Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

কবি আসাদ চৌধুরী স্মরণে

Selina Hossain

সেলিনা হোসেন

শুক্রবার, ৬ অক্টোবর ২০২৩

বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদ চৌধুরী আমাদের ছেড়ে অসীম শূন্যতায় পাড়ি দিয়েছেন। তিনি শুধু আমার বড় ভাই ছিলেন না, ছিলেন আমার সহকর্মী। আমি জানি, তিনি যেমন মাটির মানুষ ছিলেন, ছিলেন মাটির কবি। আসাদ চৌধুরী পঞ্চপাণ্ডবদের পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতায় এক অনিবার্য নাম। তিনি বাংলা ভাষার ষাটের দশকের কবিতা আন্দোলনের কীর্তিমান পুরুষ। তাঁর কবিতায় বাংলার প্রকৃতি, সাধারণ মানুষের জীবনবোধ ও বাংলাদেশের সংগ্রামী ঐতিহ্য অসাধারণ স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর হয়েছে। কবিতার পাশাপাশি তিনি প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ কাহিনীসহ বিচিত্র সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। বড় ভাই আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার এত স্মৃতির ঝাঁপি আছে, আর সেই স্মৃতির ঝাঁপিগুলো খুললেই আমার মন খুব ভারাক্রান্ত হয়ে যাবে। তাই আজ আমি তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচানা করব।

আসাদ চৌধুরীর কবিতায় চেতনাবোধের নির্যাস আমার ভালো লাগার সত্য সুন্দর। তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেন মানবিক সচেতনতাকে, সেই প্রশ্নের অনুরণন রেখে শেষ করেন কবিতার প্রত্যয়ী শিল্পের পাটাতন, যেখান থেকে পাঠক খুঁজে পান একজন কবির স্বকীয়তা। যিনি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের আলোকে পাঠককে নিয়ে যান শিল্পের নিসর্গে। সেখানে অবস্থান করে পাঠকের জিজ্ঞাসা উচ্চারিত হয় নানা পংক্তিতে। পাঠকের হৃদয় ভরে থাকে চেতনাবোধের অনুধাবনে। আসাদ চৌধুরী তাঁর কবিতায় পাঠকের দৃষ্টি নিমগ্ন করেন নানা ব্যাখ্যায়, নানা অনুসন্ধিৎসায়। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটের তীব্র আলোকে বিমূর্ত হয় শব্দের পঙ্খিরাজ।

মুক্তিযুদ্ধ কবির চেতনায় নানা মাত্রার জ্বলজ্বলে দীপশিখা। তিনি তাঁর কবিতায় মুক্তিযুদ্ধকে বিমূর্ত করেছেন নানা প্রেক্ষাপটে। ‘রিপোর্ট ১৯৭১’ তাঁর এমন একটি কবিতা:

‘প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল

বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম

আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।

এসব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে

বৃক্ষের আড়ালে সরে যায়

বেড়ার ফোঁকর দিয়ে নিজের রন্ধনে

তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে

শুধু মুখ টিপে হাসে।

প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হয়ে

কোঁচড়ে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা-সূর্য্যকেও পর্দা করে এসব রমণী

অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার।’

এরপরে আছে কবির অসাধারণ পংক্তি:

‘বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা-বাঁকা পবিত্র হরফ

বোবা হয়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটের ক্ষুধা।’

মুসলিম হয়ে একাত্তরের নারী নির্যাতনে কবি ধর্মগ্রন্থের পবিত্র অক্ষরকে বোবা হতে দেখেছেন। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নারী নির্যাতন কবিতার পংক্তিতে বাঙ্ময় হয়ে ধিক্কার হানে। অন্যদিকে প্রবল শিল্পিত ব্যঞ্জনা কবিতার রংধনুকে উজ্জ্বল করে রাখে। পাঠক দেখতে পায় কবির বলিষ্ঠ প্রকাশ কত দৃঢ়। সেখানে নিজের চেতনার অনুষঙ্গ নমিত হয় না। এখানেই কবি ও কবিতার জয়।

কবিতাটি শেষ হয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ মিশে থাকে স্বাধীনতার উড্ডীন পতাকায়। কবি ধর্ম-বর্ণের উর্ধে মৈত্রীর বন্ধনকে রচনা করেন কবিতার পংক্তিমালায়:

‘ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,

মুসল্লির সেজদায় আনত মাথা

নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।

বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন

ভ্যাবাচেকা খেয়ে পড়ে আছে, তাঁর মাথার ওপরে

এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী করে

হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে।’

কেঁদে কেঁদে মৈত্রীর বাণী ছড়িয়েছিল এক ডজন শকুন। শকুনের ডানায় নেমেছিল মেঘের দল। মুছিয়েছিল অশ্রুভেজা চোখের জল। স্বাধীনতা চোখের জলে, নির্যাতনের নিষ্ঠুর থাবার নিচে রমণীকূলের শোণিতে বিম্বিত করে ইতিহাসের সত্য। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অমর যোদ্ধাদের মৃত্যুঞ্জয়ী চেতনায় প্রস্ফুটিত হয় স্বাধীনতার রক্তগোলাপ।

তাঁর পরবর্তী কবিতার নাম ‘শহীদদের প্রতি’। লিখছেন:

‘তোমাদের যা বলার ছিল

বলছে কি তা বাংলাদেশ?’

যখন এ কবিতা লেখা হয় তখনও সবটুকু বলেনি বাংলাদেশ। কারণ শহীদের জীবনের বিনিময়ে যে স্বাধীন দেশের জন্ম সেখানে রাজাকারদের গাড়িতে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়তে পারে না। যুদ্ধাপরাধীরা ক্ষমতার দাপটে চলতে পারে না। ক্ষমতার মোহ এ দেশকে শহীদের ত্যাগের মহিমাকে খণ্ডিত করেছিল। সেজন্যই কবতিা শেষ হয় আবার একই প্রশ্ন দিয়ে:

‘তোমাদের যা বলার ছিল

বলছে কি তা বাংলাদেশ?’

কবির জিজ্ঞাসা অনুচ্চারিত থাকে। কবি উচ্চকণ্ঠে শহীদদের প্রশ্ন করেছেন। এক সময় এই প্রশ্নের রেশ জঙ্গি উত্থানে প্রকম্পিত করেছিল দেশের মানুষকে। এক পর্যায়ে দেশের মানুষ দেখেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। দণ্ড কার্যকর হয়েছে। শহীদের অমলিন ত্যাগে নীলিমা নীলাভ আলো ছড়ায়।

কবি রাজনীতির শুভবোধের শূন্যতায় আবার কবিতায় বলেন, ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম।’ কখন? কবিতা বলে দেয় সময়ের এই কখন। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কখন। কবিতার শুরু এমন:

‘নদীর জলে আগুন ছিলো

আগুন ছিলো বৃষ্টিতে

আগুন ছিলো বীরঙ্গনার

উদাস-করা দৃষ্টিতে।’

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নারীদের বীর নারী উপাধি দিয়েছিলেন বীরাঙ্গনা শব্দের মাধ্যমে। সেই সময়ে নারীরা একদিকে যেমন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছিলেন অন্যদিকে তেমন যুদ্ধেও সময়ের সমাজ কাঠামো টিকিয়ে রাখার শক্তিধর মানবী ছিলেন। তাঁরা কখনো পিছিয়ে থেকে স্বাধীনতার স্বপ্নের বাইরের মানুষ ছিলেন না। নিজের নির্যাতনের পাশাপাশি স্বজন হারানোর বেদনায় তাঁদের দৃষ্টি উদাস ছিল। কবি সেই দৃষ্টিতে আগুন দেখেছেন। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সত্য নিহিত ছিল। তিনি কবিতার আর এক জায়গায় বলেছেন:

‘আগুন ছিল মুক্তি সেনার

স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়

প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে

কাঁপছিলো সব-অন্যায়।’

এক সময় দেশের নষ্ট রাজনীতি উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল সত্যিকারের মানুষ থাকার সময়ের চেতনা। সেই সময়ের কথা বলে কবি বেদনার কথা বলেছেন কবিতার শেষ কয়েকটি চরণে:

‘এখন এ-সব স্বপ্নকথা

দূরের শোনা গল্প,

তখন সত্যি মানুষ ছিলাম

এখন আছি অল্প।’

এই অল্প মানুষ থাকার কষ্টের কথা তিনি আরও প্রকাশ করেছেন ‘সত্য ফেরারী’ কবিতায়। মুক্তিাযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে জঙ্গি মৌলবাদের উত্থানের কারণে সত্য আড়াল হয়ে গেছে। কবির প্রথম পংক্তির উচ্চারণ ‘কোথায় পালালো সত্য?’ কবিতাজুড়ে তিনি ফেরারী হয়ে যাওয়া সত্যকে খুঁজেছেন। এভাবে কবি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আড়াল করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। তবে এটাও ঠিক যে সময়ের বেদনার কথা বলেছেন, সে সময়ের রাহু বেশিদিন ক্ষমতায় টিকতে পারেনি। এটাই দেশের মানুষের সত্যি মানুষ থাকার সাহস। প্রতিরোধের জায়গা। তৈরি করে সত্যকে সামনে রাখার সাহস। সত্যিকার মানুষ হয়ে টিকে থাকার দর্শন। কবি এই সাহসের কথা উচ্চারণ করেছেন ‘বারবারা বিডলারকে’ কবিতায়:

“বারবারা এসো,

রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই

বিবেকের জং ধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি

অন্যায়ের বিপুল হিমালল দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই,

সংগঠিত হই

জল্লাদের শাণিত অস্ত্র

সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,

দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে

এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।”

কবি ও কবিতার প্রতি সংরাগে তৈরি হয় স্বদেশভূমির বাস্তবতা। এই বাস্তবতা পূর্ণ করে নক্ষত্ররাজি। আবার এই বাস্তবতায় আমানিশার অন্ধকার নামিয়ে দেয় ক্ষমতা লোভীরা। কবির দর্পন বিম্বিত করে সবটুকু। আড়াল করার সুযোগ রাখে না। কবি আসাদ চৌধুরী এই সত্যের কবি।

লেখক: কথাশিল্পী ও বাংলা একাডেমির সভাপতি

 

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ