নোবেলজয়ী হান ক্যাং
উপন্যাসটি লেখার সময় একটি প্রশ্নের প্রান্তে পৌঁছাতে চেয়েছিলাম, কোনো উত্তর খুঁজিনি
সব জল্পনা-কল্পনা শেষে সাহিত্যে এবার নোবেল পুরস্কার অর্জন করলেন দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান ক্যাং। ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ উপন্যাসের জন্য তিনি ২০১৬ সালে বুকার পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। ‘দ্য ভেজিটারিন’ নিয়ে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন বুকার প্রাইজেস ডট কমকে। সেই সাক্ষাৎকারটির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ প্রকাশিত হলো ভিউজ বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য।
দ্য বুকার প্রাইজেস: শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন হওয়ার পর দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার অর্জন করেছেন আপনি, ২০১৬ সালে। কেমন লাগছে আপনার? এই পুরস্কার আপনার কাছে কী রকম?
হান ক্যাং: ‘দ্য ভেজিটারিয়া ‘ আমি লিখেছিলাম ২০০৩ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে। উপন্যাসটি প্রকাশ করি ২০০৭ সালে। এক দশক পর বুকার পুরস্কার জয় আমার কাছে একটু অদ্ভুত লেগেছিল (ভালো অর্থেই)। বুকার পুরস্কার জয়ের পর থেকে আমার আরও কিছু উপন্যাস বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। এর মধ্যে আছে হিউম্যান অ্যাক্টস, দ্য হোয়াইট বুক এবং গ্রিক পাঠসহ আমার অন্যান্য কাজ। সেইসঙ্গে আমার সাম্প্রতিক উপন্যাস, উই ডু নট পার্ট, বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে বা হচ্ছে। বুকার পুরস্কার পাওয়ার ফলে আমার নানা কাজ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে দেখে আমি আনন্দিত।
দ্য বুকার প্রাইজেস: আপনিই প্রথম কোরিয়ান, যিনি এই পুরস্কার অর্জন করেছেন। আপনি কি মনে করেন আপনি বুকার পাওয়াতে কোরিয়ান সাহিত্যের দিকে মানুষের নজর বাড়বে বা আন্তর্জাতিকভাবে আরও স্বীকৃতি পাবে?
হান ক্যাং: আমি বুকার পুরস্কার পাওয়ার সময় কোরিয়ায় বেশ কয়েকজন চমৎকার কবি ও লেখক ছিলেন। যেমন, কিম হাইসুন। তাদের কাজ ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। কোরিয়ান লেখকদের আরও বেশি কাজ এখন বিদেশি ভাষায় অনুবাদ এবং প্রকাশিত হচ্ছে। এ সময় অবশ্য কোরিয়ান সাহিত্যে কাজ করা অনুবাদকের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ঘটনার ফলে কোরিয়ান সিনেমা এবং পপসংগীতের প্রতিও বিশ্বের মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।
দ্য বুকার প্রাইজেস: ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত আপনার ছোটগল্প 'দ্য ফ্রুট অব মাই ওইম্যান' অবলম্বনে এই আপনি উপন্যাসটি লিখেছেন। একটি ছোটগল্প থেকে উপন্যাস লেখার প্রেরণা আপনার কেন জন্মালো?
হান ক্যাং: ‘দ্যা ফ্রুট অব মাই ওইম্যান’ লেখার পর আমার মনে হলো গল্পটিকে একটু ভিন্নভাবে লিখে দেখি। ভেজিটারিয়ান লেখার আগে আমি আর দুটিমাত্র উপন্যাস লিখেছিলাম। উপন্যাসটির প্রথম অংশটিতে অবশ্য গল্পটির মূল অংশটুকুই ছিল। যেমন, স্বামীই পালন করে কথকের ভূমিকা, নারী চরিত্রটির কথা আংশিকভাবে শোনা যায়। স্বপ্নের মধ্যে সে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে। দুটি গল্পের মধ্যে পার্থক্য হলো অন্ধকার আর আবেগের তীব্রতার মধ্যে এক নারীর জন্ম বা হয়ে ওঠার কাহিনি। ভেজিটারিয়ান আরও বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন। আরও তীব্র বেদনার। ‘দ্য ফ্রুট অব মাই ওইম্যান’-এর মতো এখানে অতিপ্রাকৃত কিছুই ঘটে না। নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যে চরিত্রগুলো তাদের সর্বনাশের দিকে নিমজ্জিত হয়। আরেকটি পার্থক্য হলো উপন্যাসের মূল চরিত্রটির এক বোন আছে, যা আত্মপরিচয়ের আরেকটা দিকে উন্মোচন করে।
দ্য বুকার প্রাইজেস: ২০টির অধিক ভাষায় ভেজিটারিয়ান অনূদিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ভাষার পাঠকদের কি উপন্যাসটি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি? এমন কোনো মন্তব্য কি আপনি পেয়েছেন, যা আপনাকে বিস্মিত করেছে? বিভিন্ন প্রজন্ম বা লিঙ্গের মধ্যে উপন্যাসটির পাঠ-প্রতিক্রিয়া কেমন?
হান ক্যাং: ভিন্ন সংস্কৃতি ও প্রজন্মের মধ্যে একই উপন্যাস নিয়ে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা আনন্দের; কিন্তু যেটা আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছে, তা হলো সাধারণ পাঠকও উপন্যাসটি গ্রহণ করেছেন। সর্বত্রই নারী পাঠকরা উপন্যাসটি বেশি পছন্দ করেছেন।
দ্য বুকার প্রাইজেস: ভেজিটারিয়ান উপন্যাসে একই সঙ্গে আছে সৌন্দর্য ও নিষ্ঠুরতা। এটা এমন এক গল্প যেটা একই সঙ্গে নৃশংস এবং অস্বস্তিকর। শারীরিক ও যৌন-নিপীড়নের সঙ্গে আছে অলঙ্ঘনীয় মৃত্যু-অনুভূতি। মানবজীবনের অন্ধকার দিক নিয়ে লিখতে আপনাকে কী টেনে এনেছে?
হান ক্যাং: উন্যাসের তিনটি অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে আমি পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের একটা দিক উন্মোচন করতে চেয়েছিলাম। যেখানে দুটি বোন কান্নাকাটি করছে: একজন মানব জাতির অংশ হতে চায় না, মাংস খেতে অস্বীকার করে এবং বিশ্বাস করে যে, সে পরিণত হয়েছে এক উদ্ভিদে। আরেক বোন তার বোনকে মৃত্যুর হাত থেকে আটকাতে চায়। এই সংঘাতে সে নিজেকেই তিলে তিলে শেষ করে। উপন্যাসটি লেখার সময় এই একটি প্রশ্নের প্রান্তে পৌঁছাতে চেয়েছিলাম। কোনো উত্তর খুঁজিনি। প্রশ্নটিই আমাকে উপন্যাসটি লিখতে তাড়িত করেছিল। মানুষ হওয়ার অর্থ সম্পর্কে জানতে প্রশ্নগুলোর মধ্যে ঢোকা আমার প্রয়োজন ছিল। আর প্রশ্নগুলোই আমাকে টেনে নিয়ে যায় এক ধরনের তীব্রতা ও দৃশ্যের মধ্যে।
দ্য বুকার প্রাইজেস: আপনি ভেজিটারিয়ান লিখেছেন ২০০৭ সালে। উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে ২০১৫ সালে। অনেক পাঠক মনে করেন উপন্যাসটি কোরিয়ান সমাজের একটি প্রতিচ্ছবি। সমাজের পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক একটি সীমালঙ্ঘনকারী দৃষ্টান্ত উপন্যাসটিতে ফুটে উঠেছে। ১৬ বছর আপনি এটা কীভাবে দেখেন?
হান ক্যাং: আমি একমত যে উপন্যাসটি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টান্তের বিরুদ্ধে পড়া যেতে পারে। তবে আমি মনে করি না যে, এটি কোরিয়ান সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। মাত্রার পার্থক্য থাকতে পারে, তাই বলে কি এটি সার্বজনীন হবে না? আমি বিশেষ করে কেবল কোরিয়ান সমাজেরই প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে চাইনি। ডিগ্রির পার্থক্য থাকতে পারে; কিন্তু তা কি সর্বজনীন হবে না? আমি বিশেষ করে কোরিয়ান সমাজের প্রতিকৃতি তৈরি করতে আসিনি।
দ্য বুকার প্রাইজেস: প্রচলিত বর্ণনামূলক কাঠামোর বিরুদ্ধে দ্য ভেজিটেরিয়ান একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ইয়ং-হাইয়ের গল্পটি তিনজন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে বলা হয়েছে, তার নিজের কণ্ঠস্বর কমই শোনা গেছে। আপনার উপন্যাসের মূল চরিত্রকে কেন এই পদ্ধতিতে তুলে ধরলেন?
হান ক্যাং: ইয়েং-হাই একটি সহজাত এবং শক্তিশালী চরিত্র। নিজেকে বাঁচানোর জন্য সে একটি উদ্ভিদ হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ; কিন্তু অনিবার্য পরিহাস এই যে, তার প্রচেষ্টা তাকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যায়। ইয়েং-হাই সরাসরি কথা বলার পরিবর্তে, আমি অন্যান্য চরিত্রের বর্ণনার মাধ্যমে তাকে দেখাতে চেয়েছিলাম। কীভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করা হয়, ঘৃণা করা হয়, ভুল বোঝা যায়, করুণা করা হয় এবং তা উদ্দেশ্যমূলকও হয়। ভুল বোঝাবুঝি টুকরোগুলো থেকে পাঠক তার চরিত্রের কী সত্য দিক একত্রিত করে সেই মুহূর্তটা আমি কল্পনা করতে চেয়েছিলাম।
দ্য বুকার প্রাইজেস: অনুবাদ হয়েছে এমন কোন তিনটি কোরিয়ান উপন্যাস আপনি পাঠকদের পড়তে বলবেন?
হান ক্যাং: আমি হুয়াং জুঙ্গুনের ‘ওয়ান হান্ড্রেড শ্যাডোস’ পড়তে বলব, ইয়ং ইয়োন-এর অনুবাদে। কিম হাই-জিনের ‘কনসার্নিং মাই ডটার’ পড়তে বলব জেমি চ্যাং-এর অনুবাদে। আর বলব বোরা চুং-এর ‘কার্সড বানি’ পড়তে, অন্তন হুরের অনুবাদে। এই তিনটি উপন্যাস সরাসরি পৃথিবী আর তার মানুষের অন্তরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে