গ্রামবাংলার ছবি আঁকি শৈশবের স্মৃতি থেকে
প্রচ্ছদ এঁকে দেশজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন শিল্পী সমর মজুমদার। আশি-নব্বই দশকের এমন কোনো জনপ্রিয় লেখক নেই, যার বইয়ের প্রচ্ছদ সমর মজুমদার করেননি। খ্যাতিমান এ প্রচ্ছদশিল্পী এক সময় প্রচ্ছদ করা একেবারেই কমিয়ে দেন। তার শিল্পযাত্রা, শিল্পভাবনা, প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে তার সময়কাল, তার বর্তমান দিনকাল- সব মিলিয়ে তার জীবনভাবনা নিয়ে কথা হলো ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কামরুল আহসান ও মাহফুজ সরদার।
ভিউজ বাংলাদেশ: ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। সব মিলিয়ে আপনি কেমন আছেন?
সমর মজুমদার: আছি। খুব ভালো আছি। আঁকাআঁকিতেই দিন চলে যায়।
ভিউজ বাংলাদেশ: প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে প্রচণ্ড খ্যাতিমান হওয়া সত্ত্বেও আপনি হঠাৎ প্রচ্ছদ আঁকা কমিয়ে দিলেন কেন?
সমর মজুমদার: আমি আসলে সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর পুরো সময়টা আমি আমার নিজের মতো কাটাব। আমার মৌলিক যা কাজ, ছবি আঁকা, সেখানে ফিরে যাব। আমি সেটা পেরেছি। এখন পুরো সময়টা ছবি আঁকি। খুব বিশিষ্টজনরা ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা যদি অনুরোধ না করেন, আমি আর বইয়ের প্রচ্ছদ করি না। সারাক্ষণ ছবি আঁকি। প্রদর্শন করি। এতে আমার সময়টা খুব ভালো কেটে যাচ্ছে। আমি পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করছি বলে মনে করি। আমার শিল্পমনের পরিপূর্ণ বিকাশ নিজের ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে করতে পারছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার কতগুলো এক্সিবিশন হলো?
সমর মজুমদার: সলো এক্সিবিশন চারটি। এখনো একটি হচ্ছে, গ্যালারি শিল্পাঙ্গনে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার বেশির ভাগ ছবির বিষয় আবহমান বাংলার রূপ। এটা কেন?
সমর মজুমদার: শৈশবস্মৃতিকে কল্পনা করে আমি এভাবে আঁকার চেষ্টা করি। এটা সবাই জানে। গ্রামবাংলাই আমার প্রিয় বিষয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: এই যে ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো ধারণ করা, এক ধরনের স্মৃতিকাতরতা ফুটিয়ে তোলা, এটা আপনি কবে থেকে করলেন?
সমর মজুমদার: প্রথম থেকেই আমি এভাবে আঁকার চেষ্টা করে আসছি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, আমি যখন ‘নকশাকেন্দ্রে’ চাকরিতে প্রবেশ করি, ওখানে কামরুল হাসান স্যারকে পেয়েছিলাম। কামরুল হাসান স্যার গ্রামবাংলার জীবন নিয়ে ছবি আঁকতেন। বাংলার লোকজ-ঐতিহ্যই ওনার প্রিয় বিষয়। স্যারের অধীনে কাজ করতে গিয়ে আমিও এতে আকৃষ্ট হই। আর নকশাকেন্দ্রের কাজই হলো লোকশিল্পীদের শিল্পকর্ম সংগ্রহ ও গবেষণা। এটা করতে গিয়ে আমি খুব গভীরভাবে এর ভেতরে প্রবেশ করি এবং মনে হলো যে এটা নিয়ে কাজ করলে আমি ভালো করতে পারব। সে জন্য আমি এ বিষয়টা বেছে নিয়েছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি প্রথম প্রচ্ছদ করলেন কবে?
সমর মজুমদার: প্রথম প্রচ্ছদ করেছি ছোটবেলায়; কিন্তু যদি পেশাদারি প্রচ্ছদের কথা বলি, সেটা হবে ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে।
ভিউজ বাংলাদেশ: পেশাদারি প্রচ্ছদের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন? প্রথম কার বই করেছিলেন?
সমর মজুমদার: আমার এক বন্ধু নাঈম হাসান তখন ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডে (ইউপিএল) কাজ করত। ইউপিএল তখন ইংরেজি বই-ই প্রকাশ করত। নাঈমই ইউপিএলকে বাংলা বই প্রকাশ করাতে রাজি করায়। তখন তারা প্রথমে বেছে নেয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে আমি বইগুলোর প্রচ্ছদ করার দায়িত্ব পাই। প্রদোষে প্রাকৃতজনই প্রথম বেরোয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: প্রদোষে প্রাকৃতজন তো বিখ্যাত উপন্যাস এখন। আর উপন্যাসটির বিষয়ও খুব জটিল। ১ হাজার বছর আগে, মুসলমানরা যখন বাংলায় প্রবেশ করেছিল সেই ইতিহাস নিয়ে রচিত। আপনি কীভাবে প্রস্তুতি নিলেন বইটির প্রচ্ছদ করার জন্য?
সমর মজুমদার: শওকত আলীরও সেটা প্রথম উপন্যাস ছিল। আর তখনই তিনি গণ্যমান্য মানুষ। ছোটগল্প লিখে নাম করেছেন। অধ্যাপনা করেন। আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তো লেখক যেভাবে লিখেছেন, সেটা পড়ে, পড়ার পর আরো ভালো করে বোঝার জন্য লেখকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বিষয়টি আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছি। আমারও প্রথম কাজ, আমিও চ্যালেঞ্জ ফিল করেছি। কারণ, আমি জানি, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, প্রাণেশ মণ্ডল ইতোমধ্যেই বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদকে একটা উঁচু জায়গায় নিয়ে গেছেন। প্রচ্ছদকে নন্দনতত্ত্বেরই একটা বিষয় করে তুলেছেন। কাজেই আমাকে যদি বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকতে হয় এঁদের কাছাকাছি বা সমমর্যাদার প্রচ্ছদ আঁকতে হবে। প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসে টেরাকোটা শিল্প নিয়ে একটা বিষয় ছিল, উপন্যাসের এক চরিত্র ছিল টেরাকোটা শিল্পী। আমি ওটাকে বিষয় করেই প্রচ্ছদ করি। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো, প্রদোষে প্রাকৃতজনের জন্য ওই বছরই আমি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পীর পুরস্কার পাই।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনারা যারা তখন প্রচ্ছদ করতেন এখনকার চাইতে ওই সময়টার পার্থক্য ছিল কীকরম?
সমর মজুমদার: তখনো তো কম্পিউটারের সুবিধা ছিল না। সব হাতেই করতে হতো। আর চাররঙা প্রচ্ছদও তখন ছিল না। সেরকম প্রেসও ছিল না। সবই হতো বাই কালারে। প্রদোষে প্রাকৃতজন, চিলেকোঠার সিপাই বাই কালারে করা। বাংলা প্রকাশনা শিল্পও তত উন্নত ছিল না। বছরে আর কতগুলো বই প্রকাশ হতো? শখানেক। এখন তো হাজার হাজার বই বেরোয়। সব কাজ কম্পিউটারেই করা যায়। অনেক সুবিধা। আমরা অনেক খসড়া তৈরি করতাম। অনেক ভাবতাম। লেখক-প্রকাশনদের সঙ্গে বারবার বসতাম। তারপর একটা কিছু দাঁড় করাতাম।
ভিউজ বাংলাদেশ: এখনকার প্রচ্ছদ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
সমর মজুমদার: এখন প্রচ্ছদ দেখে বোঝা যায় না বইটা কীসের? গল্পের বই, কবিতার বই আর উপন্যাসের প্রচ্ছদ একইরকম মনে হয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার কি মনে হয়, প্রচ্ছদে টেক্সটের গুরুত্ব আছে?
সমর মজুমদার: অবশ্যই। প্রচ্ছদ এরকম হতে হবে যেন প্রচ্ছদ দেখেই পাঠক ওই বিষয়বস্তুটাকে পড়ার জন্য আগ্রহী হয়। প্রচ্ছদ একটা মানসিক প্রস্তুতি দিবে। আমাদের অনেক প্রকাশক তো জানেনই না একটা প্রচ্ছদ কীরকম হওয়া উচিত। তারা সুন্দর কিছু আশা করেন; কিন্তু বিষয়টি উপযুক্ত কি না, সেটা বোঝেন না।
ভিউজ বাংলাদেশ: এতে তো পাঠক প্রতারিতও বোধ করতে পারে, টেক্সট আর প্রচ্ছদ না মিললে।
সমর মজুমদার: হ্যাঁ, পাঠক যদি বোদ্ধা হয় তাহলে এটা ধরতে পারবে। তখন নিশ্চয়ই মনোক্ষুণ্ন হবে। তবে, প্রচ্ছদ দেখেই সবাই বই কিনে না। ভেতরের লেখা দেখেই কিনে। অনেক সাধারণ পাঠক, নতুন পাঠক, বিশেষ করে গল্প-উপন্যাস কিনতে গেলে প্রচ্ছদ দেখে আগ্রহী হয়। সে ক্ষেত্রে যদি প্রচ্ছদের সঙ্গে ভেতরের লেখা না মিলে তখন তো আশাহত হবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে আপনি এত বিখ্যাত হবেন সেটা কি ধারণা করতে পেরেছিলেন?
সমর মজুমদার: না, এতদূর আসব সেটা ধারণা করতে পারিনি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি মোট কতগুলো বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন মনে আছে?
সমর মজুমদার: ঠিক মনে নেই। হাজার পাঁচেক বই হবে হয়তো। আর আমি কখনোই তেমন গণহারে প্রচ্ছদ করিনি। সব সময়ই বেছে বেছে করেছি। মানসম্মত বইয়ের প্রচ্ছদ করার চেষ্টা করেছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে আপনার সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কখন ছিল?
সমর মজুমদার: এই তো, নব্বই দশক থেকে ২০০৫-০৭ সাল পর্যন্ত।
ভিউজ বাংলাদেশ: প্রচ্ছদ কমিয়ে দিলেন কেন?
সমর মজুমদার: মনে হলো অনেক বেশি হয়ে গেছে। এক ধরনের ক্লান্তিও এসেছিল। মনে হলো আমার নিজস্ব যে জগৎ, ছবি আঁকা, সেখানে ফিরে যাওয়া উচিত। কারণ, বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা আসলে খুব বেশি স্বাধীনতা নয়। এর একটা নির্দিষ্ট সাইজ আছে, বিষয় আছে, লেখক কী মেজাজে লিখেছেন, সেটা ধরতে হয়, প্রকাশকেরও কিছু দাবি-দাওয়া থাকে, সব সময় যেসব মিলে তাও নয়। এসব ভেবেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমার নিজের ছবি আঁকার দিকে ফিরে যাই।
ভিউজ বাংলাদেশ: কার বই সবচেয়ে বেশি প্রচ্ছদ করেছেন?
সমর মজুমদার: হুমায়ুন আজাদের। তার প্রায় সব বই।
ভিউজ বাংলাদেশ: কেমন ছিল তার সঙ্গে সম্পর্ক?
সমর মজুমদার: খুব ভালো। তিনি তো খুতখুতে মানুষ ছিলেন। প্রচ্ছদ দেখার জন্য আমার বাসাতেই চলে আসতেন। আমার বাচ্চাদের সঙ্গেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল। আসার সময় চকোলেট নিয়ে আসতেন। আমার ছেলেমেয়েরা তাকে তুমি তুমি করেই বলতো।
ভিউজ বাংলাদেশ: এখনো তো কিছু কিছু প্রচ্ছদ করেন? কাদের বইয়ের প্রচ্ছদ করেন?
সমর মজুমদার: অনেক শ্রদ্ধেয় মানুষজন ও বন্ধুদের অনুরোধ ফেলে দিতে পারি না। কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ করি। খুব কম।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার আঁকা ছবি প্রায়ই ফেসবুকে পোস্ট করেন, হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার ছবি, খুব স্মৃতিকাতরতা জাগিয়ে তোলে সেসব। এই স্মৃতিকাতরতায় আপনি কেন আক্রান্ত হলেন?
সমর মজুমদার: আমার শৈশবের গ্রাম আঁকি। ছোটবেলায় যেভাবে গ্রাম দেখেছি, মনের ভেতর যে ছবি আঁকা আছে, সেগুলোই ফুটিয়ে তুলি। আমার ভালো লাগে। আমার মায়ের কথা মনে পড়ে...।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে