‘ঘুড্ডি’ নির্মাতা সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী ভাইয়ের স্মরণে
চলচ্চিত্র নির্মাতা সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী ভাইয়ের সঙ্গে আমার তেমন কোনো সখ্য ছিল না। কারণ আমাদের বয়সের ব্যবধান অনেক। তবে আমাদের মধ্যে হায়-হ্যালো জাতীয় একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তার কালজয়ী ও সুপার হিট সিনেমা ‘ঘুড্ডি’র সঙ্গে আমার শুধু সখ্যই নয়- গভীর প্রেম ছিল। ১৯৮০ সালের ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ক্লাসিক সিনেমা ‘ঘুড্ডি’ যখন মুক্তি পেয়েছিল তখন আমি খুব ছোট। তাই একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে এই সিনেমার কথা আমি জানি ৯০-এর দশকে এসে। আমি যখন এই সিনেমা দেখি তখন আমি অভিভূত হয়েছিলাম।
এটি বাংলাদেশের অন্যসব সিনেমার মতো বাজারি নয়, অথচ আনন্দদায়ক ও শিল্পসমৃদ্ধ সত্যিকারের একটি বাংলাদেশিপ্রেমের সিনেমা। এই সিনেমার সংলাপ, চরিত্রায়ণ এবং কাহিনিতে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী দেশের চিত্র ফুটে উঠেছে গভীরভাবে। সিনেমাটির কাহিনি ছিল এমন, আসাদ নামক এক শিক্ষিত বেকার ও ভবঘুরে যুবক, ঢাকা শহরের ফকিরাপুলের পানির ট্যাংকের কাছে একটি টিনের ঘরে বাস করে। তার কাছে টাকা-পয়সা প্রায় থাকে না বললেই চলে।সকালে তার এক বন্ধুর লন্ড্রিতে সময় কাটায়, দুপুরে বন্ধুর মতিঝিলের অফিসে খায় এবং আড্ডা দেয়। বন্ধুর লন্ড্রি থেকে সে জামা নিয়ে বাইরে ঘুরতে বেরোয়, সে তার রিকশা ভাড়াও তার বন্ধুর কাছ থেকে নেয়। আসাদ তার বন্ধুর গাড়িতে করে একসঙ্গে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যায় গাড়িতে করে। আসাদের বন্ধু হোটেলের ভেতরে চলে গেলে আসাদ গাড়ির বাইরে দাঁড়ালেএক তরুণী তাকে বলে যে তার গাড়িটি বের করার জন্য আসাদের গাড়িটি সরাতে হবে। ঘটনাপ্রবাহে আসাদ তার বন্ধুকে গাড়ির ড্রাইভার সাজায়, বলে যে তার কাছ থেকে চাবি আনতে হবে, তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে আসে। তখন দেখা যায় তরুণীটির গাড়ি স্টার্ট হচ্ছে না, তারপর আসাদ তরুণীটিকে গাড়িতে উঠিয়ে গাড়ি চালিয়ে তার বন্ধুর সামনে দিয়েই চলে যায়। আসাদের বন্ধুর লন্ড্রিতে গাড়ি থামাতে বলে সে তরুণীটি, আসা গাড়ি থামায় এবং তরুণীটি কাপড় বদলে আসে।
রাস্তায় এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ওই তরুণীএবং সে তাকে ‘ঘুড্ডি’ বলে ডাকছিল। আসাদ ঘুড্ডির বাড়িরসামনে এসে পড়লে ঘুড্ডি তাকে তার নাম জিজ্ঞেস করে, আসাদ মিথ্যে নাম বলে যে, ‘মহাব্বাত আলী’। ঘুড্ডি পুনরায় একদিন আসাদের বন্ধুর লন্ড্রিতে যায় এবং আসাদ তাকে অনুসরণ করতে করতে শ্যামলী সিনেমা হলে চলে যায়, তার কাছে টাকা থাকে না। ওখানে ক্যান্টিনে পেপসি আর ভেজিটেবল রোলের বিল সে দিতে গিয়ে থতমত খায়। এভাবে আসাদ আর ঘুড্ডি অনেক ঘোরাঘুরি আর আড্ডা দিতে দিতে একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়। আর এই প্রেম কাহিনি নিয়ে অনবদ্য হয়ে ওঠে এই সিনেমা। এই কাহিনি আপাতত সরল মনে হলেও সিনেমার নান্দনিক নির্মাণশৈলী, রাজনৈতিক সমালোচনা, অভিনয় এবং কাহিনির গতানুগতিকতা, বক্তব্যের গভীরতা ‘ঘুড্ডি’-কে অনন্য করে তুলেছে। কারণ আমি ৮০-এর দশকের যত বাংলাদেশি সিনেমা দেখেছি সে সব সিনেমা থেকে ‘ঘুড্ডি’ একদম আলাদা। তখন হয়তো উন্নত প্রযুক্তি ছিল না, কিন্তু ছবিটির গল্প ও নির্মাণশৈলী অত্যন্ত আধুনিক ছিল। সেই সুবাদে এটি কালের সীমানা জয় করে নেয়। আর এ কারণে বাংলাদেশে নির্মিত বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘ঘুড্ডি’ অন্যতম শক্তিশালী সিনেমা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
‘ঘুড্ডি’ ছবি নিয়ে এক স্মৃতিচারণায় এমনটা লিখেছিলেন পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী। ‘‘আজ ১৯ ডিসেম্বর।ঘুড্ডি মুক্তির ৪০ বছর পূর্তি। এ কথা মনে করিয়ে দিতেই অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা বললেন, ‘তাই নাকি! ঘুড্ডি ছবিটা ৪০ বছর আগে তৈরি হলেও এর আবেদন আজও শেষ হয়নি।
গানগুলোর কথা যদি বলি, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘কে বাঁশি বাজায় রে’, ‘ঘুম ঘুম ঘুম চোখে দেয় চুম’ এখনো রিমেক হচ্ছে। এটি একটি মাইলস্টোন মুভি। ট্রেন্ডসেটার সিনেমা।’ ১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ঘুড্ডি’ সিনেমায় নাম-ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা এবং অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, তারিক আনাম খান, নায়লা আজাদ নূপুর, সৈয়দ হাসান ইমাম।
এই চলচ্চিত্রের মধ্যদিয়ে সুবর্ণা মুস্তাফার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়। এ ছাড়া ছবির সব চরিত্রে নাম তাঁদের প্রকৃত নামেই। যদিও ‘ঘুড্ডি’ সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী ভাইয়ের প্রথম সিনেমা, কিন্তু অসাধারণ কাজের জন্য তিনি ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নিজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ঘুড্ডি’ দিয়ে ৬ষ্ঠ জাতীয় চলচ্চিত্র আসরে শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তা ছাড়া এই সিনেমার চিত্রগ্রাহক শফিকুল ইসলাম স্বপন ভাই শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক বিভাগে পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর ‘লাল বেনারসি’, ‘আয়না বিবির পালা’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
৯০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। সালাহউদ্দিন জাকী ভাই খুব বেশি সিনেমা নির্মাণ করেননি। তবে তার মেধা-মনন দেশের চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি অঙ্গনে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। শেষজীবনে দুটি সিনেমা নির্মাণ করে গেছেন সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী।
ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত ছবি দুটির নাম ‘অপরাজেয় একা’ ও ‘ক্রান্তিকাল’।অবশেষে বলতে চাই, একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকার ও লেখক সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন। তার মহাপ্রয়াণে গভীর এবং বিনম্র শ্রদ্ধাজানাই।
লেখক: কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে