আমি সিনেমার মধ্যে কবিতা খুঁজছি, কবিতার মধ্যে সিনেমা
মাসুদ পথিক এ সময়ের আলোচিত কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ চলচ্চিত্রের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তার পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘মায়া: দ্য লস্ট মাদার’ ২০১৯ সালে ৮টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। চলচ্চিত্রকার হিসেবে অধিক পরিচিত অর্জন করলেও প্রথমত, তিনি একজন কবি। তার প্রায় ২৭টি কাব্যগ্রন্থ। ‘একাকী জমিন ’ কবিতাগ্রন্থের জন্য ২০১৩ সালে অর্জন করেন ‘কালি ও কলম এইচএসবিসি ব্যাংক পুরস্কার’। সম্প্রতি নান্দনিক চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ২০২৩ অর্জন করেছেন। তার বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্তি, চলচ্চিত্র নির্মাণ ও লেখালেখি নিয়ে কথা হলো ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সম্পাদক কামরুল আহসান।
ভিউজ বাংলাদেশ: কেমন আছেন কবি?
মাসুদ পথিক: আছি। এক ধরনের থেকে যেতেই হয়। ভালো থাকার চেষ্টার ভেতর দিয়ে, আকাঙ্ক্ষার ভেতর দিয়ে টিকে যেতেই হয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি এবার নান্দনিক চলচ্চিত্র শাখায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করলেন। ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন।
মাসুদ পথিক: অনেক ধন্যবাদ আপনাদেরকে। কল্যাণ হোক সবার।
ভিউজ বাংলাদেশ: পুরস্কার পেয়ে আপনার কেমন লাগছে। আপনি তো মূলত কবি, কিন্তু; বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে।
মাসুদ পথিক: আসলে পদক, পুরস্কারপ্রাপ্তি যদি আমি মূল্যায়ন করতে যাই, এক ধরনের আপেক্ষিকতা থাকে; কিন্তু কবিতা সিনেমা আলাদা করার ব্যাপার আছে কি না, এ বিতর্কে চলে যেতে হবে। আমার কাছে মনে হয়, সত্যিকারের চলচ্চিত্র যেগুলো সেগুলো কবিতাই। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, একটা ঘরকে যদি আপনি সুন্দর করে সাজান, নান্দনিক করে সাজান, তাহলে মানুষ বলে ইটস পোয়েট্রি। মানে কবিতা হয়ে উঠছে সাজানোটা, যা কিছু শেষ পর্যন্ত অন্যরকম সৌন্দর্য গ্রহণ করে তখনই কবিতার সৃষ্টি হয়। তো আপনারা জানেন, আমি যে চলচ্চিত্র করেছি, তার সবই কবিতা থেকে। কবিতার মতোই সেগুলো। আমার কাছে কবিতা ও চলচ্চিত্র আলাদা নয়। আমি এমন ফিল্মমেকারও নই, শুধু বাণিজ্যের জন্য চলচ্চিত্র বানাচ্ছি। আমি চলচ্চিত্রকে ভিন্নভাবে যাপন করি। কবিতার মতো করেই করি। প্রচলিত কথায় যেরকম বলে ফিল্ম হচ্ছে কনটেন্ট, আমি এই শব্দটার ঘোর বিরোধী। সামনে আমার যে চলচ্চিত্রটা মুক্তি পাবে, ‘সোল অব নেচার’ তার কাজ প্রায় শেষ; এখন ফাইনাল মিক্সিং চলছে, ওখানে লিখেছি, ফিল্ম কখনোই কনটেন্ট নয়। ফিল্ম ইজ ফিলোসফিক্যাল কমিটমেন্ট। আমি মনে করি, আমি আসলে কবিতাই করতে এসেছি ফিল্মে। আর এ জন্য আমার ২৭টি কবিতাগ্রন্থ, আর ৩টি ফিচার ফিল্ম, আর ২টি ডুকুমেন্টারি হয়েছে, আরও ৩টি এখন নির্মাণাধীন আছে, সব ফিল্মই কবিতা অবলম্বনে।
ভিউজ বাংলাদেশ: নান্দনিক চলচ্চিত্র, বাংলা একাডেমি পুরস্কার হিসেবে এই ক্যাটাগরিটি নতুন। প্রথমবারই এ ক্যাটাগরিতে আপনি পুরস্কার অর্জন করলেন, এ বিষয়ে কিছু বলুন।
মাসুদ পথিক: আসলে আমার কিছু করার নেই। আমাকে পুরস্কার দিয়েছে, আমার কাছে মনে হয়েছে, নিয়ে নেয়া উচিত, আমি নিয়ে নিয়েছি। আমি প্রত্যাখ্যান করলে কী হবে? হয়তো-বা কবিতায় পেতে পারি; কিন্তু সেটা কবিতায় হলে যা, সিনেমায় হলে তাই-ই। কারণ একটা ভালো চলচ্চিত্র যেমন কালজয়ী হয়, একটা ভালো কবিতাগ্রন্থও কালজয়ী হয়। যেমন, ভিত্তোরিও দে সিকার ‘বাইসাইকেল থিফ’ চলচ্চিত্রটি, যেটা ১৯৪৮ সালে নির্মিত একটা ফিল্ম, সেই ফিল্মটা তো এখনো আমরা কাব্যিকভাবেই দেখি, এতটাই আমরা আলোড়িত হই, এখনো মনে হয় নতুন। কিংবা, ‘পথের পাঁচালী’র কথাই যদি বলি, এটা কি কবিতা নয়? তো আমার ব্যক্তিগত জায়গা থেকে মনে হয়েছে কবিতা ও চলচ্চিত্রকে আলাদা করবার কিছু নেই। এই জন্য হীনম্মন্যতার পরিচয় না দিয়ে আমি গ্রহণ করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে যে, ঠিকই আছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি তো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেলেন, এখন শিল্পের প্রতি দায়িত্ব বোধ করছেন কী রকম? চাপ বোধ করছেন কোনো?
মাসুদ পথিক: নিশ্চয়ই চাপ। চাপ আসলে শুধু পুরস্কারের জন্য নয়। চাপ আমার বরাবরই ছিল। কারণ, আমি সব সময়ই নিজেকে অতিক্রমের চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার প্রথম সিনেমা ছিল ডুকুমেন্টারি, পরে ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ ’ তৈরি করলাম। কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা থেকে এই ছবিটি তৈরি করতে গিয়ে আমি খুব চাপ বোধ করেছি। একটা কবিতাকে চলচ্চিত্রে রূপ দেয়া তো সহজ কথা নয়; কিন্তু, ছবিটি করে আমার মন ভরেনি। মনে হয়েছে এর চেয়ে বেটার কিছু করার দরকার। ‘মায়া: দ্য লস্ট মাদার’ করেছি কবি কামাল চৌধুরীর ‘যুদ্ধ শিশু’ কবিতা থেকে। এটা করতে গিয়েও অনেক চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি; কিন্তু, করার পর মনে হয়েছে, না, যেমন চেয়েছিলাম তেমনটা হয়নি। গল্প বলার বিভিন্ন ন্যারেটিভ আছে, আমি দেখলাম, আমার ওয়েটা শুধু গল্প বলা নয়। আমি একটা ফিউশনাল রূপ দিতে চাই। একটা স্কেলিটন থাকবে; কিন্তু এখানে ডুকুমেন্টারির ব্যাপার থাকবে, এখানে কাব্যিক ব্যাপার থাকবে, ইমেজের খেলা থাকবে। এবং সর্বোপরি পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট থাকবে। হাজার হাজার গল্প হচ্ছে চারপাশে। গল্প বলাটা কেবল বিনোদনের আওতায় চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমি চাই একটা পোয়েটিক ভিশন থাকবে, পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট থাকবে। এটা করতে গিয়ে আমার অনেক চাপ যাচ্ছে। অনেক চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে। আমি তো বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণ করছি না। এগুলো করতে গিয়ে অনেক সংগ্রাম করতে হচ্ছে। ধারদেনা করতে হচ্ছে। বাবার জমি বিক্রি করতে হচ্ছে; কিন্তু আমি ছাড় দিচ্ছি না। আমি দুটোকেই খুঁজে ফিরছি। সিনেমার মধ্যে কবিতা, কবিতার মধ্যে সিনেমা।
ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে তো অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়। আপনি যদিও পুরস্কার পেয়েছেন, পুরস্কার পেলেও আপনার একটা বুদ্ধিবৃত্তিক মন আছে, সে জায়গা থেকে একটু বাইরে থেকে দেখলে এই ব্যাপারটাকে আপনি কীরকম মনে করেন?
মাসুদ পথিক: বাইরে থেকে দেখলে অনেক বড় পার্সপেক্টিভে চলে যেতে হবে। আমাদের দেখতে হবে যে আমরা বিশ্বের কোথায় আছি। প্রায় ২০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটা। সেই বাংলাদেশটার ভৌগোলিক অবস্থান কী? তার পরিসর কী? ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬০ বর্গ কিলোমিটার, এটুকু একটা দেশ, এখানে বাস করে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ৭ গুণ বেশি। এই শহরটাতে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ৯ গুণ বেশি মানুষ বাস করে। তারপর আমাদের রিলিজিয়াস পয়েন্ট অব ভিউ আছে। সেখানেও এক প্রকার প্রতিক্রিয়াশীলতা বিরাজমান। অর্থনৈতিকভাবে আমরা তত শক্তিশালী নই। এই বাস্তবতায় মানুষের প্রকৃতি, মানুষের মূল্যবোধ, মানুষের অন্তর্গত জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, আমাদের মাটি ও পরিবেশের ধারাবাহিকতা বিবেচনা করে সবকিছু মূল্যায়ন করতে হবে। আমরা কিন্তু হীনম্মন্যতায় ভরপুর। যাকে দূর থেকে বড় মানুষ মনে হচ্ছে কাছে গেলে দেখবেন সেও হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত। দু-একজন থাকতে পারে অতিমানব। আমিও সাধারণ মানুষ। তো এরকম একটা দেশে এরকম একটা পুরস্কার নিয়ে কথা হবে না, জটিলতা হবে না তা হয় না। এরকম একটা দেশে পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হবে না, হবে কী? নোবেল পুরস্কার নিয়েও বিতর্ক হয়। বব ডিলান গীতিকবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন এ নিয়েও সমালোচনা হয়েছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: এরকম মনে হয় না যে, অনেক যোগ্য গুণী থাকতে অযোগ্যরা পুরস্কার পেয়ে যাচ্ছে।
মাসুদ পথিক: যোগ্যতা তো আপেক্ষিক। আপনি মনে করেন যে বিবৃতিধর্মী বা স্লোগানধর্মী কবিতাকে ভালো কবিতা মনে করছেন, তার বয়সও ৭৫, মনে হচ্ছে যে তাকে এবার পুরস্কার দেয়া দরকার, এটা তো করুণা, সহানুভূতি। তবে, বাংলা একাডেমি তো একটা প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে নিজস্ব কিছু মেকানিজম থাকে। এখানে আমার কিছু বলার নেই।
ভিউজ বাংলাদেশ: এ বছর কথাশিল্পী জাকির তালুকদার বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিলেন, এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মাসুদ পথিক: এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। এটা মন্তব্য করার বিষয় না। এই এনার্কিজম থাকবেই।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মাসুদ পথিক: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে