আমি আসলে মহাকাব্য লিখতে চাই
সার্বক্ষণিক কবিতায় ডুবে থাকতে চান কবি হানযালা হান, লিখতে চান মহাকাব্য। ছোটবেলায় গাছ হতে ইচ্ছে হতো তার। তিনি বলতে চান, আর্টের মূল হচ্ছে মানুষের আবেগ-অনুভূতি, যা প্রাকৃতিক। তার সঙ্গে কথা বলেছেন ভিউজ বাংলাদেশের সহ-সম্পাদক মাহফুজ সরদার।
ভিউজ বাংলাদেশ: এবারের বইমেলায় আপনার কী বই প্রকাশিত হয়েছে?
হানযালা হান: আমার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। নাম- শূন্য সময়।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার লেখালেখির শুরুর কথা কিছু বলুন। আপনার লেখা কবে প্রথম প্রকাশ হয়?
হানযালা হান: আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার পর। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি কিশোর পত্রিকায়। সে অন্যরকম এক আনন্দ। গ্রামে বেড়ে ওঠা একটি ছেলের লেখা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত। প্রথমে স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। লেখালেখির শুরু এরও তিন-চার বছর আগে। সেসব অবশ্য প্রকাশযোগ্য নয়। বিখ্যাত চিত্রকর্মকে অনুকরণ করে যেভাবে তরুণ শিল্পীরা হাত পাকান, অনেকটা সেরকম। পিরামিড যেমন এক দিনে তৈরি হয়নি। আমার লেখালেখিতে আসার পথটাও তেমন দীর্ঘ। হঠাৎ করে আসিনি। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম- এতে আমি বিশ্বাস করি না। আমি জনপ্রিয় হতে চাই না। লেখালেখিতে আসার সেই দীর্ঘ ভ্রমণের কথাটা আপাতত সিন্দুকে তোলা থাক। আমি মনে করি, শেষ পর্যন্ত আমার কবিতা যদি সত্যিকারের কবিতা না হয়, আমার বাকি সব কথা গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। ফলে আপাতত একটি সত্যিকারের কবিতা লেখার জন্য আমার যে পথ চলা, তা চলতে থাকুক…
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার প্রকাশমাধ্যম কি শুধুই কবিতা?
হানযালা হান: আপাতত কবিতার মধ্যে ডুবে আছি। আরও দুটি দীর্ঘ কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করছি। কবিতা নিয়ে, বিশেষ করে নিজের কবিতা নিয়ে নিজের মধ্যে কিছু প্রশ্ন, খটকা আছে। সেসব আগে দূর করতে চাই। খবরের কাগজে কাজ করার সুবাদে আরও নানা ধরনের লেখা লিখতে হয়, সেসবের কোনো সাহিত্য মূল্য নেই আমার কাছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি কোন মাধ্যম থেকে কবিতার আহরণ করেন? প্রকৃতি নাকি মানুষ থেকে?
হানযালা হান: মানুষ প্রকৃতিরই অংশ, উদ্ভিদ-কীটপতঙ্গ পশুপাখি তথা অন্যান্য প্রাণী যেমন তেমনেই। আলাদা কিছু না। মানুষ নিজেকে প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ভেবে প্রকৃতির সর্বনাশ করেছে। আমি নিজেকে প্রকৃতিরই অংশ বলে মনে করি। ফলে আমি মানুষের চেয়ে বরং প্রকৃতির অন্যান্য উপাদান থেকে শিক্ষা নিতে পছন্দ করি। খুব ছোটোবেলায় আমার ইচ্ছে ছিল, একটা গাছ হওয়ার। জীবিকার দৌড় নেই, কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই, কোনো ধর্ম নেই, রাষ্ট্র নেই, আদালত নেই, সেনাবাহিনী নেই। আঘাত করলেও কেমন নিস্পৃহ। আহা, যদি সত্যি একটা গাছ হওয়া যেত! মহান বলতে যদি কিছু থেকে থাকে তা হচ্ছে এই বৃক্ষদেবতা। তা তো হতে পারিনি। এই না হতে পারা থেকেই আমি কবিতা লিখি। কয়েক বছর ধরে ভাবছি ‘বৃক্ষবন্দনা’ নামে গুচ্ছ কবিতা লিখব।
ভিউজ বাংলাদেশ: কবিতায় আপনি কী বলতে চান?
হানযালা হান: কবিতায় যা বলতে চাই, তা যদি সরাসরি বলেই ফেলি তাহলে আমি মনে করি সেটা কবিতা হিসেবে দুর্বল হবে। আমার কাছে বিশুদ্ধ আর্ট হচ্ছে বাদ্যসংগীতের মতো। ধরা যাক সন্ধ্যার আকাশে এক ঝাঁক পাখি উড়ছে। কথাসাহিত্যিকরা শব্দ দিয়ে এটা খুব সহজে বর্ণনা করতে পারবেন। সংগীত শিল্পীরা গান গেয়ে এটা প্রকাশ করতে পারবেন। নৃত্যশিল্পীরা মুদ্রার সহযোগে তা দেখাতে পারবেন। অঙ্কন শিল্পীরা চিত্রকর্ম এঁকে বোঝাতে পারবেন। চাইলে এ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যাবে; কিন্তু এই দৃশ্যকে বাঁশির সুরে প্রকাশ করা, তবলা বা সেতার বা অন্য কোনো বাদ্যযন্ত্রে প্রকাশ করা, সবচেয়ে কঠিন। কারণ, পাখি-আকাশ-সন্ধ্যা এসব বাদ্য দিয়ে বোঝাতে হবে। কোনো কথা বা বিন্দুমাত্র ইশারা নেই। যদিও সব রকমের শিল্পই অনুকরণ। তবে অনুকরণ হিসেবে তা আয়নার মতো হুবহু দেখা নয়। এটা এক ধরনের রূপান্তর। কাঠ যেমন আগুনের সংস্পর্শে এলে তাপে রূপান্তরিত হয়, তেমন। কবিতায় আমরা দৃশ্য বা অনুভূতির রূপান্তর করতে পারি। ফলে কবিতায় কাঠের কথা হয়তো থাকতে পারে, পাঠক তা পড়ে তাপ অনুভব করবেন কি না, সেই আগুন যিনি বাক্যের মধ্যে আনতে পারেন, তিনিই সত্যিকারের কবি।
ভিউজ বাংলাদেশ: কবিতার পাঠক সবসময়ই কম, এর কারণ কী?
হানযালা হান: শুধু কবিতা না, আর্টের যত মাধ্যম আছে, সব মাধ্যমেই শিল্পকর্মটি যতটা আর্ট হয়ে ওঠে, এর ভোক্তা তত কমে যায়। আর্ট হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে চলচ্চিত্র। অথচ আর্টফিল্ম নামে আলাদা একটা ধরণ তৈরি হয়েছে, এই আর্টফিল্মের ভোক্তাও একেবারে কম। ‘গোলাপ সুন্দরী’ উপন্যাস সব পাঠকের জন্য নয়। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ও সবার জন্য নয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: বর্তমানে কী লিখছেন? কী পড়ছেন?
হানযালা হান: চাকার ওপর বসে আছি। এই ধরনের জীবনযাপন আমার ভালো লাগে না। আমি চাই পাহাড়ের মতো স্থিরতা, গতি এলেও তা জ্যোতিষ্কের মতো হতে হবে। কিন্তু, সময় আমাকে চাকার ওপর বসিয়ে দিয়েছে। কী লিখবো তা খুঁজছি। গত ছয় মাস ধরে ‘মাই দাগেস্তান’ (রাসুল গামজাতভ) পড়ে শেষ করলাম। এখন খুঁজছি ‘দেশে ফেরার খাতা’ (এমে সেজেয়ার) ও ‘আনাবাজ’ (স্য জঁ পার্স) ‘মেটামরফোসিস’ (ওভিদ)। আরো খুঁজছি ‘ঈশ্বরীতলার রূপকথা’ (শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়)।
ভিউজ বাংলাদেশ: এই প্রজন্মের কাদের কবিতা আপনার ভালো লাগে?
হানযালা হান: এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা ঠিক হবে না। অহেতুক বিতর্ক তৈরি হতে পারে। যেনতেনভাবে বিতর্ক তৈরি করে নিজেকে আলোচনায় রাখা আমার অপছন্দ।
ভিউজ বাংলাদেশ: নিয়মিত পাঠ অভ্যাস লেখকদের জন্য কতটা জরুরি?
হানযালা হান: আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আল মাহমুদের একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। শিরোনাম ছিল, ‘লিখতে হলে পড়তে হবে।’ পরে আরও অনেকে হয়তো বলেছেন। বা তার আগেও কেউ বলে থাকতে পারেন। কিন্তু, আমার কাছে কথাটা আল মাহমুদের হয়ে রয়ে গেছে। আমার স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল। নতুন কিছুর নাম, সংখ্যা ভুলে যাই। একবার চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়েছি। হোটেলে উঠেছি। সারাদিন ঘুরে রাতে হোটেলে এসে আর রুম নাম্বার মনে করতে পারিনি। এরকম বহুবার ঘটেছে। তবে কিছু কিছু কথা মনে থাকে। আবার কোনো কোনো মুহূর্তে কোনো কোনো সময় হুবহু মনে পড়ে যায়। ফলে পাঠ অভ্যাস জরুরি যেমন, তেমনি বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ অগোচরে অন্যের শব্দ-ভাব চুপ করে ঢুকে পড়ে আমার লেখায়। ধরতে পারলে বাদ দিই, না পারলে বিপত্তি ঘটে। স্মৃতিবিভ্রমের উৎকৃষ্ট উদাহারণ বিনয় মজুমদার। তিনি শেষ জীবনে রবীন্দ্রসংগীত রচনা করেছিলেন। অনেকে আছেন, না পড়েও লিখতে পারেন। তাদের কথা আলাদা। নতুন কিছু না লিখলে যেমন অস্বস্তি বোধ হয়, তেমনি নতুন কিছু না পড়লেও মনটা বিষণ্ন হয়ে ওঠে। না লিখে, না পড়ে, না হেঁটে খুব বেশি দিন থাকতে পারি না।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার দীর্ঘকবিতার অনুভব ও জার্নি নিয়ে বলুন?
হানযালা হান: এখন মহাকাব্যের যুগ নয়- বলে একটা কথা সমাজে চালু আছে। শুরু থেকেই এই কথাটাকে আমার গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। কিছু দিন আগে বলা হতো- এখন ফিকশনের যুগ। এর পর বলা হচ্ছিল- এখন ননফিকশনের যুগ। বর্তমানে বলা হচ্ছে, এখন টেক্সটের যুগ নয়, ইমেজের যুগ। আমি বলতে চাই, আর্টের মূল হচ্ছে মানুষের আবেগ-অনুভূতি, যা প্রাকৃতিক। যুগ বদলাচ্ছে; কিন্তু প্রকৃতি কিন্তু খুব বেশি বদলাচ্ছে না। প্রকৃতির সব উপাদান আগের মতোই আছে। জীবনযাপনের পদ্ধতি হয়তো বদলাচ্ছে; কিন্তু হাত কাটলে হাজার বছর আগে যেমন রক্ত বের হতো, এখনও বের হয়। এখনো সন্ধ্যার আকাশ আমাদের মুগ্ধ করে। বৃষ্টি নামলে মন আনমনা হয়।
আমি আসলে মহাকাব্য লিখতে চাই; কিন্তু মহাকাব্য লেখার জন্য যে ভাষাভঙ্গি তৈরি করা দরকার, সেজন্য যে সময় ও প্রস্তুতি দরকার, তা আমি পাচ্ছি না। ফলে আমি দীর্ঘ কবিতা লিখে, আমার মহাকাব্য লিখতে না পারার যে- গ্লানি, তা উপশম করার চেষ্টা করছি। আপাতত আমি নতুন একটা ফর্ম দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি, হচ্ছে কি না তা আমি জানি না। আবার এটা একেবারে নতুন বললে কারও কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। আজকাল আমার যে মানসিক অবস্থান, সংক্ষেপে যদি বলি, একটি মহামারি শেষ হয়েছে, অনেকগুলো দেশে যুদ্ধ চলছে, বিভিন্ন দেশে (বাংলাদেশসহ) কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা চেপে বসেছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে, আজকাল মনে হয়- আমি যেন অন্য কোনো সময়ে বসবাস করছি, ক্ল্যাসিক সাহিত্যে যেমন পড়েছি তেমন কোনো সময়ে, মহাকাব্য লেখার এই তো সময়...
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার দীর্ঘ কবিতা কি রিপিটেশন দ্বারা প্রভাবিত?
হানযালা হান: আমি সাক্ষাৎকার দিতে অপছন্দ করি। ভেবেছিলাম এই সাক্ষাৎকারটিও কোনোভাবে এড়িয়ে যাব; কিন্তু এই প্রশ্নটার কারণে এই সাক্ষাৎকারে অংশ নিলাম। কারণ, এই প্রশ্নটা মনে হয়েছে একান্তই আমার জন্য। থাকে না? গৎবাঁধা কিছু প্রশ্ন, অধিকাংশ কবি সাহিত্যিক বা যে কোনো মানুষের জীবনের গল্প তো প্রায় একই রকম। ফলে সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর পক্ষে নতুন প্রশ্ন খুঁজে বের করা অনেক কঠিন। এই প্রশ্নে এসে মনে হচ্ছে, এই সাক্ষাৎকারটি একেবারে আমার জন্য। আমি চাইলেই এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিতে পারি; কিন্তু সেটা নিজের কবিতা নিয়ে ঢোল পেটানো হতে পারে। এই কাজ আমি অপছন্দ করি। আমি শুধু বলব, পুনরাবৃত্তি এড়ানোর জন্য আমি এই পাণ্ডুলিপি লেখার পর পাঁচ বছর ফেলে রেখেছিলাম। এই সময়ে বিরতি দিয়ে দিয়ে বারবার পড়েছি। কতটুকু পুনরাবৃত্তি এড়াতে পেরেছি, এর উত্তর দিতে পারবেন যিনি আমার বই পড়বেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে