অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারে দৃষ্টান্ত স্থাপন না করলে, আর হবে না!
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সংস্কারের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘ঠুনকো সংস্কার না, লোক দেখানো সংস্কার না, একদম ফান্ডামেন্টাল সংস্কার। এটা এমনভাবে করব আর কেউ পাল্টাতে পারবে না।’ তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ‘আমার একটাই কথা- সংস্কার। সংস্কারে কী কী বিষয় হবে, সেটা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা করেন; কিন্তু সংস্কার না করে যেন নির্বাচন না করি।… এই সুযোগ হারাবেন না।’ তিনি চমৎকার বলেন; কিন্তু তা তিনি বাস্তব অবস্থা বিচার করে বলেন না। তিনি স্বপ্ন দেখেন; কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে হতাশ হন। কেউ যাতে সংস্কার পাল্টাতে না পারে সেই ব্যবস্থা তিনি নেবেন- এই কথাটি বাস্তবতা বিবর্জিত আবেগের কথা।
যে দেশে পবিত্র গ্রন্থ স্পর্শ করে মিথ্যা সাক্ষী দেয়া হয়, সেই দেশে রাজনৈতিক দল বা নেতাদের চুক্তিবদ্ধ সংস্কার ডাস্টবিনে শকুনে খাবে। রাজনৈতিক নেতারা জনসম্মুখে আজ যা জোশে বলে ফেলেন, কাল তা সমালোচনার মুখে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। এই দেশের লোক অকারণে মিথ্যা বলে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের চেহারা দুই রকম- ক্ষমতায় থাকলে এক রকম, ক্ষমতা হারালে আরেক রকম। বাংলাদেশে ভারতের ২৬ লাখ লোকের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আইন উপদেষ্টার সাফ জবাব, ২৬ লাখের কথা যখন বলেছেন তখন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন না। তাই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করে সিদ্ধান্ত নেয়া ড. ইউনূসের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
এইচ এম এরশাদের ভোট চুরির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত তিন জোটের রূপরেখার কথা জনগণ ভুলে গেছে; কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার তা ভুললে শুধু মরীচিকা তৈরি হবে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অঙ্গীকার সমৃদ্ধ তিন জোটের রূপরেখা বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে গলা টিপে হত্যা করেছে। বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯৪ সালে মাগুরায় অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে ভোট কারচুপি এত ব্যাপক হয়েছিল যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ লজ্জায় মাগুরা থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। জামায়াতে ইসলামের ফর্মূলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য গণআন্দোলন শুরু হলে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বললেন, শিশু আর পাগল ছাড়া নিরপেক্ষ লোক নেই। খাঁটি কথা, দেশের পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের দলপ্রীতি দেখলে তাই মনে হয়। ডাক্তার, সাংবাদিক, আইনজীবী, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষমতাসীন দলের দৃষ্টিকটু লেজুড়বৃত্তি খালেদা জিয়ার কথার সত্যতা প্রমাণ করে। তাই সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গণঅভ্যুত্থানের চার্টার তৈরি করার বাসনা অঙ্কুরেই মারা পড়বে, তার স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশের নতুন চার্টারের কী হবে তা বিএনপির মির্জা আব্বাসের মুখে শুনুন, ‘ওদের হাতের, ওদের কলমের কোনো সংস্কার আমরা সহজে মেনে নেব না। সংস্কার যদি করেন, আমরা কারেকশন করব।’
কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অসহায়ত্ব আমাদের হতাশ করে, কারণ গণঅভ্যুত্থানের সকল পক্ষ শুধু একটি ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ- শেখ হাসিনার বিচার, আর আওয়ামী লীগের ধ্বংস; কিন্তু সংস্কারের ক্ষেত্রে ঐক্য নয়। সংস্কারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর শুধু মতভেদের পার্থক্য নয়, ‘মব ভায়োলেন্স’ও সংস্কারের বিরুদ্ধে ‘ক্যান্সার’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইসলামপন্থি দলগুলো ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্র ও সরকার কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং তার সঙ্গে ড. ইউনূসের সংস্কারের সামান্যতম সম্পর্কও থাকবে না। বিএনপি ক্ষমতায় এলেও সংস্কারে গরজ থাকবে না। সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে বিরোধী দলকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার বাসনা কোনো ক্ষমতাসীন দলের থাকে না এবং থাকে না বলেই বিরোধী দলের ওপর করা নিপীড়ন ও নির্যাতনের খেসারত দিয়ে হয় ক্ষমতা হারিয়ে। ক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনের প্রশ্রয়ে শুরু হয় প্রতিশোধ।
এই খেসারত নিশ্চিত জেনেই ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারেকাছেও যায় না। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার দুরভিসন্ধি থেকেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, সংসদকে করেছে অকার্যকর। সংস্কার মানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সুশাসন থাকলে বিরোধী দলের ওপর আইনি-বেআইনি হেনস্তা করা যায় না, চুরি-ঘুষ-দুর্নীতি-সন্ত্রাস হ্রাস পায়; এমন সংস্কার করে সরকারি দল তাদের একচেটিয়া আধিপত্য হারাতে চাইবে কেন?
বাংলাদেশে প্রতিটি রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের কথা বলে, এমনকি ইসলামপন্থি দলগুলোও; কিন্তু একটি দলেরও গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য নেই, গণতন্ত্র তারা বিশ্বাসও করে না। গণতন্ত্রের প্রতি কমিটমেন্ট না থাকায় স্বাধীনতা লাভের ৫৩ বছর পরও কোনো রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা হয় না। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, যে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নেই, সেই রাজনৈতিক দল থেকে দেশ শাসনে গণতন্ত্র প্রত্যাশা করে এই দেশের জনগণ। বাংলাদেশে অনুসৃত গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ক্ষমতায় গিয়ে সকলেই গণতন্ত্র চালায় স্বৈরতন্ত্রের আদলে। সংসদ পরিণত হয় তোষামোদের আড্ডাখানায়, নির্ধারিত দুই মিনিট সময়ের মধ্যে নিজ এলাকার সমস্যার কথা বলতে গিয়ে সাংসদগণ এক মিনিট ব্যয় করেন সংসদ নেতার গুণগান করে।
এভাবে জনগণের মধ্যে হতাশার জন্ম হয়; হতাশার চরম পর্যায়ে জনগণ গণঅভ্যুত্থান ঘটায়, পতন হয় গণতন্ত্র অভিধায় ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকের। গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদের, পতন হয় শেখ হাসিনার। গণতন্ত্রের চর্চা নেই বলেই দলের নেতা হতে কর্মীর ভোট লাগে না, লেখাপড়া করতে হয় না, সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণ দিতে হয় না, শুধু থাকতে হয় দলের শীর্ষ নেতার আশীর্বাদ। এই আশীর্বাদের জন্য শীর্ষ নেতার নামকরণ করা হয় ‘দেশনেত্রী’, ‘জননেত্রী’, ‘পল্লীবন্ধু’ ইত্যাদি। সংস্কার করে দলীয় লোকদের মনের এই কুসংস্কার দূর করার ক্ষমতা কারও নেই।
পৃথিবীতে এমন কোনো সংস্কার নেই, যেই সংস্কার করলে বাংলাদেশ থেকে তোষামোদ ও ব্যক্তিপূজা ওঠে যাবে। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোষামোদ ও ব্যক্তিপূজা এমন একপর্যায়ে পোঁছেছে যে, দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের নীতিবাক্য শোনার জন্যও আমাদের কান খাড়া রাখতে হয়। শুধু বেনজীর নন, এমন নীতিহীন ও অর্থগৃধ্নু লোক আমাদের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যেও অসংখ্য। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সংঘটিত অভ্যুত্থানে প্রশ্ন করার সাহস জেগে উঠেছিল- প্রশ্ন উঠেছিল ঘুষের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অন্ধ দলপ্রীতির বিরুদ্ধে; প্রশ্ন উঠেছিল পুলিশের বিরুদ্ধে, বিচারের বিরুদ্ধে, আমলার বিরুদ্ধে, মিডিয়ার বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে এবং এসব প্রশ্নের মাধ্যমে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়েছিল; কিন্তু জেগে ওঠা প্রশ্নভিত্তিক সংস্কারকে সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ সরকার নেয়নি, অনিয়ন্ত্রিত মব ভায়োলেন্সে তা বিলীন হয়ে গেছে। কী ভীতিকর পরিবেশ! এই সংস্কার করবে কে?
বিএনপির নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার বাবা অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫’ বইটিতে উল্লেখ করেছেন যে, তাকে পাকিস্তান আমলে মিছিলে বেধড়ক পেটানোর সময় সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছিলেন, ‘ক্ষমতায় গেলে তোকে দেখে নেবো’; উত্তরে পুলিশ অফিসার বলেন, ‘স্যার, তখন আপনার হুকুমে আমরা আপনার বিরোধী দলের লোকদের এভাবে পিটাব।’ পুলিশকে সরকারের আজ্ঞাবহ রাখার এই সংস্কৃতির কেউ সংস্কার করবে? করবে না। অন্তর্বর্তী সরকারও এই ক্ষেত্রে অব্যয় ও অক্ষয়, তাই থানায় গিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুলিশকে ধমক দিয়ে এসেছেন। এখন থেকে পুলিশ আর তার আইন মোতাবেক চলবে না, চলবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মৌখিক নির্দেশে। প্রকৃতপক্ষে নিজের পক্ষের জঞ্জাল কেউ সরাতে চায় না। ক্ষমতাসীন দলের অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে হলে পুলিশকে তিনবার ভাবতে হয়। এই অবস্থার পরিবর্তন কি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে পরিলক্ষিত হচ্ছে? অন্তর্বর্তী সরকার দৃষ্টান্ত তৈরি না করলে পরবর্তী সরকারের ভালো-মন্দ বিচারের মাপকাঠি জনগণ পাবে কই?
দেশে যেভাবে বেকুপ মানুষের প্রসার হয়েছে তা দ্বারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। এখন বিভিন্ন অনুভূতির গণজোয়ার। এই গণজোয়ারে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও একাট্টা। তাই স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের মতো মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ জারি করতে সাহস এখন আর কেউ করবেন না; কিন্তু এবার নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়েছে তা এড়িয়ে প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।
এই জাগরণের জন্য দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসকগুলো দায়ী। দুঃখজনক হচ্ছে, নির্বাচনে দুর্নীতিবাজ প্রার্থীদের শুধু দান-খয়রাতে ধর্মপ্রীতি দেখা যায়, ধর্ম পালনে তারা ততটা আন্তরিক নন। এই সব দুর্নীতিবাজ প্রার্থী ও প্রার্থীর দল সংস্কার চায় না, কারণ দুর্নীতিবাজ প্রার্থী না হলে দল মনোনয়ন বাণিজ্য করবে কী করে? তাই সংস্কার করে আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পরিত্যাগ করা শ্রেয় হবে, নতুবা ক্ষমতা নড়বড় হয়ে যেতে পারে। ড. ইউনূসের স্বপ্ন দেখে লাভ নেই, বাংলাদেশে স্বৈরশাসন আর গণঅভ্যুত্থান পাশাপাশি অবস্থান নিয়ে চলতেই থাকবে।
জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে