নোবেল পুরস্কার কমিটির ওয়েবসাইট থেকে
মেইল দেখে ভেবেছিলাম অন্য কারও নোবেল পুরস্কারের খবর
আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী জন জোশেফ হোপফিল্ড, ব্রিটিশ-কানাডিয়ান কম্পিউটার বিজ্ঞানী জিওফ্রে হিন্টনের সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ২০২৪ অর্জন করেছেন। নোবেল কমিটি থেকে যখন ফোন আসে জন জোশেফ হোপফিল্ড তখন ই-মেইল চেক করছিলেন। পাশেই বসে ছিলেন তার স্ত্রী মেরি ওয়ালথাম। তখন তারা ছিলেন ইংল্যান্ডের সেলবোর্ন গ্রামের এক কটেজে। নোবেলে কমিটির ফোন পেয়ে জন হোপফিল্ড একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। চার নাম্বার ই-মেইলটি পড়ার আগ পর্যন্ত তিনি আসলে বুঝতেই পারছিলেন না যে, তিনিই এবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। নোবেল কমিটির এডাম স্মিথের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপে জন হোপফিল্ড খুব বড় কিছু প্রশ্ন নিয়ে মোকাবিলা করেছেন। যেমন, কীভাবে মন কাজ করে। বড় সমস্যাগুলোর দিকে কীভাবে আমাদের নজর দেয়া উচিত। মেশিন লার্নিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমাদের ভয় নিয়ে কী করা উচিত এবং তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন জ্ঞানপদ্ধতির আন্তঃসংযোগের দিকে। তার মতে আজকের দুনিয়ায় কেবল একটি বিষয়ে দক্ষ হলে হবে না, বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রযুক্তির যেমন মেলবন্ধ হবে, তার সঙ্গে সমাজতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞানও জরুরি। এডাম স্মিথের সঙ্গে তার সংক্ষিপ্ত টেলিফোন আলাপের লিখিত রূপ প্রকাশ করা হলো ভিউজ বাংলাদেশের পাঠকের জন্য। সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে নোবেল পুরস্কার কমিটির ওয়েবসাইট থেকে।
ফোন বাজলে জন হোপফিল্ডই ফোন ধরেন।
জন হোপফিল্ড: হ্যালো?
এডাম স্মিথ: ওহ, হ্যালো, জন হোপফিল্ড বলছেন?
জন হোপফিল্ড: হ্যাঁ, বলছি।
এডাম স্মিথ: ওহ, হ্যালো, আমার নাম এডাম স্মিথ। আমি নোবেল পুরস্কার ওয়েবসাইট থেকে বলছি। আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য মেরি এই সময়টা ঠিক করেছেন। আমি কি কথা বলতে পারি এখন?
জন হোপফিল্ড: হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।
এডাম স্মিথ: আপনার ফোনের কি স্পিকার অন আছে?
জন হোপফিল্ড: হ্যাঁ, আপনার ওখানে?
এডাম স্মিথ: সব ঠিক আছে। দারুণ। অনেক ধন্যবাদ। প্রথমেই আপনাকে অভিনন্দন জানাই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য।
হোপফিল্ড: ওহ, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।
এডাম স্মিথ : মেরি বলেছেন আপনি আজ হ্যাম্পশায়ারে আছেন।
জন হোপফিল্ড: হ্যাঁ।
এডাম স্মিথ: নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা শোনার জন্য ভালো জায়গাই বটে। আপনি তো এমনিতেই একটু লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করেন।
জন হোপফিল্ড: হ্যাঁ, শহর থেকে একটু দূরে আরকি। হাজারখানেক মানুষের বাস এখানে।
এডাম স্মিথ: এই ব্যস্ততার দিনে আপনাকে একটু নির্জনতা দিবে নিশ্চয়ই।
জন হোপফিল্ড: সালবোর্নে আর কোনো পদার্থবিজ্ঞানী আছেন বলে জানা নেই। তাই খবর একটু আস্তেই ছড়াবে। রাস্তায়ও কোনো মিছিল দেখছি না।
এডাম স্মিথ: আপনি আসলে কীভাবে জানলেন যে আপনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন?
জন হোপফিল্ড: একটু ঠান্ডা লেগেছে। মেরিকে নিয়ে বাইরে ছিলাম। কফি খেলাম। ফিরে এসে ইমেইল চেক করতে বসলাম। দেখি অনেক ই-মেইল। আমি একটু অবাকই হলাম। প্রথম দু-তিনটা পড়ে মনে হলো নোবেল পুরস্কার নিয়ে কিছু। প্রথমে আমি ভাবলাম কেউ বোধহয় নোবেল পুরস্কার পেয়েছে, তাই আমাকে জানাতে চাচ্ছে। ওখানে আমার নামে পরিষ্কার কিছু ছিল না। তৃতীয় ইমেইলটা পড়ে বুঝলাম এটা আমাকেই লেখা হয়েছে। চার নাম্বার ইমেইলটা পড়ার আগ পর্যন্ত আমি আসলে বুঝতেই পারছিলাম না, এটা সত্যিই আমি!
এডাম স্মিথ: ওই টিজারটা আমার ভালো লাগে। আস্তে আস্তে জানানো! কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মেশিন লার্নিং সম্ভবপর করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জন্য এ পুরস্কার দেয়া হয়েছে আপনাদের; কিন্তু আমি যদ্দুর বুঝতে পেরেছি আপনারা মেশিন লার্নিং টুল আবিষ্কার করেননি বরং মস্তিষ্কের অসংখ্য-অজস্র তার থেকে কীভাবে মন উদভূত হয় তা-ই আবিষ্কার করেছেন।
জন হোপফিল্ড: একদম ঠিক। আমার উৎসাহ আসলে এটা দেখা যে কীভাবে মন কাজ করে। আমাদের চিন্তা-চেতনা কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার জন্য আমাদের মনটিকে, মানে মস্তিষ্কটিকে আরও ভালো করে বোঝা দরকার। মস্তিষ্কের তারগুলো একটা বিশাল নেটওয়ার্কের মতো। শুকনো তার না বলে আপনি এগুলো ভেজা তার বলতে পারেন। হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের একটা মিশ্রণ। অনেক আগে থেকেই আমি ধীরে ধীরে এর বিষয়ে আগ্রহী হয়েছি, যে এই মস্তিষ্ক কীভাবে চিন্তার মতো একটা জিনিস উৎপাদন করে। তাই পদার্থবিজ্ঞান থেকে আমার জানাবোঝার আগ্রহ স্নায়ুবিজ্ঞানের দিকে যায়। তারপর এক সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নেটওয়ার্ক, স্নায়ুতন্ত্র ও পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে সংযোগ ঘটে।
এডাম স্মিথ: পদার্থবিজ্ঞানের লেন্স দিয়ে আপনি জীববিজ্ঞানের অনেক প্রশ্নের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। আমি জানতে চাই একজন পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে আপনি একটা গুরুতর সমস্যা কীভাবে চিহ্নিত করেন?
জন হোপফিল্ড: পদার্থবিজ্ঞানের নিজস্ব একটা পদ্ধতি আছে, যা ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আপনি বুঝতে পারবেন কীভাবে সব একসঙ্গে কাজ করে। খণ্ড খণ্ড দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার বদলে ব্যাপক পরিধিতে একে বোঝার সুযোগ আছে। মন কীভাবে কাজ করে, এটা বলে আপনি কোনো সমস্যায় ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। আপনাকে তল থেকেই এটা বুঝতে হবে। আপনি যদি আবহাওয়া নিয়ে কাজ করেন, বাতাসে নাইট্রোজেন অণুগুলোর মিথস্ক্রিয়া কীভাবে কাজ করে না বুঝে আপনি ঝড় কী বুঝতে পারবেন না।
এডাম স্মিথ: হ্যাঁ, আমি জানি মস্তিষ্ক নিয়ে, চেতনা নিয়ে কাজ করার দীর্ঘ ইতিহাস আছে পদার্থবিজ্ঞানের। মস্তিষ্কের কার্যকারিতার সঠিক উত্তর পাওয়ার জন্য ফ্রান্সিস ক্রিক বা ডন গ্লাসারের মতো মানুষেরা অনেক দিন কাজ করেছে, তাই না?
জন হোপফিল্ড: হ্যাঁ, ডন গ্লাসারের কিছু লেখা আমি পড়েছি। তারা কল্পনাপ্রসূত পদার্থবিদ্যা নিয়ে কাজ করেছেন। জীববিজ্ঞান নিয়ে তাদের তেমন ভালো বোঝাপড়া ছিল না। এরকম একটা সর্বসম্মত ধারণা ছিল যে পদার্থবিজ্ঞান দিয়েই সব ভালোভাবে বোঝা যাবে। কিন্তু পরে দেখা গেল মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বুঝতে জীববিজ্ঞানের সহায়তা দরকার। এখন এটা আপনাকে অন্যসব জ্ঞানতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতাতেই বুঝতে হবে। প্রথমে আমি ঠিক বুঝতে পারি নাই; কিন্তু পরে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করি, পদার্থবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন দিকের কিছু মানুষকে এক করি, কিছু নিয়ে কাজ করি আর না করি, কিছু বোঝাপড়ার জন্য যৌথভাবে একত্রিত হই, এটা আমাদের অনেক কিছু বুঝতে সাহায্য করেছে।
এডাম স্মিথ: হ্যাঁ, আপনার এ উদ্যোগ বিভিন্ন জ্ঞানতাত্ত্বিকদের একত্রিত করতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। হপফিল্ড নেটওয়ার্ক মানুষের জন্য একটি বিশাল অগ্রগতি, যা আমাদের আরও সামনের দিকে নিয়ে যাবে, মানুষের নির্দিষ্টকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে বের করে নিয়ে এসে সম্প্রদায়গত চিন্তার দিকে বিকাশ করবে। আমি আপনাকে আরেকটা বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনার সঙ্গে এবার নোবেল-পুরস্কার অর্জন করেছেন জিওফ্রে হিন্টন, তিনি মেশিন লার্নিং নিয়ে খুব উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই ভয় নিয়ে তিনি মত প্রকাশ করতেও সোচ্চার। তো আপনিও কি একইরকম উদ্বেগ বোধ করেন?
জন হোপফিল্ড: হ্যাঁ, অবশ্যই। আমারও তার মতো উদ্বেগ আছে। আপনি তখনই কোনো কিছু নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন হবেন যা হবে অত্যন্ত শক্তিশালী কিন্তু আপনি তা বুঝতে পারবেন না। আপনি বুঝতে পারবেন না এটাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর নিয়ন্ত্রণই যদি করতে হয় তার সম্ভাবনা কী। আপনি সত্যই বুঝতে পারবে না, বোঝাতেও পারবেন না ওগুলো কীভাবে কাজ করে। আপনি হয়তো বলবেন অঙ্কের মতোই তো কাজ করে; কিন্তু এটা কোনো ভালো উত্তর না। আণুবীক্ষণিক পদার্থবিদ্যা কীভাবে আরও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে আমি আরও ভালোভাবে বুঝতে চাই।
এডাম স্মিথ: আপনার কি মনে হয় এ বিষয়ে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি জনসাধারণের মধ্যে কোনো ভালো বার্তা দেবে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণার জন্য এটাই প্রথম নোবেল পুরস্কার।
জন হোপফিল্ড: আমি মনে করি মনের সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য, মন বিষয়টিকে আরও গভীরভাবে তলিয়ে দেখার জন্য, আরো বিস্তৃভাবে গবেষণা করার জন্য এই পুরস্কারটি একটা স্বীকৃতি। এতে হয়তো মানুষ বুঝতে পারবে যে মন জিনিসটা নিউটনিয়ান পদার্থবিজ্ঞানের মতো সরল জিনিস নয়। এর গঠন ও বৈশিষ্ট্য আরও অনেক জটিল। এটা বুঝতে আরও গভীর অনুসন্ধান দরকার। এবং এর জন্য দরকার পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞানের একত্রীকরণ।
এডাম স্মিথ: খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে বলার জন্য ধন্যবাদ। আমাকে শুধু এটা বলে শেষ করতে দিন যে, সেলবোর্নে গিয়ে আপনি নিশ্চয়ই গিলবার্ট হোয়াইট-এর দ্য ন্যাচারাল হিস্ট্রি অব সেলবার্ন সম্পর্কে শুনেছেন।
জন হোপফিল্ড: ও, আপনিও গিলবার্ট হোয়াইট সম্পর্কে জানেন। বাহ! ভালো লাগল শুনে।
এডাম স্মিথ: প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সেলবোর্ন-এর সম্পর্ক এত গভীর, এর আলাদা এক প্রাচীনত্ব আছে। ভালো হলো যে সেলবোর্নে আজ এক নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হলো।
জন হোপফিল্ড: হ্যাঁ। গিলবার্ট হোয়াইট একজন বিচক্ষণ পর্যবেক্ষক ছিলেন।
এডাম স্মিথ: আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আবারও আপনাকে আজকের খবরের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি।
জন হোপফিল্ড: আপনাকে ধন্যবাদ। যখন আমি একেবারে হতভম্ব অবস্থায় এ সময় আমার সাক্ষাৎকার নেয়া নিশ্চয়ই সহজ না।
এডাম স্মিথ: না, খুব ভালোই বলেছেন। খুবই মুগ্ধ হয়েছি আপনার কথা শুনে। আরও দীর্ঘ আলাপের জন্য অপেক্ষা করছি। নিশ্চয়ই আপনার সামনের ব্যস্ততা কাটলে কথা হবে। আবারও ধন্যবাদ।
জন হোপফিল্ড: আচ্ছা, ভালো থাকবেন। বাই বাই।
এডাম স্মিথ: বাই বাই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে