রাজনীতিতে নির্বাচনি ইশতেহার কতটুকু কাজে আসে
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনি ইশতেহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যদিও নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কোনো দল ইশতেহার ঘোষণা না-ও করতে পারে; কিন্তু এটি একটি রেওয়াজ। এই ইশতেহার হলো একটি দল সরকার গঠন করলে কী কী কাজ করবে তার প্রতিশ্রুতি, তাদের লক্ষ্য ও নীতি কী হবে তারই একটি ফিরিস্তি। একটি দেশের বড় বড় সব রাজনৈতিক দলই এই ইশতেহার দিয়ে থাকে, অর্থাৎ জনগণকে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানিয়ে দেয়। সে অনুসারে জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থাকে যে, তারা কোন দলের পরিকল্পনাকে সমর্থন করবে। একটি কথা গোড়াতেই বলে রাখা ভালো, পৃথিবীর কোনো ধনী দরিদ্র দেশই নির্বাচনি ইশতেহার কখনোই পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারে না, সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এক্ষেত্রে বাস্তবায়নের উদ্যোগটাই মুখ্য; কিন্তু যদি দেখা যায় একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইশতেহার এক রকম আর সেই দলটি ক্ষমতায় গিয়ে তা ভুলে গিয়ে কাজ করছে উল্টো, তাহলে সেটাকে জাতির সঙ্গে বেইমানির, ওয়াদা ভঙ্গের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ইশতেহারের কোনো মূল্য থাকে না এবং সরকার খেলো হয়ে যায়। সুতরাং নির্বাচনি ইশতেহার কোনো কথার কথা নয়। বাংলাদেশে নির্বাচনি তপশিল অনুসারে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে অংশগ্রহণকারী বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি তাদের ইশতেহার ঘোষণা করেছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে তারাও অবশ্যই ইশতেহার প্রকাশ করত। প্রথমে জাতীয় পার্টি গত ২১ ডিসেম্বর এবং নির্বাচনের ঠিক ১০ দিন আগে অর্থাৎ ২৭ ডিসেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২১ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টি ঘোষিত ইশতেহারে তারা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলের কিছু নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছে। যেমন প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, গুচ্ছগ্রাম পথকলি ট্রাস্ট পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা। সেইসঙ্গে অন্যান্য উন্নয়নের চিরাচরিত প্রতিশ্রুতি আছে তাদের ইশতেহারে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যেখানে তারা চেষ্টা করেছেন নতুন কিছু বলার। আওয়ামী লীগকে ইশতেহার ঘোষণায় সতর্ক থাকতে হয়েছে, যদিও কিছু ছোটখাটো ত্রুটি রয়েই গেছে। সে কথায় পরে আসছি। আওয়ামী লীগের এবারের ইশতেহারের স্লোগান ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’। ২০০৮ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে স্লোগান ছিল ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের স্লোগান ছিল, ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, এবং ২০১৮ সালে ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’।
প্রত্যেকটি স্লোগান থেকেই বোঝা যায়, দলের দৃষ্টিভঙ্গি একটু একটু করে পাল্টেছে। এর কারণও পরিষ্কার। অস্বীকার করার উপায় কারোই নেই যে আওয়ামী লীগের এই দীর্ঘ শাসনের সময়কালে গোটা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, সামাজিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মানুষের মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ে হতাশা আছে; কিন্তু তার মানে এই নয় যে ২০০৮ সালের আগের মতো অভাব-অনটন বিরাজ করছে। বিষয়টি আওয়ামী লীগেরও জানা আছে। আর সে কারণেই যে ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে প্রথমেই বলা হয়েছে, ‘দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া’র কথা। তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের অসন্তুষ্টির সবচেয়ে বড় জায়গা হলো সরকারের বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারার ব্যর্থতা। মানুষ মনে করে, প্রশাসনের এত শক্তিশালী শাখা প্রশাখা থাকতেও সিন্ডিকেট ভাঙা যায়নি দুটি কারণে: ১. কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি, ২. কোনো কোনো মহলকে না চটিয়ে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এড়িয়ে চলা।
আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে প্রবেশের ওপর জোর দিয়েছে বেশ বড় গলায়। তার কারণ দেশে আক্ষরিক অর্থেই প্রযুক্তির উন্নয়ন সাধন হয়েছে, বিস্ময়কর বিস্তার ঘটেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ যেমন প্রযুক্তির ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয়েছে, তেমনি সরকারও প্রযুক্তির ব্যবহারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সরকারের সেবামূলক প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে, যদিও সর্বক্ষেত্রে এখনো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সরকারের বিভাগ-দপ্তর-মন্ত্রণালয়ে প্রযুক্তির যাবতীয় সুবিধা সৃষ্টির পরও এর ব্যবহারে রয়েছে নিষ্ঠার অভাব। যেমন বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দপ্তরের ওয়েবসাইট আপডেট থাকে না। কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ে ওয়েব সংযুক্তির পর গত দশ বছরেও আপডেট বা হালনাগাদ করা হয়নি। এটি প্রযুক্তির সাফল্যের আলোর নিচের অন্ধকার! প্রযুক্তিবিদরা ভালো বলতে পারবেন, তবে ব্যক্তিগতভাবে অন্য দশজন মানুষের মতো আমরাও মনে করি, হ্যাকিংয়ের হাত থেকে দেশের তথ্য ও অর্থনীতি রক্ষার নিরাপত্তা এখনো যথেষ্ট নয়। স্মার্ট বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ বিষযটিতে জোর দেয়ার প্রয়োজন হবে।
পারলে ভালো; কিন্তু আওয়ামী লীগের ইশতেহারের সব কিছু আগামী ৫ বছরে পূরণ করতে পারবে বলে মনে হয় না। যেমন অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে নিম্ন আয়ের বা দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সুলভমূল্যে করা। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক ব্যয়, ব্যাপক পরিকল্পনা, আইনের শক্ত প্রতিফলন ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত করা। দেশে এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবীমার পরিস্থিত খুবই নাজুক। যতটুকু আছে, তা পর্যাপ্ত নয় এবং এর আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসা দুরূহ কাজ হবে। ইশতেহারে লক্ষ্য করা গেছে, পরিবার কল্যাণের কথা বলা হলেও পরিবার-পরিকল্পনার কথা উল্লেখ নেই। পরিবার-পরিকল্পনা বাংলাদেশে ঝিমিয়ে পড়েছে। অথচ পরিবার-পরিকল্পনা দেশের অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল। দেশে জনবিস্ফোরণ ঘটছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ ইতিমধ্যেই এক অস্বাভাবিক স্তরে পৌঁছে গেছে। ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আর্থিক খাতে সক্ষমতার প্রধান অন্তরায় খেলাপি ঋণ।
খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থতার জায়গা থেকে পরবর্তী সরকারকে সফলতার জায়গায় পৌঁছাতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে কঠোর হাতে ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। দুই ধরনের ঋণখেলাপি থাকে, ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছাকৃত। এটা শর্ট আউট করার জন্য যে সততা, সাহস ও উদ্যোগ প্রয়োজন তা ক্ষমতায় গিয়ে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কি? সরকার ইচ্ছা করলেই যথেষ্ট সফল হওয়া সম্ভব বলে মনে হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এখন সময়ের দাবি। ব্যাংগুলোকে উদ্বুদ্ধ করে কৃষি যন্ত্রপাতি প্রান্তিক চাষি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। তা ছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সফল হবে না। এক্ষেত্রে অর্থব্যয়ের প্রয়োজন হবে। সেইসঙ্গে স্বচ্ছতা, যার অভাব বাংলাদেশ দীর্ঘকাল ধরে ভোগ করছে।
আওয়ামী লীগের উচিত ছিল নির্বাচনের দশ দিন আগে না দিয়ে আরও আগে ইশতেহার ঘোষণা করা। হয়তো তা রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্য করেনি। তবে একটি সরকার যে ইশতেহার ধরেই শুধু কাজ করে থাকে, তা নয়। নতুন নতুন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে নতুন উদ্যোগও গ্রহণ করতে হয়; কিন্তু ইশতেহারে যে জনসেবার কথা বলা হয় বা বলা হয়েছে, তা যেন পালনে কোনো বিচ্যুতি না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখাও সরকারের কর্তব্যের একটি বিশেষ দিক। আওয়ামী লীগ ইশতেহারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা বলেছে। ‘জবাবদিহি’ এই ছোট্ট শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে সার্বিক উন্নয়নের মন্ত্র। এটা নিশ্চিত করা গেলে আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, ঋণ খেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, অর্থ পাচার থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে মানুষের সেবা প্রদান ও দেশবাসীর আশা পূরণ সম্ভব।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে