সাংবাদিক উর্মি রহমান আপা স্মরণে
এ মাসের ১৪ তারিখে উর্মি রহমান আপা চলে গেলেন কলকাতার কোনো এক হাসপাতালে। কিছুদিন ধরেই লড়াই চলছিল ক্যান্সারের সঙ্গে, অবশেষে মৃত্যু। আমি জানতাম রোগের কথা; কিন্তু শুনেছিলাম রোগ সামাল দিয়েছেন তিনি। শেষ কথা কী হয়েছিল, কবে হয়েছিল এসব ভেবে এখন আর কী হবে? প্রিয় মানুষটি আর নেই। মনের ভেতরটা কষ্টে আছে সদ্যপ্রয়াত মানুষের স্মৃতির ভারে। যাদের প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চিনি তারা তো যাবেই। আমি নিজেও এমনি করে কারও জন্য কেবল স্মৃতি হয়ে যাব। তবু মন তো ক্যান্সারের মতোই একটি রোগ, কারও কথা শোনে না, নিজের গতিতে চলে।
উর্মি রহমান আপার সঙ্গে পরিচয় ৭০ দশকের কোনো এক সময়, সাপ্তাহিক বিচিত্রা অফিসে। এই পত্রিকার অফিস ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশপন্থি তরুণদের আড্ডাখানা। পত্রিকাটি আধুনিক-প্রতিবাদী ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিল। ফলে নানা কিসিমের মানুষের ঠিকানা হয়ে উঠেছিল। এর নেতা ছিলেন সম্পাদক শাহাদাৎ চৌধুরী ভাই, যিনি আজকের ভাষায় একজন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’; কিন্তু তখনকার দিনে যুদ্ধের পর যোদ্ধারা নিজেদের এত কিছু ভাবতেন না। যা করার তা করেছেন, ব্যস, এই পর্যন্তই। বিচিত্রার সাংবাদিকতা ছিল এক নতুন উজ্জ্বলতায় আলোকিত। আমার মিডিয়াবিষয়ক বইতে লিখেছি, বাংলাদেশের আধুনিক সাংবাদিকতার যাত্রা সাপ্তাহিক বিচিত্রা দিয়ে শুরু। উর্মি আপাও ছিলেন, পার্ট টাইম কাজ করতেন। তবে বিচিত্রা দলের মানুষ হিসেবে নয়, আমার সঙ্গে আগেই আলাপ ছিল মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র অফিস থেকে। হাসান হাফিজুর রহমানের কাছে তিনি আসতেন মন খুলে কথা বলার জন্য। তার জীবনে কোনো উথাল-পাথাল চলছিল। হাসান ভাই তো সবার মনের কথা শুনতে প্রস্তুত। উর্মি আপাও ছিলেন অনেকের মধ্যে একজন। তখন থেকেই উর্মি আপার সঙ্গে আমার স্নেহের বন্ধন।
যেহেতু তিনি ‘আপা’ তাই আড্ডাগুলা স্নেহের ভিত্তিতে গড়া ছিল। এর পর মধ্য ’৮০ এর দশকে তার সঙ্গে দেখা হতো ঢাকার নানা স্থানে। এর মধ্যে আমি জাতিসংঘ শিশু তহবিলে যোগদান করি। কয়েকটি কাজের মধ্যে একটি ছিল সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, অতএব মধ্য ‘বিচিত্রার’ অনেকে, তার মধ্যে উর্মি আপার সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ হয়; কিন্তু একদিন শুনলাম তিনি বিলেতে চলে যাচ্ছেন, বিবিসিতে চাকরি নিয়ে। সেদিনই দেখা হলো রাস্তায়, রিকশায়। আমি খুব কংগ্রাচুলেট করলাম। কিন্তু ঢাকা ছাড়তে হবে ভেবে উনার মন যে এত খারাপ ছিল, ভাবা যায় না। ‘এত মন খারাপ কেন? এত ভালো চাকরি হয়েছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বিমর্ষ কণ্ঠে বললেন, ‘সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি, মন কী করে ভালো থাকে?’ বললাম, ‘কালকেই চলেন চাইনিজ খাব। আপনি না করলেও আমরা সেলিব্রেট করব।’ উর্মি আপা রিকশায় রওনা দিলেন, ‘ কই দেখা হবে জানিও।’ সুখবর শুনে মন খারাপ করার এটা একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
উর্মি আপা নিয়মিত দেশে আসতেন। বছরে অন্তত একবার; কিন্তু যাবার সময় খুব মন খারাপ থাকত উনার। মন ঠিক করতে একবার বললাম, ফুচকা খাবেন উর্মি আপা!’ তিনি কী একটা কাজের কথা বললেন। আমি দিলাম, ‘আরে উর্মি আপা, বিলেতে কেউ ফুচকা খেতে বলবে না। ওটা লন্ডনে নেই।’ তিনি বিষণ্ণ হেসে রাস্তার পাশের দোকান আমার আর সাংবাদিক লিটুর সঙ্গে থেকে ফুচকা খেলেন। খেতে খেতে মনটা একটু ভালো হলো; কিন্তু জানতাম, এই সবই তাকে টানে, ঢাকা, তার মানুষজন, পরিবেশ, স্মৃতি।
১৯৯১ সালে আমি লন্ডন হয়ে আমেরিকা যাই অফিসের কাজে। উঠলাম বিচিত্রার আর এক ভাই কাজী জাওয়াদ ভাইয়ের বাসায়। বিবিসি অফিসে গেলাম যখন, তখন দেখা হলো উর্মি আপার সঙ্গে। খুব হাসি খুশি। কারণ খুব সহজ। সাগর দা। প্রেম থেকে শুরু করে বিবাহ পর্যন্ত হয়ে গেছে সেখানেই। তারপর যা হয় এই সব অবস্থায়। বাসা পাল্টে গেলাম তাদের ঠিকানায় থাকতে। আড্ডা গল্প তো হয়, তবে আসল কথা প্রসন্ন উর্মি আপা। সাগর দাকে আমার খুব পছন্দ। উর্মি আপাকে সামলে নিয়ে চলতে পারে। কয়েক রাত কাটিয়ে আমেরিকার দিকে রওনা হলাম। ‘ফেরার পথে সোজা আমার বাসায় উঠবে।’ উর্মি আপা বলে দিনে। ফেরার পথে প্লেন অনেক রাতে ল্যান্ড করে। তারপর ট্যাক্সি নিয়ে খুঁজে বের করলাম উনাদের ঠিকানা। দেখলাম মধ্য রাতেও বাড়িতে সব আলো জ্বালানো যাতে আমি বুঝতে পারি। উর্মি আপা কোথাও গেছেন অফিসের কাজে আর সাগর দা অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেলাম বিলেতে বসে সেই রাতে।
একসময় আমি নিজেই বিবিসিতে জয়েন করি, মাঝে মধ্যে বিলেতে গেলে কই থাকব এই নিয়ে বিবাদ হতো। একসময় ওই চাকরি ছেড়ে বিলেতে যাবার অফার না করে আফ্রিকায় চলে যাই। আমার যা স্বভাব, ভদ্র বাউন্ডুলে কর্ম পথিক। একসময় উর্মি আপা ও সাগর দা রিটায়ার করে কলকাতায় থাকতে চলে যান। ঢাকা এলে দেখা হতো। আড্ডা হতো বিচিত্রা বা বিবিসির কারো বাসায়। গত রাতে খবরটা পেয়ে বিবিসির সামিয়া জামান ফোন করেছিল। আমার মন যে খুব খারাপ হবে এটা জেনে। অনেকক্ষণ কথা বললাম পুরানকাল নিয়ে। তারপর কথা হলো বিচিত্রার চিন্ময় মুৎসুদ্দি দার সঙ্গে। এটা অস্বীকার করে লাভ নেই এটা আমাদের যাবার কাল। তবু মনে হয় আর একটু যদি সময় পেতাম, একবার যদি দেখা হতো, আর একবার যদি বলতে পারতাম, ‘চলেন, আপনাকে ফুচকা খাওয়াই উর্মি আপা।’ ভালো থাকবেন উর্মি আপা, সাগর দা।
আফসান চৌধুরী: কথাসাহিত্যিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও শিক্ষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে