয় দলে দীর্ঘদিন ধরে খেলার অভিজ্ঞতার কারণে। কৃষ্ণা রানী ছাড়া আক্রমণভাগে তহুরা খাতুন, শামসুন নাহার জুনিয়র, সুরভী আকন্দ প্রীতি, মোসাম্মাৎ সাগরিকা, শাহেদা আক্তার রিপাদের মধ্যে থেকে লাইনআপ চূড়ান্ত করার অপশন থাকছে কোচের হাতে। মাঝমাঠে মরিয়া মান্ডা-মনিকা চাকমার জুটি এখনো দলের ‘নিউক্লিয়াস’। যদিও মনিকা চাকমা ফর্মের সঙ্গে লড়াই করছেন, মারিয়া অবশ্য দারুণ ছন্দে আছেন। এ ছাড়া ঋতুপর্ণা চাকমা, সাবিনা খাতুন, সানজিদা আক্তার, মাতসুশিমা সুমাইয়াও আছে।

এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে, সাবিনা খাতুন একটা সময় আক্রমণভাগের প্রধান ভরসা ছিলেন। এখন আক্রমণভাগ ও মাঝমাঠ- দুই পজিশনেই খেলতে সক্ষম অভিজ্ঞ এ ফুটবলার। পিটার বাটলারের কোচিং স্টাফরা তাকে এখন মিডফিল্ডার হিসেবেই বিবেচনা করেন। মাঝমাঠে বিকল্প হিসেবে তনিমা, মুনকি আক্তার, আইরিন ও স্বপ্না রানীও থাকছেন। রক্ষণভাগের জন্য মাসুরা পারভিন, শিউলি আজিম, কোহাতি কিসকু, শামসুন নাহার সিনিয়র, আফিদা খন্দকার, অর্পিতা বিশ্বাস আছেন। গোলরক্ষক পজিশনে রুপনা চাকমার পাশে দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে আছেন ইয়ারজান বেগম। তাদের পাশে তৃতীয় গোলরক্ষক হিসেবে মিলি আক্তার, স্বর্ণা রানী ও সাথী বিশ্বাসের মধ্যে থেকে আরেকজন থাকবেন।

উল্লিখিতদের বাইরেও জাতীয় দলের ক্যাম্পে থাকা অনেক তরুণ প্রতিভা চূড়ান্ত দলের জন্য বিবেচনার সুযোগ থাকছে পিটার বাটলারের হাতে। এখানে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, প্রতিটি পজিশনে একাধিক যোগ্য বিকল্প রয়েছে। সঠিক সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় যদি খেলোয়াড়রা জ্বলে উঠতে পারেন, সেটা বাংলাদেশের জন্য দারুণ বিষয় হতে পারে। তার আগে, কোচ দলটা আদৌ এক সুতোয় গাঁথতে পেরেছেন কি না-পরিষ্কার নয়। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শুরুর আগে প্রীতি ম্যাচ খেলতে পারলে সেটা পরিষ্কার হতো; কিন্তু সে সুযোগ কোথায়!

সাত জাতির আসরের ‘এ’ গ্রুপে খেলবে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ হিসেবে আছে ভারত ও পাকিস্তান। ‘বি’ গ্রুপে রয়েছে বাকি চার দেশ- নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ। বাংলাদেশ বর্তমান চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও ‘এ’ গ্রুপে ভারতকে ফেভারিট মনে করা হচ্ছে। সেটি দেশটির সাম্প্রতিক ফুটবল কার্যক্রমের কারণে। ভারতের মতোই ফেভারিট ট্যাগ থাকছে বাংলাদেশের ওপর। বড় কোনো অঘটন না ঘটলে গ্রুপ থেকে সেমিফাইনালে যাওয়ার কথা দেশ দুটির। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে গ্রুপের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়, যার ওপর নির্ভর করছে সেমিফাইনালের প্রতিপক্ষ। ‘বি’ গ্রুপে পরিষ্কার ফেভারিট নেপাল। ‘এ’ গ্রুপের শীর্ষ দল হিসেবে সেমিফাইনালে যেতে পারলে ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে নেপালকে পাশ কাটানো যাবে। বাংলাদেশের মতো ভারতও কিন্তু সেটা চাইবে। গেল আসরের সেমিফাইনালে এই নেপালের কাছে হেরেই বিদায় নিয়েছিল ভারত। এবারও নিশ্চই স্বাগতিকদের সামনে পড়তে চাইবে না ভারত।

‘এ’ গ্রুপে ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হচ্ছে ১৭ অক্টোবর, উদ্বোধনী দিনেই। ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ খেলবে পাকিস্তানের বিপক্ষে। ২৩ অক্টোবর ভারতের বিপক্ষে গ্রুপ ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। সাফ শুরুর আগের চিত্র এবং গ্রুপ পর্বের বর্ণনা টেনেই শেষ করা যাক। বাকি চিত্র দেখতে অপেক্ষা করুন মারিয়া মান্ডা-মনিকা চাকমাদের ম্যাচের জন্য।

মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ