চট্টগ্রাম বন্দর
অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ করার এখতিয়ার যদি না থাকে তাহলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে
চট্টগ্রাম বন্দরের ৯টি টার্মিনালের মধ্যে একটির পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার যে উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকার নিয়েছে তার সমালোচনা এখন তুঙ্গে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বিশ্বের তুলনায় পিছিয়ে থাকা চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনার ভার পৃথিবীর সেরা কোনো কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে হবে এবং এই ছেড়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা মানুষকে বোঝাতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে বিদেশি কোম্পানিও নির্বাচিত করে ফেলেছে- ডিপি ওয়ার্ল্ড, আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি কোম্পানি। এই কোম্পানির সিইও বা প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে দেশে-বিদেশে ড. ইউনূসের দুইবার সাক্ষাৎ হয়েছে এবং তাদের প্রস্তাবিত কাজ হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের জট কমানো, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা এবং বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র গেটওয়ে হিসেবে এর কার্যকারিতা বাড়ানো।
ড. ইউনূস ডিপি ওয়ার্ল্ড গ্রুপের নির্বাহী প্রধানকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আসুন, চলুন একসঙ্গে এটি বাস্তবায়ন করি’। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু এগোলে চলতি বছরের নভেম্বরে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে কনসেশন চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং চুক্তির পর টার্মিনালটি ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের কথা অনুযায়ী তাদের মেইন ফোকাস হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। ড. ইউনূস খুব আশাবাদী, তার ধারণা বিদেশি কোম্পানির অধীনে চাকরি করলে তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বন্দরে বাংলাদেশিদের চাকরি করার অফুরন্ত সুযোগ তৈরি হবে; কিন্তু বিদেশি কোম্পানির হাতে বন্দর ছেড়ে দেয়া হলে বর্তমানে উক্ত টার্মিনালে কর্মরত এক হাজার লোকের চাকরি থাকবে এমন নিশ্চয়তা দেয়া হলে প্রতিবাদ কম হতো। কোনো কোম্পানির পরিচালনার মালিকানা ও দায়িত্ব পরিবর্তন হলে সচরাচর পুরোনো লোকদের রাখতে চায় না, রাখলেও তারা বর্তমান লোকবলের পুনর্বিন্যাস করে। টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানিটির কাজ হবে- কনটেইনার উঠানো-নামানোর দায়িত্ব পালন করা, উঠানো-নামানোর মাশুল আদায় করা এবং সরকারকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনার প্রতি নির্ধারিত অর্থ প্রদান করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান উল্লেখ করেছে যে, বন্দরের টার্মিনালে কনটেইনার উঠানো-নামানোর দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। বিএনপির অভিমত হচ্ছে- এই জাতীয় কাজের সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত সরকার; কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, সংস্কার সংশ্লিষ্ট সব ধরনের কাজ করার ম্যান্ডেট তাদের রয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার প্রয়োগ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে মতামত প্রদান করছে তাতে শুধু রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্য পরিচালনার কথা উল্লেখ রয়েছে; কিন্তু নির্বাহী কাজের পরিধি নিয়ে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরও শুধু দৈনন্দিন রুটিন ওয়ার্ক করার ম্যান্ডেট ছিল। অদ্ভুত ও অবাস্তব ব্যবস্থা। নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ছিল মাত্র ৯০ দিন; কিন্তু সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকল, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারও দুই বছর থাকবে। তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের যদি রুটিন ওয়ার্কের বাইরে কোনো কাজ করার এখতিয়ার না থাকে তাহলে উক্ত সময়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি অবশ্যই বাধাগ্রস্ত হবে। দেশের স্বার্থে একদিনের জন্যও সরকারের এই প্রতিবন্ধী অবস্থা মেনে নেয়া যায় না। এ নিয়মের দ্রুত সংস্কার দরকার, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারেরও নির্বাচিত সরকারের মতো সব কাজ করার ম্যান্ডেট থাকা দেশের স্বার্থে অপরিহার্য।
চট্টগ্রাম বন্দরে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল আছে এবং এই চারটি টার্মিনালের মধ্যে বড় ও লাভজনক টার্মিনাল হচ্ছে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল। এই টার্মিনালটি বহু আগে থেকেই আধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা সুসজ্জিত। বর্তমানে এই টার্মিনালে কনটেইনার উঠানো-নামানোর দায়িত্ব পালন করছে টেন্ডারের মাধ্যমে কার্যাদেশপ্রাপ্ত একটি দেশীয় কোম্পানি। চট্টগ্রাম বন্দরের ৪৪ শতাংশ কনটেইনার উঠানামা করা হয় এই টার্মিনালের মাধ্যমে; সর্বাধুনিক সরঞ্জামে সুসজ্জিত ও লাভজনক এই টার্মিনালটি বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত তা গভীরভাবে যাচাই করতে হবে, কারণ এই টার্মিনালে পুনরায় অধিক বিনিয়োগের সুযোগ কম। আওয়ামী লীগ আমলেও নাকি এই টার্মিনালটি ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে ছেড়ে দেয়ার কথাবার্তা শুরু হয়েছিল; কিন্তু বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীর বিরোধিতার মুখে আওয়ামী লীগ সরকারকে পিছু হঠতে হয়। তবে পতেঙ্গা টার্মিনালটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সউদি আরবের ‘রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল কোম্পানি লিমিটেড’-কে; কিন্তু তাদের কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। চুক্তি অনুযায়ী তারা কোনো বিনিয়োগ করেনি, সরঞ্জাম সংযোজন করেনি, এমনকি টার্মিনালের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সম্পূর্ণ সক্ষমতাও ব্যবহার করা হচ্ছে না, তাদের ধীরগতির কর্ম সম্পাদন চরম হতাশাব্যঞ্জক। চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব কেন বিদেশি কোম্পানিকে দেয়া হলো তাও রহস্যাবৃত।
মানুষের কল্পনাশক্তি প্রবল- ‘মানবিক করিডোর’, ইন্টারনেট সেবা ‘স্টারলিঙ্ক’ এবং ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে বন্দর ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দেয়ার মধ্যে অনেকেই একটা যোগসূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। বিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কথা বলছেন অনেকে। করিডোর এবং বন্দর পরিচালনার ভার বিদেশিদের হাতে দেয়া হলে নাকি দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। পৃথিবীর গরিব দেশগুলোর আদৌ স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব আছে কিনা সন্দেহ। স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা করার বাসনা থাকলে গদি থাকে না, গদি রাখলে স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব থাকে না। পানামা খালের ওপর দেশের স্বার্বভৌমত্ব আরোপ করতে গিয়ে জেনারেল মানুয়েল নরিয়েগা আমেরিকার রোষানলে পড়েন, সামরিক শাসক নরিয়েগাকে তার নিজ দেশ থেকে আমেরিকার সৈন্যরা অভিযান চালিয়ে ধরে নিয়ে যায়। স্বাধীনচেতা লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের করুণ মৃত্যু বিশ্ববাসী দেখেছে। জ্বালানি তেলের ওপর নিজেদের সিদ্ধান্ত বলবৎ করতে গিয়ে আমেরিকায় শিক্ষা নেয়া ভাতিজার হাতে সউদি বাদশাহ ফয়সলের মৃত্যুবরণ করতে হয়।
অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকাও তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, উদ্বিগ্ন বলেই ডিপি ওয়ার্ল্ডকে তাদের বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দিতে সম্মত হয়নি। তবে ডিপি ওয়ার্ল্ড বন্দর ও লজিস্টিকস উন্নয়নে একটি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি ৪০টিরও অধিক দেশে ৮২টি সামুদ্রিক এবং অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছে। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন ছাড়াও এদের দায়িত্ব দেয়া হলে বন্দরের বিভিন্ন চার্জ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে ব্যবসায়ীরা। তবে এটা সত্য, দুয়েকটি টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানির হাতে থাকলে বন্দরে কাজের গুণগতমান বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
বন্দরে কাস্টম ডিউটি আদায়ের কাজটিও বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা জরুরি। চট্টগ্রাম বন্দরে এমন একটি পরিবেশের উদ্ভব হয়েছে যে, সৎ ব্যবসায়ীরা কাস্টম কর্মচারী-কর্মকর্তার ওপর নাখোশ, কাস্টম কর্মচারী-কর্মকর্তারাও কিছু ব্যবসায়ীকে নিয়ে বিরক্ত। যারা অসৎ ব্যবসায়ী তাদের পছন্দ ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ কর্মচারী-কর্মকর্তা। অসৎ ব্যবসায়ীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি থাকলে বন্দরে সৎ কর্মকর্তা বা কর্মচারীর চাকরি করা কঠিন হয়ে পড়ে। সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়লে তাদের কাজের প্রতি আগ্রহ থাকে না। বন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসহযোগিতায় অসংখ্য ব্যবসায়ীকে বিলম্বে পণ্য ছাড়করণের জন্য বিপুল পরিমাণ ডেমারেজ চার্জ দিতে হয়। দেশে যত্রতত্র অনিয়ম আর অলসতা, ঘুষ আর দুর্নীতি- প্রতিটি সেক্টরই বিদেশিদের হাতে ছেড়া দেয়া দরকার। তবে এই সংস্কার করতে গেলে কোনো সরকারেরই গদি থাকবে না। তাই আপাতত আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি নিউমুরিং টার্মিনাল না দিয়ে নতুন একটি সর্বাধুনিক টার্মিনাল গড়ে তোলার দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে।
জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে