Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংসদ কতটা অর্থবহ?

Mohshin  Habib

মহসীন হাবিব

রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সংসদীয় গণতন্ত্র শাসনব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য; কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রায় ক্ষেত্রেই নিজস্ব পন্থার মাধ্যমে প্রতিভাত হয়। আফ্রিকা থেকে এশিয়া, ল্যাতিন আমেরিকা থেকে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশর গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা ও তার কার্যকারিতা মসৃণ নয়, এমনকি সেসব দেশের শাসনব্যবস্থা মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এমন ধারায় বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে। পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সামরিক শাসকদের স্বৈরাচারী শাসন শুরু হয়। বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা দিয়ে, পরে তা রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থায় চলে যায়, আবার ১৯৯১ সালে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসে। ফের সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসা জাতির ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের সামরিক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তৎকালীন বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। যদিও তিনি ১৯৮৩ সাল থেকে প্রায় ৮ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হবার পর তার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। সংসদীয় গণতন্ত্র কার্যকর করার উদ্দেশ্যে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তিনি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নেতৃত্ব দেন। তারপর থেকে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চলছে। আইন অনুযায়ী, ৩০০ সদস্য নিয়ে সংসদ গঠিত হয়, যারা একেকটি নির্বাচনি এলাকা থেকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। এর পাশাপাশি নারী সদস্যদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে।

আইন অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে, তাই ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি ছিল একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন, সাংবিধানিক এই প্রয়োজনীয়তা থেকে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল। সেই সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল; কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচন তারা বর্জন করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো জয়ী হয়। নির্বাচন কমিশনের মতে আওয়ামী লীগ প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছে।

নওগাঁ-২ আসনের একজন প্রার্থীর মৃত্যু হওয়ার কারণে ওই আসনে নির্বাচন বন্ধ থাকে, ফলে ২৯৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসন পায়। ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়। তাদের মধ্যে ৫৮ জনই আওয়ামী লীগের সমর্থক। দলীয় সূত্রে জানা গেছে সংরক্ষিত আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্যও আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী দেয়ার চেষ্টা চলেছে। জাতীয় দল পায় ১১টি আসন। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং ওয়ার্কার্স পার্টি পায় একটি করে আসন। এক সময় বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ কল্যাণ পার্টিও একটি আসনে জয় লাভ করে। জাতীয় দল আবারও আনুষ্ঠানিক বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের পরিবর্তে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান হয়েছেন জি এম কাদের। এরকম একটা গুঞ্জন ছিল যে, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা বিরোধী দল গঠন করতে পারেন। যাই হোক, এরকম কিছু ঘটেনি। কেন ঘটেনি, তা এখন সবার কাছে পরিষ্কার। প্রায় সব স্বতন্ত্র-সাংসদই ক্ষমতাসীন দলের লোক। তারা আওয়ামী লীগেরই বিভিন্ন কমিটিতে কাজ করেন। বাংলাদেশ সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদে স্বাধীন ভোটাধিকার সীমিত করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো দলের প্রার্থী তার নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবে না। কোনো দলীয় সংসদ সদস্য তার দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার সংসদীয় আসন হারাবে। এই জটিলতার কারণে সংসদ-সদস্যরা এটাকে আরও জটিল করে তুলতে চাননি। দিন শেষে তাই জাতীয় সংসদের পুনর্নির্বাচিত স্পিকার জাতীয় পার্টিকেই প্রধান বিরোধী দল ঘোষণা করেন।

সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদে বিরোধী দলের গুরুত্ব অপরিসীম। গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বিরোধী দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিরোধী দল ক্ষমতাসীন দলের ওপর নজরদারি রাখে, ভিন্নমত প্রকাশ করে, সরকারের নীতিগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখে এবং নিজেদের মতামত প্রকাশের মধ্য দিয়ে বহুবিধ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে। নানা তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনার মধ্য দিয়ে বিরোধী দল সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশকে সজীব রাখে। প্রয়োজনে তারা বিকল্প প্রস্তাব দেয়। নাগরিকের কণ্ঠস্বর হয়ে কাজ করে তারা। ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে বিরোধী দল এক প্রকার ভারসাম্য আনে। এককেন্দ্রিক ক্ষমতাকে রোধ করে স্বচ্ছতা আনে। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল উপস্থিত থাকলে সরকার যা খুশি তা-ই করতে পারে না। সরকার তার প্রতিটি কাজ ও সিদ্ধান্তের জন্য দায়বদ্ধ থাকে। প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলবৎ রাখার জন্য বিরোধী দলের অবদান অনস্বীকার্য। শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের কাজ হলো জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা। দেশব্যাপী এখন একটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে: আওয়ামী লীগ দ্বারা আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে, মাত্র ১১টি আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি কী এই মহান ভূমিকা পালন করতে সক্ষম? প্রথম সংসদ অধিবেশনের পর বিরোধী দলের নেতা জি এম কাদের বলেছেন যে, ‘সংসদ সদস্যের সংখ্যার বিচারে বর্তমান সংসদে ভারসাম্য রক্ষা হয়নি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দুপক্ষই সমান হবেন। ...তাহলে তাদের মধ্যে সমানে সমানে লড়াই হবে, নিজেদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়াঝাঁটি হবে। সংসদে জনগণের পক্ষে সিদ্ধান্ত হবে। এটাই ছিল সংসদ তৈরি করার উদ্দেশ্য। শুধু লাল নয়, শুধু সবুজ নয়। যদি সরকারি দলকে লাল বলি, তাহলে এ সংসদ লালময়। সবুজটা শুধু ছিঁটেফোঁটা। এ সংসদে সম্পূর্ণ জাতিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। বর্তমান সংসদ জাতিকে কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হবে- তা আশঙ্কার বিষয়।’

সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রায় বাংলাদেশে অনেক চ্যালেঞ্জ। তবু গণতন্ত্রকে একটা স্থির অবস্থায় আনার ব্যাপারে, একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে এখনো দৃঢ়-সংকল্প বর্তমান। গণতন্ত্রের সব শর্তকে একীভূত করে একে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে নীতিনির্ধারকদের, সুশীল সমাজের কুশীলবদের, আন্তর্জাতিক অংশীদারীদের অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য, সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা গড়ে তোলার জন্য, সম্পদ ও সুযোগের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা অপরিহার্য।

অবশেষে একটা কথা বলতে চাই, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সংসদীয় গণতন্ত্র যেমন দরকার তেমনি জটিলতাও অনেক। এগিয়ে যাওয়ার বদলে এসব দেশে প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি হয় বেশি। যদিও সব গণতান্ত্রিক শর্ত পূরণ করা কঠিন। সব পথ এই পথে এক হয় না। তবুও, জাতি ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের সহনশীলতা, বন্ধুর পথ অতিক্রম করার মানসিকতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে এ পথ উৎরে যাওয়ার আশা করা যায়। একদিন হয়তো এ দেশেও গণতান্ত্রিক আদর্শ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।

বঙ্গবন্ধু একদা বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো’ বর্তমান সরকারকে এই বাণী মানতে হবে। তা না হলে, এটা হবে একটা অর্থহীন সংসদ। এখন আমাদের কেবল অপেক্ষা করার পালা আর দেখার সময় ক্ষমতাসীন সরকার তার তুমুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কীভাবে এই সংসদ চালিয়ে নিয়ে যায়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ