Views Bangladesh Logo

স্বাধীনতার ঘোষণা-বিতর্ক এখনো কতটা প্রাসঙ্গিক?

Amin Al  Rasheed

আমীন আল রশীদ

দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছর পরেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন- তা নিয়ে বিতর্ক করা কতটা সমীচীন এবং অর্ধশতাব্দী পরেও এই ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে না ওঠা তথা এরকম একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিতর্কের অবসান করতে না পারা রাজনৈতিক ব্যর্থতা কি না এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটি একটি বড় ধরনের লজ্জা কি না- সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। নেই বলেই স্বাধীনতার ঘোষণা ও ঘোষক বিতর্ক নিয়ে নতুন করে কথা বলার প্রয়োজন রয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত তথা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইপিআর ট্রান্সমিটারের সাহায্যে যে স্বাধীনতার ঘোষণা সারা দেশে সম্প্রচারের জন্য পাঠিয়ে দেন, সেটিই স্বাধীনতার প্রথম তথা আনুষ্ঠানকি ঘোষণা। পরদিন ২৭ মার্চ চট্টগ্রামে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটি স্পষ্টতই ছিল বঙ্গবন্ধুর পক্ষে।

অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকেই তিনি নিজের মতো করে পাঠ করেছেন- যা সৈনিকদের তো বটেই, সাধারণ মানুষকেও উদ্দীপ্ত করেছে; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, পরবর্তীকালে স্বাধীনতার এই ঘোষণা নিয়ে তথা কে স্বাধীনতার ঘোষক- তা নিয়ে কিছু অহেতুক বিতর্কের জন্ম দেয়া হয়েছে, যা বঙ্গবন্ধু এবং জিয়াউর রহমান- কারও জন্যই সম্মানজনক নয়। এই বিতর্কটি উসকে দেয়া হয়েছে মূলত ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা নেয়ার জন্য। এই রাজনীতি বিএনপির পক্ষ থেকে যেমন হয়েছে, তেমনি এই ইস্যুতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগও যথেষ্ট উদারতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছর পরেও এ নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়নি। উপরন্তু এই ইস্যুটি নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো মতানৈক্য এতটাই চরমে পৌাঁছায় যে, একসময় আওয়ামী লীগ জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও অস্বীকার করা শুরু করে এবং তাকে ‘বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা’ এমনকি ‘পাকিস্তানের চর’ বলেও আখ্যা দেয়। শুধু তাই নয়, তার ‘বীরউত্তম’ খেতাবও বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। যদিও ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে গত ১১ মার্চ জিয়াউর রহমানের ‘বীর উত্তম’ খেতাব ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন, সেখানে স্পষ্টতই বলেন যে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি বলেন, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। সেইসঙ্গে তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তার মানে পুরো জাতিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বললেও কৌশলগত কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। এরপর ২৫ মার্চ পর্যন্ত দেশ নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে গেছে এবং ২৫ মার্চ মধ্যরাত তথা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে যখন তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে গেল, তার আগে তিনি ইপিআর ট্রান্সমিটারের সাহায্যে স্বাধীনতার ঘোষণা সারা দেশে সম্প্রচারের জন্য পাঠিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর ওই স্বাধীনতার ঘোষণার বাণীটি পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্বিশ্ব প্রচার বিভাগ একটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে এবং এর শিরোনাম দেয়া হয়: ‘বঙ্গবন্ধু স্পিকস’।

ঘোষণাটি এরকম: This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved. অর্থাৎ ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত দেশবাসীকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’


ভারতের অমৃতবাজার পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার খবর, ২৭ মার্চ ১৯৭১। ছবি সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালির ওপর নারকীয় গণহত্যা চাপিয়ে দিয়ে ওইদিন মধ্যরাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার আগে তিনি যে স্বাধীনতার ঘোষণাটি লিখে রেখে যান- যেটি এখন বাংলাদেশের সংবিধানেরও অংশ। সেটিই স্বাধীনতার প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং পরদিন এই ঘোষণাটি বেতার মারফত সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল বলেই ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। ২৬ মার্চ যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই অনেক স্থানে পাঠিয়েছিলেন, এ বিষয়ে খ্যাতিমান সাংবাদিক নির্মল সেন লিখেছেন, ‘একটি ঘোষণা ২৬ মার্চ রাতে শেখ সাহেব পাঠিয়েছিলেন বেতার মারফত। ঘোষণাটি ২৬ মার্চ আমাদের থানার ডাকঘরে এসেছিল। আহ্বান এসেছিল শেখ মুজিবের নামেই। আমি নিজের চোখে সে ঘোষণাটি দেখেছি। এ ব্যাপারে ধার করা তত্ত্ব শুনতে বা বুঝতে আমি রাজি নই।’ (নির্মল সেন, মা জন্মভূমি, তরফদার প্রকাশনী, পৃ. ৫২)।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেক তার ‘উইটনেস টু স্যারেন্ডার’ গ্রন্থে (পৃ. ৮৫) লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাতে যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক তখনই পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। সেই কণ্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।’ বাস্তবতা হলো, যদি বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ওই ঘোষণাটি দিতে না পারতেন, তাহলে হয়তো ৭ মার্চ হতো স্বাধীনতা দিবস। বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈদুল হাসান লিখেছেন: ‘৭ মার্চের ভাষণের পরে ঢাকার বাইরে এ কথা রাষ্ট্র হয়ে পড়ে যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন এবং পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতৃত্ব দান করে চলেছেন। (মূলধারা ৭১, ইউপিএল/জানুয়ারি ২০১৬ পৃ. ৪)।

জিয়াউর রহমানের ঘোষণা


গণহত্যা ১৯৭১। ছবি সংগৃহীত

জিয়াউর রহমান এক সাক্ষাৎকারে (বিচিত্রা, ১৯৭২, পৃ. ৪৩) বলেছেন, ‘২৭ মার্চ শহরের চারিদিকে বিক্ষিপ্ত লড়াই চলছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। রেডিও স্টেশনে এলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণার কথা লিখলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘোষণা বেতারে প্রচার হলো।’ মূলত তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও বেতারকর্মী বেলাল মোহাম্মদের সহযোগিতায় পটিয়া হতে এসে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে আসেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় জিয়াউর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেখানে লেখা হয়েছে: মেজর জিয়া ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা মেজর জিয়াকে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন; কিন্তু কী বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আবার তা ছিড়ে ফেলেন। কী জানাবেন তিনি বিশ্ববাসী এবং দেশবাসীকে বেতার মারফত? বেতার কর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিলেন আর পনেরো মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন; কিন্তু পনেরো মিনিট পার হয়ে গেল।

মেজর জিয়া মাত্র তিন লাইন লিখতে পেরেছেন। তখন তার মানসিক অবস্থা বুঝাবার নয়। বিবৃতি লেখায় ঝুঁকিও ছিল অনেক। ভাবতে হচ্ছিল শব্দ চয়ন, বক্তব্য পেশ প্রভৃতি নিয়ে। প্রায় দেড় ঘণ্টা মোসাবিদার পর তিনি তৈরি করেন তার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি। নিজেই সেটা তিনি বাংলা এবং ইংরেজিতে পাঠ করেন। বেতার থেকে পাঠ করা জিয়াউর রহমানের চারটি ভাষণের সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি প্রথম যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, সেটি এরকম: ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। প্রিয় সহযোদ্ধা ভায়েরা, আমি মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রভিশনাল প্রেসিডেন্ট ও লিবারেশন আর্মি চিফ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আবেদন জানাচ্ছি। বাংলাদেশ স্বাধীন। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমেছি। আপনারা যে যা পারেন সামর্থ্য অনুযায়ী অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। আমাদের যুদ্ধ করতে হবে এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে দেশছাড়া করতে হবে। খোদা হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।’


‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইয়ের প্রচ্ছদ। ছবি সংগৃহীত

রফিকুল ইসলাম বীরউত্তমের ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইটিকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বইতে তিনি লিখেছেন: ‘বাঙালিদের হাতে যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য ঘোষণার আহ্বান জানানো হয়। এই ঘোষণাটি চট্টগ্রাম রেডিও ট্রান্সমিটিং সেন্টার কালুরঘাটের (স্বাধীন বাঙলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র) থেকে ২৬ মার্চ বেলা প্রায় আড়াইটায় জাতির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি এম এ হান্নান পাঠ করে শোনান। কালুরঘাটের ১০ কিলোওয়াট শক্তি সম্পন্ন ট্রান্সমিটারটির স্পষ্ট প্রচার ক্ষমতা ছিল প্রায় ৬০ মাইল ব্যাসার্ধ পর্যন্ত। তাই দেশের অবশিষ্ট অংশের জনসাধারণের অধিকাংশই কালুরঘাট ট্রান্সমিটারের এই প্রথম ঘোষণা পরিষ্কারভাবে শুনতে পাননি। রেডিওর এই সীমাবদ্ধতার কারণে ২৬ মার্চ হান্নানের প্রথম ঘোষণা, ২৭ মার্চ মেজর জিয়ার ঘোষণা এবং পরে অপর কয়েকজনের ঘোষণাও স্পষ্টভাবে শোনা যায়নি। এমন কি প্রথম দিন অনেকেই রেডিওর কার্যকর আওতার মধ্যে থেকেও জনাব হান্নানের ভাষণ শুনতে পাননি। কারণ, সাধারণত দুপুর আড়াইটায় অনেকেই রেডিও খোলেন না। তাছাড়া সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে যারা খুলেছিলেন, তারা ঢাকার খবর শোনার জন্যই রেডিওর ঢাকাকেন্দ্র অধীর আগ্রহে শুনছিলেন। বস্তুত সেদিন আমাদের হাতে আদৌ কোন বেতার কেন্দ্র না থাকলেও ইতিহাসের গতিধারা, আপন পথেই চলতো। সমগ্র দেশের বাঙালিরা তখন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে। (রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, ১০৮১/পৃ. ৯১)।


যুদ্ধ চলাকালে রফিকুল ইসলামকে লেখা জিয়াউর রহমানের চিঠি। ছবি: সংগহীত


পরদিন ২৮ মার্চ জিয়াউর রহমান আরেকটি ঘোষণা দেন। যেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনত ঘোষণা করেন। সেটি এ রকম: ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। প্রিয় দেশবাসী, আমি মেজর জিয়া বলছি, মহান জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আমি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আপনারা দুশমনদের প্রতিহত করুন। দলে দলে এসে যোগ দিন স্বাধীনতা যুদ্ধে। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ বিশ্বের সব স্বাধীনতাপ্রিয় দেশের উদ্দেশ্যে আমাদের আহ্বান, আমাদের ন্যায় যুদ্ধের সমর্থন দিন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন। ইনশাল্লাহ বিজয় আমাদের অবধারিত। খোদা হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।’

??????
জিয়াউর রহমানের নির্বাচিত ভাষণ বইতে আরেকটি ইংরেজি ভাষণ উল্লিখিত রয়েছে। সেটি এরকম:
1. I Major Zia, Provisional Commander-in-chief of the Bengal Liberation Army, hereby proclaim, on behalf of Sk. Mujibur Rahman the independence of Bangladesh.
2. I also declare we have already formed a sovereign legal Government under Sk. Mujibur Rahman which pledges to function as per law and the constitution.
3. The new Democratic Government is committed to a policy of non alignment in international relations. It will seek friendship with all nations and strive for international peace.
4. I appeal to all Governments to mobilise public opinion in their respective countries against the brutal genocide in Bangladesh.
5. The Government under Sk. Mujibur Rahman is sovereign legal Government of Bangladesh and is entitled to recognition from all democratic nations of the world

১. আমি মেজর জিয়া বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী প্রধান সেনাপতি শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।
২. আমি ঘোষণা করছি, আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে সার্বভৌম বৈধ সরকার গঠন করেছি। আমরা অঙ্গীকার করছি যে, এই সরকার আইন ও সংবিধান মতে দেশ চালাবে।
৩. এই নতুন গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ থাকবে। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে এই সরকার বন্ধুত্ব কামনা করে এবং বিশ্বশান্তির জন্য কাজ করে যাবে।
৪. আমি সকল সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি তারা যেন বাংলাদেশের বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের দেশের জনমত গড়ে তোলেন।
৫. শেখ মুজিবর রহমানের অধীনে বাংলাদেশ সরকার সার্বভৌম ও বৈধ। এই সরকার বিশ্বের গণতন্ত্রী রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রত্যাশা করে।’
জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ভারতের ‘দি স্টেটস ম্যান’ পত্রিকায় এবং ৩১ মার্চ ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ প্রকাশিত হয়।

জিয়াউর রহমানের এই ঘোষণা নিরস্ত্র সৈনিক এবং সাধারণ জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেয়ার পক্ষে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছিল। এদিন, অর্থাৎ ২৭ মার্চ ডাক্তার আবদুল মান্নান এমপিও জাতির প্রতি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আকুল আবেদন করেন। প্রকৃতপক্ষে রেডিও চালু হয়েছে জানতে পেরে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং সংস্কৃতিকর্মীরা দলে দলে এসে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনে স্বাধীনতার পক্ষে গান, কবিতা ও বক্তৃতা দিতে থাকেন। (এম এ হালিম, দৈনিক সংবাদ, ৮ এপ্রিল ১৯৯২)। ৩০ মার্চ সকালে মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র) থেকে আরেকটি ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দিনই দুটি পাকিস্তানি বিমান থেকে গোলাবর্ষণ করে বেতার কেন্দ্রটিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। (ড. আনোয়ারুল ইসলাম, স্বাধীনতার ঘোষণা ও বঙ্গবন্ধু, ১৯৯২, পৃ. ৬৫)।

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক


১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন জিয়াউর রহমান। ছবি সংগৃহীত

বাস্তবতা হলো, বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান, সেটিই স্বাধীনতার মূল ঘোষণা- যার বীজ রোপিত আছে ৭ মার্চের ভাষণে। এর অর্ধ মাসের মাথায় ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার তথা বাংলাদেশের প্রথম সরকার যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে, সেটি হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় ঘোষণা; কিন্তু এই দুটি ঘোষণার মাঝখানে ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমান যে ঘোষণাটি পাঠ করেন, সেটি ওই সময়ে সৈনিকদের ঐক্যবদ্ধ করা তথা অনুপ্রাণিত করতে দারুণ ভূমিকা রেখেছে। যুদ্ধের সময় একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার ঘোষণা ওয়ার স্ট্র্যাটেজিতে (রণকৌশল) দারুণ ভূমিকা পালন করে। যে কারণে জিয়াউর রহমানের এই ভাষণ সাধারণ মানুষকেও সাহস জুগিয়েছে। তারা ভরসা পেয়েছে এই কারণে যে, তারা এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বুঝতে পেরেছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। এটি ছিল বেসামরিক লোকদের যুদ্ধে নেমে যাওয়ার একটি বড় অনুপ্রেরণা।

২০১১ সালে একটি অনুষ্ঠানে প্রয়াত বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানকে স্বীকৃতি দিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খাটো হবেন না। কেননা বঙ্গবন্ধুর স্থান অনেক উপরে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াকে স্বীকৃতি দেয়া হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে চলমান বির্তকের অবসানও হতে পারে। (বিডিনিউজ, ২৯ মার্চ ২০১১); কিন্তু আওয়ামী লীগ এই উদারতাটুকু দেখায়নি। এই ইতিহাসটুকু স্বীকার করে নিলে আওয়ামী লীগের ক্ষতি হতো না এবং স্বাধীনতা অর্ধ শতাব্দী পরে এসেও এরকম একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মতানৈক্য তৈরি হতো না। বরং মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের সব কৃতিত্ব অস্বীকার করে তাকে ‘পাকিস্তানের চর’ বলে আখ্যায়িত করা, তার বীরউত্তম খেতাব প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে বিএনপির সঙ্গে সে যে দূরত্ব তৈরি করেছে এবং যে দূরত্বটি দীর্ঘস্থায়ী রূপ লাভ করেছে একুশে আগস্ট গ্রেনেডে হামলার মধ্য দিয়ে- তার খেসারত এখনো জাতিকে দিতে হচ্ছে।

স্বাধীনতা ঘোষণার এখতিয়ার

মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার ঘোষক ও ঘোষণা পাঠ করা সমার্থক নয়। তাছাড়া একটি জাতির স্বাধীনতার লড়াই কোনো একদিনের ব্যাপার নয়, কোনো একজন মেজরের বেতার-ঘোষণারও ব্যাপার নয়। এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ প্রস্তুতি। ষাটের দশকের শুরু থেকে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে যদি এই কালক্রমিক আন্দোলন না থাকতো, তাহলে ২৬ মার্চে যে কেউ এসে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেই দেশ স্বাধীন হয়ে যেত না। এমনকি আন্দোলনের এই দীর্ঘ ইতিহাস না থাকলে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করে দিলেও দেশ স্বাধীন হতো না। ফলে বিএনপিকেও এই বাস্তবতা ও সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে যে, স্বাধীনতার ঘোষণা যে কেউ দিতে পারেন না বা স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার এখতিয়ার সবার থাকে না। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারোর এই এখতিয়ার ছিল না। এমনকি তাজউদ্দীন আহমদও যদি রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন, তারপরও মানুষ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করত। কারণ তখন পুরো দেশের রাজনীতি ‘মুজিবময়’। সুতরাং জিয়াউর রহমানের মতো একজন মেজরের কথায় বা ঘোষণায় সাত কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, এটা যেমন হাস্যকর, তেমনি জিয়ার ওই ঘোষণার যে কোনো তাৎপর্য নেই বা তিনি যে ঘোষণা দেননি, এমনকি তাকে ‘বাই চান্স মুক্তিযোদ্ধা’ বলা এবং তার বীর উত্তম খেতার প্রত্যাহার করাও হঠকারী রাজনীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

পরিশেষে, বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধ এবং অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দেশের প্রধান দুটি দলের মধ্যে ঐক্য থাকলে কোনো দলই ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করতে পারত না এবং ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতন্ত্র কায়েম না হলে সম্ভবত আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে এমন নির্মম পরিণতিও বরণ করতে হতো না।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ