নদীর জলে ভাসিয়ে দিলাম একগুচ্ছ ফুল
রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখতে দেখতে আমরা হাঁপিয়ে উঠছিলাম। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, ভয়-আতঙ্ক আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। আমরা দেখেছি ক্ষমতা রক্ষার জন্য কত নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে ক্ষমতাসীনরা। লাশের পর লাশ দেখে আমরা আঁতকে উঠেছিলাম। দেখেছি একটা দেশের শাষণভার কীভাবে এক দুর্বৃত্ত থেকে আরেক দুর্বৃত্ত কেড়ে নিয়ে যায়। দেখেছি কীভাবে দেশপ্রেমের কথা বলে মানুষ দেশদ্রোহী হয়ে ওঠে। দেখেছি ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে কেমন জঘন্য মিথ্যাবাদী হয়ে ওঠে মানুষ। দেখেছি কীভাবে লুটেরা শ্রেণি শত হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিয়ে যায়।
আমাদের বিচারালয়গুলো থেকে ন্যায়বিচার হারিয়েছে বহু আগে। অ্যাবসুলুট জাস্টিস বলতে কিছুই ছিল না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্ঞানচর্চার বিলুপ্তি ঘটেছিল আরও আগে। আমাদের সচিবালয়, সামাজিক-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দুর্বৃত্তায়নের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। আমাদের সংবাদপত্র স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছিল আরও বহু আগে। আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সবকিছুতে ঘুণে ধরেছিল। ধর্মপ্রাণের পরিবর্তে আমরা ধর্মান্ধ হয়ে উঠছিলাম। সেবার নামে আমরা লুটপাটকারী হয়ে উঠছিলাম।
আমাদের তরুণ-তরুণীরা অনেকদিন প্রেম-ভালোবাসা ও অভিসারে মেতে উঠতে পারছিল না। শিশুরা মন খুলে হইহুল্লোড় করতে পারছিল না। প্রবীণরা আরও জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল। পার্ক-রেস্তোরাঁ-বিনোদন-পর্যটন স্পটগুলো বন্ধ হয়ে পড়ছিল। আমাদের পৃথিবীতে সব উৎসব বন্ধ হয়ে যায়। ষড়ঋতুকে আমার গলাটিপে হত্যা করেছিলাম।
এসব দেখতে দেখতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিলাম। আমাদের দম বন্ধ হয়ে উঠছিল। বৃষ্টি নামার কথা থাকলেও মানুষের অপতৎপরতা দেখে ফেরত যায়। আমাদের পৃথিবীতে বর্ষাকাল চলেও বৃষ্টি নামছিল না। কথা ছিল আমরা বর্ষামঙ্গলের কবিতা আবৃত্তি করব। গানে গানে মুগ্ধ হব। বর্ষাবন্দনা-বর্ষাউৎসবে মেতে উঠব। বর্ষা দেখতে দেখতে আমাদের নদীমাতৃক দেশের রূপকীর্তন করব। নদীর কাছে ফিরে যাব। শৈশব স্মৃতির কাছে ফিরে যাব।
আমাদের ধর্মীয় বিধানগুলো আরও আগেই কার্যকারিতা হারিয়েছে। ধর্ম-রাজনীতি কোনোটাই আমাদের মুক্তি দিতে পারছিল না। মুক্তি চাওয়ার মতো সব আশ্রয় নাই হয়ে গিয়েছিল। তবুও আমরা সচেতনতা অবলম্বন করিনি। তাই আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি। সব ধ্বংস হয়ে যাক। ধূলিসাৎ হোক সবকিছু। বরং আসুন কিছুক্ষণ ফুলবন্দনা করি, বর্ষাবন্দনা করি, প্রেমবন্দনা করি।
এক বর্ষার বিকেলে বন্ধুরা মিলে সিঁথিপল্লী গিয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে দেখি একটি গোলাপি হলুদ ফুল। ফুলটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কত কিছু ভাবি। কিছু ভাবনা লিখতে পারি আর কিছু হারিয়ে যেতে লাগল। বর্ষায় যখন কোথাও ফুটন্ত ফুল দেখি, ক্যানভাসে ভেসে ওঠে আমার জন্মগ্রামের সেই আঁকাবাঁকা পথ ও মুহুরী নদীর কিনারা, যেখানে শীত-বর্ষা ও বসন্তে শত শত ফুল ফুটত। বিশেষত বর্ষায়, বৃষ্টিভেজা সেই পথ দিয়ে আমরা বন্ধুরা মিলে হাঁটতাম, নদীর কিনারে জানা-অজানা অনেক ফুটন্ত ফুল দেখতাম। ফুল-তো বটেই সবগুলো বৃক্ষ ভিজে থাকত। পাতায় পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা সেকি অপূর্ব। কেউ ফুল কুড়াত, কেউ দেখতে দেখতে হেঁটে যেত। তার মধ্যে গোলাপি হলুদ ফুল আর আনারস ফুলের কথা খুব মনে পড়ে। স্থানীয়দের মতে, দুটি ফুলের মাথায় সাঁপ মুখ দেয়, কখনো কখনো থুথু ফেলে রাখে কিংবা বিষ দিয়ে রাখে, যাতে এই ফুল ছিঁড়তে না পারে। আরেকটি সাদা ফুল ফুটত যার পেছনটা চুষে রস খেতাম।
ফুল, নদী, বর্ষা, বসন্ত, গ্রীস্ম সব মিলেই আমার জন্মগ্রাম আমার কাছে সর্বদাই স্মৃতিমুখর-মুগ্ধময়-স্বর্গময়। আমার সেই জন্মগ্রাম সর্বদাই আমার ক্যানভাসে ভাসতে থাকে। মনে হয় এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর আমার জন্মগ্রাম। বড় হয়ে যখন রবি ঠাকুরের গানটি শুনি ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে; আমি কুড়িয়ে নিয়েছি, তোমার চরণে দিয়েছি।’ আমার মনে হতো ‘পথে পথে’ মানে রবীন্দ্রনাথ আমার গ্রামের সেই পথের কথাই বলছেন। কিংবা ‘মুকুলগুলি ঝরে’ বলতে আমাদের বাড়ির আম গাছের সেই মুকুলের কথাই তিনি বলছেন।
যখন প্রচুর বৃষ্টি-বন্যা হয় মনে পড়ে আমাদের বাড়ি যাওয়ার পথটির কথা। এক পাশে বিশাল এক কৃষ্ণচূড়া, বিশাল বিশাল আম ও নারিকেল গাছ। শাঁ-শাঁ, সোঁ-সোঁ শব্দ। বাঁশবাগানের শব্দ। আমাদের বাড়িতে ছিল প্রচুর আম গাছ। আমের মুকুল পড়ে থাকতো সারা বাড়িতে। যখন প্রচুর বৃষ্টি হয়, তখন আমাদের গ্রামের বৃষ্টির দৃশ্য ভেসে ওঠে। আমাদের ঘরের চালের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে আমাদের গ্রামের পানিতে টইটম্বুর পুকুরগুলোর দৃশ্য, মুহুরী নদী ও মরা গাঙটির কথা। বর্ষা-বাদলে আমার মনে হয় আমি হাঁটছি সেই আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে একাকি-নীরবে-নিভৃতে। মুহুরী নদীর কিনারায় কিংবা মৃত গাঙের কিনারে হাঁটছি। জানি না আমার সেই গ্রামটি এখন কেমন আছে। বর্ষায় কেমন লাগছে পথের ধার, মুহুরী নদীর কিনারে সাদা হলুদ ফুল ফুটছে কী না। আহা, আমার সেই গ্রাম। আমার চিন্তার ক্যানভাস। ভীষণ মনে পড়ে। মাঝে মাঝে মনে করে অশ্রুপাত করি।
এই অস্থির সময়ে চলুন কিছুক্ষণ প্রেমের কথা বলি। প্রেমের চেয়ে সুন্দর, প্রেমের চেয়ে শাশ্বত, প্রেমের চেয়ে স্নিগ্ধ-স্বচ্ছ ও পবিত্রতম জগতে আর কিছুই নেই। প্রেমিকাকে বলি: আপনার নাকের ওপর আমার নাক, আপনার চোখের ওপর আমার চোখ, আপনার ঠোঁটের ওপর আমার ঠোঁট, আপনার বুকের ওপর আমার মাথা, আপনার হাতের ওপর আমার হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখতে পারতাম। মাঝে-মধ্যে আপনার চুলের ভেতরে আমার মুখটাকে লুকিয়ে রেখে ক্রমেই অস্তিত্বহীন হয়ে যেতে পারতাম। ঘুমে, জাগরণে, সূর্যাস্তে, সূর্যস্নানে, প্রভাতে, মধ্যাহ্নে, নিশিতে, অন্ধকারে-অমাবশ্যায় দেখবেন, কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে আপনার জন্য একগুচ্ছ দোলনচাঁপা নিয়ে সেটা আমি।
ফুটপাতের ধারে আড্ডার সময়, মাঠের মধ্যে খালি পায়ে শিশিরের ওপর হাঁটার সময়, সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য উপভোগের সময়, ড্রিমসের জলে পা ডুবিয়ে সূর্যাস্ত দেখার সময়, রোমের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার সময়, আইফেল টাওয়ার পেছনে রেখে ছবি তোলার সময়, নিউইয়র্ক শহরে হাঁটতে হাঁটতে, দেড়শ কোটি মানুষের শহর দিল্লির অলিগলি হাঁটতে হাঁটতে, খ্রিষ্টজন্মের পূর্বের প্রাচীন রাজধানী ঢাকার পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখবেন, একজন মানুষ আপনার জন্য একগুচ্ছ কদম নিয়ে দাঁড়িয়ে সেও আমি।
আসুন, ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের ঘোরে ভাবতে থাকি একটি প্রেমময় পৃথিবীর। অন্তত একটি দিনের জন্য, একটি বেলার জন্য পৃথিবীটা প্রেমময় হয়ে উঠুক। প্রেমিক-প্রেমিকারা আনন্দে মেতে উঠুক।
প্রপোজ ডে’র দিন আমার প্রেমিকা একটি গন্ধরাজ চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম এই পৃথিবীর সকল গন্ধরাজ তোমার কাছে নিয়ে আসব। শৈশবে যেভাবে শাপলা-শালুক কুড়িয়ে নিয়ে আসতাম। তিনি বলেছিলেন, শাড়ি পরতে ভালোবাসে, আমি নিয়ে এসেছিলাম সবচেয়ে নান্দনিক শাড়িটি। তিনি বলেছিলেন শাহবাগ থেকে একটি ফুল নিয়ে আসতে, আমি গোটা একটা ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছিলাম। অমিতাভ শ্রীদেবীকে যেভাবে ট্রাকভর্তি ফুল পাঠিয়েছিলেন।
তারপর আসুন কিছুক্ষণ ঝড়-বৃষ্টির কথা বলি। ঝড়-বৃষ্টির অনুভূতির সঙ্গে আমাদের চিরকালীন বসবাস। তেরশ নদীর দেশ বাংলাদেশ। নদী, বৃষ্টি, বন্যার সঙ্গে ঐতিহাসিক কাল থেকে লড়াই করতে করতে বেঁচে আছি আমরা।
ছোটবেলায় আমার মনে হতো, এরকম ভয়াবহ ঝড়-বৃষ্টি ও তুফানের মধ্য দিয়ে বুঝি পৃথিবী একদিন ধ্বংস হবে। কেয়ামত কায়েম হবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কতকিছু ভাবতাম। ঝড়ের সেই প্রলয়ংকর রূপ দেখে কত কিছু কল্পনা করতাম। ঝড়, চিৎকার-আহাজারী। গ্রামের যে বিশাল নারিকেল, যে সুপারি গাছ বা বটগাছটিকে দেখতাম, যে বিশাল আম গাছটা এক সকালে দেখি ঝড়ে উপুড় হয়ে গেছে। একদিন দু-দিন ধরে বৃষ্টি। বৃষ্টির পর একটু একটু করে হাওয়া। তারপর সেই হাওয়া ক্রমে বাড়তে থাকে ঢেউয়ের মতো একবার আসে থেমে যায়, আসে থেমে যায়। তারপর প্রচণ্ড জোরে একদিন রাত্রি কিংবা সকালবেলা দুপুরে বা সন্ধ্যাবেলায় শুরু হয় লাগাতার বৃষ্টি।
‘হঠাৎ বৃষ্টি’ ছবির কথা মনে পড়ে। ছবিতে দৃশ্যায়িত বৃষ্টিস্নাত কলকাতা নগরী। বৃষ্টিস্নাত দুপুরে প্রিয়াংকা তার প্রেমিক ফেরদৌসকে খুঁজতে বের হলেন। অদেখা প্রেম। কেউ কাউকে দেখেননি। কথা হতো চিঠিতে। চিঠিতে ফেরদৌস জানালেন, তিনি কলকাতা শহরে থাকেন। তাই প্রেমিককে খুঁজতে কলকাতা শহরে এলেন। প্রথমে গেলেন ফেরদৌসের এক সহকর্মীর কাছে। তিনি জানালেন কলকাতা বিশাল শহর। তা ছাড়া প্রচুর বৃষ্টি, কে কার খবর রাখে। তবুও খোঁজ নিতে ট্যাক্সিতে উঠেন প্রিয়াংকা। সেই ট্যাক্সিচালকই ছিলেন তার প্রেমিক ফেরদৌস; কিন্তু কেউ যে কাউকে চিনে না। অথচ প্রিয়াংকা যাকে খুঁজছেন তিনিই ট্যাক্সিচালক ফেরদৌস তার প্রেমিক। প্রচুর বৃষ্টিতে ভিজে গেলেন দু’জন। ফেরদৌসের অনুরোধে তার বাসায় বিরতি নিলেন। ভিজে যাওয়া প্রিয়াংকার গোসলের পর নতুন একটি শাড়ি পরতে দিলেন ফেরদৌস। শাড়িটি রাজস্থান থেকে তার প্রিয়তমার জন্য কিনেছিলেন তিনি।
কী অসাধারণ ব্যতিক্রম প্রেম, কী ভীষণ বৃষ্টি। যতবার বৃষ্টি হয় ততবার হঠাৎ বৃষ্টি ছবির দৃশ্য আমার চোখে ভাসে। বৃষ্টিস্নাত কলকাতা নগরী ভাসতে থাকে। ভিজে যাওয়া প্রিয়াংকা ভাসে। ভিজে যাওয়া কলকাতা নগরীর অলিগলি ও সড়কগুলো ভাসে। ‘একদিন স্বপ্নের দিন, বেদনার বর্ণবিহীন’ শুনে ঘুমিয়ে পড়ি।
এ কারণে বৃষ্টি নামতে শুরু করলে খুশিতে আমি ভীষণ আত্মহারা হয়ে যাই। বৃষ্টি নামার চেয়ে সুন্দর-নান্দনিক ও এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ অনুভূতির বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা এই পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে স্বচ্ছ-সুন্দর ও নান্দনিক। যেমন স্বচ্ছ চোখের পানি, বৃষ্টির প্রতিটি বিন্দু থেকে স্বচ্ছতা-সৌন্দর্যতা ঝরে ঝরে পড়ে। প্রতিটি ফোঁটা একেকটা অনুভূতি দিয়ে যায়। বৃষ্টির আগমনকে কেন্দ্র করে প্রতিটি বৃক্ষ, প্রতিটি শাখা, প্রতিটি পাতার মতো আমিও সতেজ হতে থাকি। অসম্ভব আনন্দে ভাসতে থাকি। গান শুনি, আবৃত্তি করি কবিতা।
বাদলা দিনগুলোতে উতলা ও মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, নদীর সৌন্দর্য, ঢেউয়ের অপূর্ব মুগ্ধতা দেখতে আমি নগর থেকে বেরিয়ে পড়ি। উপভোগ করি নিশিকালো অন্ধকার। নিজেকে বলি: বাহ, তোমার জন্যই এই আশ্বিনে শ্রাবণ নেমে আসল পৃথিবীর বুকে। তোমাকে আকুল করে তুলতেই শ্রাবণের রাত ও সন্ধ্যা নেমে এলো ধরণীতে। বেলি, দোলনচাঁপা, কামিনী, কাঠগোলাপ, মালতি, জুঁই, যূথিকা, বকুল, গন্ধরাজ, শ্বেতচাঁপা, শ্বেতরঙ্গন, লিলি, রজনীগন্ধা, শাপলা, কুন্দ, শ্বেতকাঞ্চনসহ বর্ষার শ্বেতবসনাগুলো ফুটতে শুরু করলো তোমারই জন্য। তুরাগ নদীর ওপারেই বুঝি কদমগুচ্ছ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তোমার প্রিয়তমা। যেন আমাকে সমাহিত করা হয়েছে আমার বাড়ির সম্মুখে। সমাধির ওপর প্রচণ্ড বৃষ্টি। আশপাশে বেলি, দোলনচাঁপা, কামিনী, কাঠগোলাপ, মালতি, জুঁই, যূথি, বকুলসহ বর্ষার ফুল ফুটে উঠেছে। আর আমার প্রেমিকা সাদা শাড়ি পরে প্রিয় কদমগুচ্ছ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিষণ্ন দেবির মতো। প্রার্থনার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার জন্য।
আরেকদিন, ছুটির দিনে বেরিয়ে পড়ি দুর্গন্ধ ও অসহ্য নগরী ছেড়ে। চলে গেলাম কোনাখোলা, দোহার, নবাবগঞ্জ হয়ে একেবারেই মৈনটঘাট পদ্মাপাড়ে। বৃষ্টি করুণ ধারায় ঝরছে। সারা পথেই বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিলাম। যতই ভিজছি, যতই বৃষ্টি দেখছি ততই মনে হচ্ছিল এর চেয়ে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ অনুভূতি জীবনে আর কিছুই হতে পারে না। এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাই না। অনন্তকাল আমি থেকে যেতে চাই। এই বৃষ্টি, মেঘ, জলোচ্ছ্বাস, বাদলা ও মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই। দুঃখ-ঝরা, জন্ম-মৃত্যু, রোগব্যাধি কিছুই চাই না আমি। প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর মনে হয়েছিল। সিএনজির দরজা দিয়ে হাত মেলে দিয়েছিলাম। ভিজতে থাকুক আমার সবকিছু, তাতে কোনো আপত্তি নাই। বৃষ্টি হতে থাকুক সারাদিন-সারারাত। যতই যাচ্ছিলাম সারা পথে পুকুর-ডোবা-জলাশয়। স্বচ্ছ জলের অপূর্বতা, জলের ওপর জল গড়িয়ে পড়ছে, শাপলা-শালুক ফুটে আছে। ইচ্ছে করছিল, নেমে পড়ি। পানিতে মিশে যাই। সাপ, বিচ্ছু, মাছের মতো আমিও পানিতে হারিয়ে যাই। জরাজীর্ণ শহরটির সড়কে সড়কে পানি, পাতায় পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা। হতে থাকুক অবিরাম। পৃথিবীর বুকে স্বচ্ছতা ও স্নিগ্ধতা ফিরে আসুক। দূর হয়ে যাক সকল আবর্জনা। ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যাক জরাজীর্ণ শহর।
ঝুমবৃষ্টি আমার কাছে সর্বদাই মহামহিম। সৃষ্টিকর্তার বিশেষ উপঢৌকন। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন মনে করতেন ‘বৃষ্টি-কুয়াশা সৃষ্টিকর্তার বিশেষ জল।’ বৃষ্টিতে শুধু প্রেম-ভালোবাসা, অভিসার না, সবকিছুই সুন্দর। নদীর দৃশ্য, উঠোনে পানি, পানির স্রোত, কলা গাছের ভেলায় ভেসে যাওয়া সবই সুন্দর। বর্ষা আমাদের আবেগ-অনুভূতি পরিশুদ্ধ করে। ঝুমবৃষ্টি-আষাঢ় ও বাদল দিনে মুগ্ধ হয় নাই কে? কবি, লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, রিকশাচালক, ভ্যানওয়ালা, ঝুপড়িদোকানি, পথচারী সবাই। ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে/আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে’ বলে প্রণয় নিবেদন করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। নজরুলের কাছে তো বর্ষা ‘বাদলের পরী’। তিনি লিখেছিলেন: যাও মেঘদূত, দিও প্রিয়ার হাতে আমার বিরহলিপি লেখা কেয়া পাতে।’
মেঘ-বর্ষা দেখে নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে বেশি বিমোহিত হয়েছিলেন কালিদাস। তাই-তো তিনি লিখতে পেরেছিলেন বর্ষাকাব্য, বিরহকাব্য ‘মেঘদূত’। জীবনানন্দ লিখেছিলেন: এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রুপালি জল কতদিন এসে ধুয়েছে আমার দেহ-বুলায়ে দিয়েছে চুল-চোখের উপরে তার শান্ত-স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে-আবেগের ভরে/ঠোঁটে এসে চুমা দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে।’ হুমায়ূন আহমেদ-তো এক কথা বলে কত মানুষকে কাঁদিয়েছিলেন: ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়।’ আর আমি, সীমান্তের অখ্যাত-ব্যর্থ কবির কাছে আষাঢ়-বর্ষা-বাদল সৃষ্টিকর্তার বিশেষ উপহার। ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে/এসো করো স্নান নবধারাজলে’ এ গানের এত মুগ্ধতা, এত বিমোহিত আমি আর কোনো গানে পাইনি। তাই বৃষ্টির সাথে এ আদি কবির বন্দনা করি।
প্রেম দিয়ে এ লেখাটা শেষ করি। আমার হৃদয়টা কবির হৃদয়। লেখকের হৃদয়। বুদ্ধ ও পবিত্র যিশুর হৃদয়। তো কবি কী চায়? ‘কবি চায় অঞ্জলী, কবি চায় প্রীতি ও সুন্দরের ধ্যান।’ অঞ্জলির জন্য যেমনি করে হাত পাতিয়া থাকে ভক্তবৃন্দ, ঠিক সেভাবে, ঠিক তেমনি করে আপনার ভালোবাসার জন্য হাত পেতে আছি আমি।
এই অন্ধকারময় সন্ধ্যা, এই গোধূলি, এই বৃষ্টি, এই জলোচ্ছ্বাস আমাকে বলে যায় আপনি খুব সুন্দর। কাহলিল জিবরানের মতে ‘আমাদের প্রত্যেকেরই আশ্রয়ের জন্য জায়গা দরকার। আমার আত্মার আশ্রয়স্থল হলো এমন একটা কুঞ্জবন, যেখানে আমি তোমার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি।’ জিবরানের মতো সত্যি আমার একটা আশ্রয় দরকার আপনার কাছে।
আপনি তো জানেন, বংশাই নদীর তীরে আমার বসবাস। যে নদীর ঢেউসমূহ বেদনার্তকে কাঁদাতে থাকে। যে নদীর কল্লোল-স্রোতধারায় হৃদয়ে বারিপাত হয়। মনে হয়, লেবাননের কবি কাহলিল জিবরানের মতো আমিও অসহায়, বেদনার্ত ও রক্তাক্ত। সারাজীবন যিনি দশ বছরের অধিক মেরি হাসকেলের প্রেমে বুঁদ হয়েছিলেন। নিজের স্টুডিওতে লুকিয়ে থাকা ছিল তার অন্যতম প্রিয় অভ্যাস। জিবরান বলতেন, ‘এখন আমি এই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে। এখন আমি অন্য গ্রহের মানুষ।’ যেন আমারই কথা। যেন জিবরানের হৃদয় আমারই হৃদয়। জিবরানের আত্মাই আমার আত্মা। মেরিকে জিবরান লিখেন ‘যখন তুমি সত্যিই কাউকে ভালোবাস, বলো না ঈশ্বর আমার হৃদয়ে, বরং বলো আমি এখন ঈশ্বরের হৃদয়ে। ভালোবাসার আশ্চর্য কোমলতা তোমাকে শেখাবে বেদনার্ত হতে। তুমি সানন্দে রক্তাক্ত হবে। আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে যার জন্য তোমার এত বেদনা, তারই মঙ্গল কামনায় একটু প্রার্থনা করবে।’ জিবরান লিখেছিলেন, ‘ভালোবাসা তোমাকে যেমন রাজমুকুটে ভূষিত করে তেমনি সে তোমাকে ক্রুশবিদ্ধ করে।’
সত্যি, যেন আপনি আমার মেরি। আপনিই আমার কাদম্বরী দেবী, আপনিই আমার ভিক্টোরিয়া, আপনিই আমার নার্গিস, আপনিই আমার মমতাজ। আমি বড়ু চণ্ডীদাস, আপনিই আমার রাজকিনী। তাই আপনারই নামে বাতি জ্বালিয়ে দিলাম। আপনার নাম করে নদীর জলে ভাসিয়ে দিলাম একগুচ্ছ ফুল।
শাহাদাত হোসেন তৌহিদ: তরুণ সাহিত্যিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে