মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রেরণা সৃষ্টি করুক অমর একুশে বইমেলা
শিক্ষাদীক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধির চর্চায় বাঙালি মুসলমান সমাজ যে অনেক পিছিয়ে আছে এটা প্রথম গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন শিখা গোষ্ঠীর লেখকরা। তাই তারা গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি গড়ে তোলেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর ব্যানারে এই আন্দোলনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কাজী আনোয়ারুল কাদীর, আবদুল কাদির, আবুল ফজল প্রমুখ চিন্তাবিদ। তাদের অমোঘ মন্ত্র ছিল- ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’।
বস্তুত বাঙালি মুসলমান সমাজে যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা আচার-বিশ্বাস-সংস্কার, ধর্মান্ধতা, অশিক্ষা এবং পশ্চাৎপদতার মূলোৎপাটন করে তার পরিবর্তে যুক্তিবাদ, ইহজাগতিকতা, মানবতা, বিজ্ঞানমনস্কতা তথা রেনেসাঁর আলোয় তাদের আলোকিত করাই ছিল এই আন্দোলনের ধারক-বাহকদের প্রধান লক্ষ্য। এই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অনুপ্রেরণাতেই ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় তমদ্দুন মজলিস। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে তাদের হাত ধরে। এই ভাষা আন্দোলনই এক সময় আমাদের স্বাধীকার আন্দোলনে রূপ নেয় এবং অর্জিত হয় হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
ভাষা শহীদদের আত্মোৎসর্গের বীরত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতিকে অম্লান রাখতে ১৯৭২ সাল থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বইমেলা। প্রথমে ছোট পরিসরে আয়োজিত হলেও এখন এই গ্রন্থমেলা বিশাল জায়গাজুড়ে অনুষ্ঠিত হয়। এখন পুরো মেলাটি বিশাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অর্ধেকটা দখল করে রাখে। মাসব্যাপী এই বইমেলায় সমবেত হন পঞ্চাশ-ষাট লাখ মানুষ, বই প্রকাশিত হয় চার হাজারের উপরে। বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেই চেতনা মুক্তবুদ্ধির চর্চার প্রেরণা। কিন্তু বইমেলা কি সত্যিই মুক্তবুদ্ধির চর্চার প্রেরণা হিসেবে কাজ করে আমাদের মনে?
গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে বইমেলা কেবল বই প্রকাশের ঘটনাই প্রধান। কেবলই মানুষের সমবেত হওয়া। অন্য আর আট-দশটি মেলার মতোই বইমেলাও পরিণত হয়েছে মানুষের পদচারণার মুখরিত প্রান্তর হিসেবে। কিন্তু বইমেলার যে প্রকৃত মহৎ উদ্দেশ্য- মুক্ত বুদ্ধির মানুষ তৈরি করা- সেটা যেন অনেকটাই বিনষ্ট হয়ে যেতে বসেছে।
আজ আমাদের জাতি এক ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রম করছে। বছরের মাঝামাঝি এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেছে। দেশে এখন নানারকম সংস্কার চলছে। রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে সেই পুরোনো ধ্যান-ধারণা, আচার-সংস্কারই যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। দেশকে পশ্চাৎপদতার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বিশেষ কিছু স্বার্থান্বেষী মহল। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিরাই আবার নানাভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এবার বইমেলা আয়োজনের শুরুতেই বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে ঘটে গেল কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা। কথাসাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ এবং শিশুসাহিত্য পুরস্কার বাতিল করা হলো নানা বিতর্কের কারণে। যে কারণেই এটা ঘটুক, যেভাবেই ঘটুক- বাংলা একাডেমি ও একুশের বইমেলার ইতিহাসে এটা একটা লজ্জাজনক ইতিহাস হয়ে রইল। আমরা চাই এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা আর যেন কখনো না ঘটে।
আমরা চাই আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্র বাড়ুক। আর তাতে অমর একুশে বইমেলা প্রধান প্রেরণা হিসেবে কাজ করুক। জ্ঞান যদি তার সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্র কাটিয়ে না উঠতে পারে, বুদ্ধি থাকবে আড়ষ্ট হয়ে, আর বুদ্ধি আড়ষ্ট হয়ে থাকলে মুক্তি যে ঘটবে না তা তো জানা কথা। মুক্তি অর্জনের প্রথম শর্তই জ্ঞানের অবারিত দ্বার উন্মোচন- একুশের বইমেলা দিয়ে তার সূচনা ঘটুক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে