হান্টার বাইডেনের দণ্ড ও তৃতীয় বিশ্ব
বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রথম সন্তান হান্টার বাইডেন, যার বয়স এখন ৫৪, ড্রাগ ব্যবহার ও হাত বন্দুক কেনাসহ তিনটি বড় ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তার প্রথম ও দ্বিতীয় অপরাধ ফেডারেল ব্যাকগ্রাউন্ড চেক ফর্মে তার ড্রাগ ব্যবহার সম্পর্কে মিথ্যা বলা। তৃতীয় অপরাধ অবৈধ মাদকে আসক্ত থাকার সময় সঙ্গে বন্দুক রাখা। রায়ের পর মঙ্গলবার তার প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন বলেছেন, ‘আমি এই মামলার ফলাফল মেনে নেব এবং বিচার-প্রক্রিয়ার প্রতিও আমার সম্মান থাকবে।’
বাইডেন বারবার বলেছেন, তিনি তার ছেলের জন্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ব্যবহার করবেন না। ছেলের দোষ তিনি মেনে নিয়েছেন। বাইডেন আরও বলেছেন, ‘যেমন আমি গত সপ্তাহে বলেছিলাম, আমি রাষ্ট্রপতি, তবে আমি একজন বাবাও। আমার স্ত্রী জিল এবং আমি আমাদের ছেলেকে ভালোবাসি।’ হান্টার বাইডেনের কোনো সাজার তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। হান্টার বাইডেনের ২৫ বছর পর্যন্ত জেল এবং ৭৫ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। প্রথমবার অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় তার শাস্তি কিছু কমতে পারে।
ডেভিড চার্লস ওয়েইস একজন আমেরিকান অ্যাটর্নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার স্টেটের আদালতের অ্যাটর্নি হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক মনোনীত হন তিনি। রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন তাকে বহাল রাখেন। বিশেষ কৌঁসুলি ডেভিড ওয়েইস বলেছেন, ‘যদিও আসামির মাদক এবং অ্যালকোহল ব্যবহার সম্পর্কে অনেক সাক্ষ্য পাওয়া গেছে, শেষ পর্যন্ত, এই মামলাটি কেবল আসক্তির বিষয়ে ছিল না। এটি এমন একটি রোগ যা হান্টার বাইডেনেরে পরিবারসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবারগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।’
ডেভিড চার্লস ওয়েইস মন্তব্য করেছেন, এই দেশে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এই অপরাধের জন্য অন্য সাধারণ নাগরিক যেরকম অপরাধী, হান্টার বাইডেনও সেরকম। প্রেসিডেন্ট-পুত্র হওয়ার কারণে তার অপরাধ কম-বেশি নয়।
তাদের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমরা যা-ই ভাবি আর বলি না কেন, এটাই পশ্চিমা রাষ্ট্র-প্রাগম্যাটিজমের সৌন্দর্য। সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ৩০ মে, ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প একটি যৌন কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেয়ার জন্য নকল রেকর্ডের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। যা তার ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতির প্রচারণাকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এই দণ্ডাজ্ঞা একটি অসাধারণ নজির, যা আমেরিকান বিচারব্যবস্থার দৃঢ়তাকে ফুটিয়ে তোলে। আগামী নভেম্বরের নির্বাচনেও এর প্রতিফলন হবে নিশ্চিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এটি এ-ই প্রমাণ করে যে, ‘কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়’। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছেলে, ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র, প্রকাশ্যে নেশা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ২০০১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের যমজ কন্যা, জেনা এবং বারবারা বুশ, তারা কম বয়সে মদ্যপানের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তাদের পিতা প্রেসিডেন্ট থাকার সময়।
প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউয়ের (বুশ সিনিয়র) চতুর্থ সন্তান নিল বুশ। রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের ভাই এবং নিল বুশ ১৯৯০ সালে ফেডারেল নিয়ন্ত্রকদের দ্বারা সিলভেরাডো সেভিংস অ্যান্ড লোন নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বোর্ডে কাজ করার জন্য মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন, যা ১৯৮৮ সালে ভেঙে পড়েছিল। রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগানের দত্তক পুত্র মাইকেল রেগান এবং তার প্রথম স্ত্রী জেন ওয়াইম্যান ১৯৮১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হন।
রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের কন্যা অ্যামি কার্টার রাজনৈতিক সক্রিয়তায় জড়িত থাকার কারণে একাধিকবার আইনের মুখোমুখি হয়েছেন। ১৯৮৫ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে দক্ষিণ আফ্রিকান দূতাবাসের সামনে বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়ার জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। তিনি তার পিতার অনুমতি নিয়েই বিক্ষোভে শামিল হয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালে আমহার্স্টের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে সিআইএবিরোধী বিক্ষোভে অ্যামি কার্টার দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার হন।
থিওডোর রুজভেল্টের একটা বিখ্যাত কথা আছে, ‘কোনো মানুষ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এবং এর নিচেও কেউ নেই: আইন মানতে আমরা কারো অনুমতি চাই না, আমরা নিজেরাই এটা মানি।’ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এসব রূপকথার মতো। তৃতীয় বিশ্বে স্বজনপ্রীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, ক্ষমতাবানের সন্তান দেশ বিক্রি করে দিলেও প্রতিবাদ করার অবস্থায় কেউ নেই।
একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবেন, এ দেশে এমনকি ধনী লোকরাও কারাদণ্ড বা জরিমানা ভোগ করেন না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৈশিষ্ট্যই এমন যে, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো সরকারপ্রধান ব্যবস্থা নিতে চাইলে ক্ষমতায় থাকা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। তৃতীয় বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো প্রতিটি সরকার বিচার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেয়। বিচারব্যবস্থা মজবুত না হলে কোনো দেশের অগ্রগতি হয় না, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যায় না। উন্নত বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পার্থক্য। সুশাসনের অভাবে হাজার হাজার মানুষ উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমাচ্ছে।
আমরা জানি, সুশাসনের প্রথম শর্ত হলো সরকার বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন রাখবে। তার হস্তক্ষেপের বাইরে রাখবে। সরকারের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আইনের শাসন নিশ্চিত করা। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একবার বলেছিলেন, ‘আমাদের জাতি তৈরিই হয়েছে আইন দিয়ে। আমরা যদি আশা করি যে, এই আইন যথাযথভাবে কাজ করবে, তাহলে আমাদের অবশ্যই সেই আইনগুলো মানতে হবে।’
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে