বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল নির্বাচন
অজ্ঞতাই সমস্যার সূতিকাগার
বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে ‘আওয়ামী লীগপন্থি নীল দল’। কথাটি আমার নয়, বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ এবং আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের। সভাপতি, সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ সব পদেই বিজয়ী হয়েছেন নীল দলের প্রার্থীরা। নীল দলের জয় লাভের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। এই বিজয়ের সঙ্গে এখন জড়ানো হচ্ছে দেশের আর্থিক খাতের লুটপাট, আর লুটপাটের সঙ্গে জড়ানো হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
অনেকের ভাবনা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আওয়ামী লীগপন্থিদের শক্তিশালী অবস্থান দেশের আর্থিক খাতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। ‘আওয়ামী লীগপন্থি’ নীল দলের জয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষেপেছেন রুহুল কবির রিজভী এবং মাহমুদুর রহমান। তাদের ধারণা বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো স্বৈরাচারের কবজায়। বাংলাদেশ ব্যাংকে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে আওয়ামী মুক্ত না করে নির্বাচনে অনুমতি দেয়ার জন্য তারা গভর্নরকে দায়ী করেছেন। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বাইরের প্রেসার ধন্বন্তরির মতো কাজ করে; গভর্নর সঙ্গে সঙ্গে আর কোনো নির্বাচন হবে না বলে ঘোষণা দিয়ে প্যানেল নির্বাচনের বিরুদ্ধে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাউন্সিলের নির্বাচন যে জাতীয় পর্যায়ে এত গুরুত্বপূর্ণ, তা আগে বুঝিনি; কারণ আমিও নব্বই দশকের প্রথমদিকে অফিসার্স কাউন্সিলের নির্বাচিত সভাপতি ছিলাম এবং ছিলাম নীল দল মনোনীত। তখন সবুজ দল ছিল না, ছিল হলুদ দল। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট পরিষদের ১৪ জন নির্বাচিত হন হলুদ দল থেকে, আর আমি একা নীল দল থেকে। কোনো পত্রিকায় আমার নাম আসেনি, কোন রাজনৈতিক নেতা তিরস্কারও করেননি, অভিনন্দনও জানাননি। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল বা সাদা দলের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের নীল বা হলুদ দলের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকায় কোন দলের কোন নেতা আমাদের নির্বাচন নিয়ে খবরও রাখতেন না।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির সমর্থকরা বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘সবুজ’ দলের সৃষ্টি করেছেন এবং নতুন সৃষ্ট সবুজ দল থেকে জয়ী হয়েছেন কেবল অমিতাভ চক্রবর্তী। বিএনপিপন্থিরা বহু বছর আগেও ‘ফোরাম’ নামে এমন একটি তৃতীয় দলের সৃষ্টি করেছিল; কিন্তু বেশি দিন টেকেনি। না টেকার প্রধান কারণ, জাতীয় রাজনৈতিক দলের দলীয় রং গায়ে মেখে সংগঠন করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা খুব বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সংগঠনগুলো জাতীয় পর্যায়ের শ্রমিক দলের অঙ্গসংগঠন হলেও এগুলোর ওপর শ্রমিক দলের চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীল দল এবং হলুদ দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের শ্রমিক সংগঠনগুলো নীল এবং হলুদ দলের তত্ত্বাবধান ও পরামর্শে পরিচালিত হয়। এখন হয়তো সবুজ দলেরও একটি শ্রমিক সংগঠন থাকবে।
বিএনপিপন্থি সবুজ দলের উদ্ভবের আগে নীল দলের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ‘হলুদ দল’। প্রকৃতপক্ষে হলুদ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে নীল দল; কারণ হলুদ দল সৃষ্টির বহুদিন পর নীল দলের উদ্ভব। সবুজ দলের মতো হলুদ দলের বিরুদ্ধেও নতুন ধ্যান-ধারণার কিছু কর্মচারী-কর্মকর্তার বিপ্লবী চেতনায় নীল দলের সৃষ্টি। হলুদ দলের একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে নতুনত্ব আনার ব্রতই ছিল নীল দলের আদর্শ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিটি অফিসে শ্রমিক সংগঠন ছাড়াও আরও কতগুলো সংগঠন রয়েছে- সহকারী পরিচালক ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘অফিসার্স কাউন্সিল’, দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন’, ক্যাশের কর্মকর্তাদের সংগঠনের নামও ‘অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। এসব সংগঠনের বাইরে রয়েছে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লাব’। এ ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিটি অফিসে রয়েছে একটি করে সমবায় সমিতি; ঢাকা অফিসের সমবায় সমিতির রয়েছে কয়েকশ কোটি টাকার মূলধন ও বিনিয়োগ। উল্লিখিত সব সংগঠন ও সমিতি পরিচালিত হয় নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে।
‘বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল’-এর সদস্য হচ্ছে সহকারী পরিচালক থেকে নির্বাহী পরিচালক পর্যন্ত ছয় স্তরের কর্মকর্তা; ডেপুটি গভর্নর এবং গভর্নর সরকার কর্তৃক নিযুক্ত বিধায় তারা কাউন্সিলের সদস্য নন। ‘নির্বাহী পরিচালক’ পদটিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বোচ্চ নিজস্ব পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং একজন নির্বাহী পরিচালক জাতীয় বেতন স্কেলের দ্বিতীয় গ্রেডে বেতন পেয়ে থাকেন। সরকারের সর্বোচ্চ পদ ‘সচিব’ থেকে ‘সিনিয়র সচিব’ করার পর বাংলাদেশ ব্যাংকেও নির্বাহী পরিচালকদের মধ্যে মাত্র তিনটি পদকে সিলেকশন গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। ‘ডেপুটি গভর্নর’দের এক সময় উপযুক্ততা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাহী পরিচালকদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেয়া হতো, সার্চ কমিটির মাধ্যমে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ের রীতি প্রবর্তনের পর এই পদটিতে নিয়োগে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের হস্তক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে মন্ত্রী, সচিব, গভর্নর নিয়োগে সার্চ কমিটির প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় শুধু তাদের অধস্তন ‘ডেপুটি গভর্নর’ পদের জন্য। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রার্থীর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বিবেচনা করা হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকে সব মতাদর্শের কর্মচারী-কর্মকর্তা নিজেদের পরষ্পর সহকর্মী ছাড়া অন্য কিছু ভাবে না। তাই শ্রমিক সংগঠন ব্যতীত কর্মকর্তাদের কোনো সংগঠনই জাতীয় রাজনীতির ধারক-বাহক নয়। যখন শুধু হলুদ দল ব্যতীত আর কোনো দল ছিল না, তখন সব মত ও পথের কর্মচারী-কর্মকর্তা এই হলুদ দলেরই সদস্য ছিল। পরবর্তীকালে সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপনা নিয়ে মতভেদ হলে হলুদ দল থেকে বেরিয়ে আসা কর্মচারী-কর্মকর্তারা গঠন করল নীল দল। এই দুটি দলেই রয়েছে আওয়ামী লীগপন্থি, বিএনপিপন্থি, জামায়াতপন্থি, বামপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি- সবপন্থির মহাসমাবেশ। নির্বাচনের সময় কোনো ভোটার প্রার্থীর রাজনৈতিক আদর্শ বিচার করে ভোট দিয়েছে, এমন প্রমাণ খুব বেশি নেই। তবে জেলা ও ব্যাচভিত্তিক ভোট কাস্ট হয়। ‘সবুজ দল’ অতি সম্প্রতি গঠিত হওয়ার এই দল সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই; কিন্তু এই দল কেবল বিএনপি সমর্থকদের সমন্বয়ে গঠিত হলেও নীল ও হলুদের সব বিএনপি সমর্থকের সমর্থন পাবে না; কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের মধ্যে জাতীয় রাজনীতির আলোকে সংগঠন করার প্রবল ইচ্ছে কখনো দেখা যায়নি। তবুও সবুজ দলের জন্য শুভেচ্ছা রইল।
আইনজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যে জাতীয় রাজনীতির উগ্র প্রকাশ সাধারণ মানুষকে হতাশ করে। দেশের মূল রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করায় পেশাজীবীদের আর পেশাদারিত্ব থাকে না। সমর্থিত দল ক্ষমতায় গেলে পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নেতাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির সীমা থাকে না। দলীয় সরকারের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় এরা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। সংস্থার প্রধান কর্মকর্তাও এদের সমীহ করে থাকেন, নতুবা বিএনপির রিজভী সাহেব ও মাহমুদুর রহমান ভদ্র ভাষায় যেভাবে বর্তমান গভর্নরকে সবক দিয়েছেন, তেমন সবক শুনতে হবে সব নির্বাহী প্রধানকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অরাজনৈতিক সংগঠন ‘নীল দলকে যেভাবে রাজনীতির কালার দিয়ে ধোলাই করা হচ্ছে, তাতে মনে হয় বিএনপি ইতোমধ্যেই জাতীয় নির্বাচনে পরাজয়ের ‘ফোবিয়া’ দ্বারা আক্রান্ত। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকে নয়, বাংলাদেশেও বর্তমানে আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান অস্তিত্ব নেই। আওয়ামী লীগ শিখিয়ে দিয়ে গেছে কীভাবে বিরোধী দলকে মামলার পর মামলা দিয়ে অদৃশ্য করতে হয়। তবে রুহুল কবির রিজভী এবং মাহমুদুর রহমানের কথা শুনে শুদ্ধ অভিযান চালানোর পর নির্বাচন দিলে তা হবে আওয়ামী লীগের ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন। এমন নির্বাচনে বিজয়ের তৃপ্তি থাকলেও নৈতিক জোর থাকে না, সর্বদা একটা অপরাধবোধ কাজ করে, গণঅভ্যুত্থানের ভয় থাকে। তাই শুদ্ধি অভিযান না করে বরং ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার বন্ধ করে সুশাসন নিশ্চিত করাই উত্তম- তাহলেই স্বৈরাচার আর ফ্যাসিস্টদের ‘ন্যাচারাল ডেথ’ হবে, হামলা-মামলার প্রয়োজন হবে না।
জিয়াউদ্দীন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে