Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

মুক্তবাজার অর্থনীতি বিচারে সব দুর্বল ব্যাংকের অবসায়ন দরকার

Zeauddin Ahmed

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বৃহস্পতিবার, ৩০ মে ২০২৪

দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংকট কাটিয়ে তোলার নিমিত্তে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন ফ্রেমওয়ার্ক’ শিরোনামে একটি সার্কুলার ইস্যু করে; এই সার্কুলারে বলা হয়েছিল যে, ‘ব্যাংকগুলো উক্ত ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নপূর্বক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হলে ২০২৫ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূত করার মতো পদক্ষেপ নিতে পারবে।’ একীভূতকরণ বা ‘মার্জার’ হলো দুই বা ততধিক কোম্পানির এক হয়ে যাওয়া। দুর্বল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তবে এই ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে মার্জার নয়, পতনোন্মুখ ব্যাংককে উদ্ধার করা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত রোডম্যাপে একীভূত করার পরিকল্পনা ছাড়াও ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত করা এবং খেলাপি ঋণ সমস্যা সমাধানের বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে, আমানতের টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। ব্যাংক নিয়ে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের সেমিনার, কর্মশালায়ও নেতিবাচক কথাবার্তা হয়। দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদেরও ধারণা বাংলাদেশ ব্যাংক নোট ছাপিয়ে বাজারে ঢেলে দিচ্ছে। তাই তারা নোট ছাপানো বন্ধ করার দাবি তুলছেন। সব ছাপানো নোট যে টাকা নয়, এই ধারণা নিশ্চয়ই তাদের আছে, তারপরও তারা সেমিনার আর টকশোতে একই কথা গোয়েবলসের মতো বলেই যাচ্ছেন; অথচ বিগত অর্থবছরে টাকশাল থেকে উত্তোলিত ৪১ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে উত্তোলন করেছে মাত্র ৭ হাজার কোটি টাকা।

সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সমালোচনা করতে গিয়ে কিছু জ্ঞানী-গুণী জনগণকে কেন বিভ্রান্ত করছেন, তা বোঝা কঠিন। ব্যাংক নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া আর বিভ্রান্তমূলক তথ্য পরিবেশন করা এক কথা নয়। আমরা সবাই ব্যাংকিং খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন, কারণ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে, পরিচালকদের নামে-বেনামে অতিরিক্ত লোন নেয়ার কিসসা-কাহিনি মিডিয়ায় নিয়মিত প্রচার হচ্ছে। নব্বই দশকে আমাদের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘প্রবলেম ব্যাংক’ নামে একটি বিভাগ ছিল, এই বিভাগের কাজ ছিল দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নানা আদেশ-নির্দেশ-উপদেশ দিয়ে সবল করে তোলা। তখন দুর্বল ব্যাংককে নতুন লোন প্রদানে নিষেধ করা হতো। কেন এমন নীতি তা আমার আজও বোধগম্য হয় না। নতুন আমানত গ্রহণ ও নতুন লোন না দিলে ব্যাংকটির দুর্বলতা কীভাবে কাটবে তার উত্তর খুঁজতাম। সেই সময়ে বিদেশে একটি সেমিনারে যোগ দিয়ে জানতে পারি, উন্নত দেশগুলোতে অহরহ ব্যাংক দেউলিয়া হয়; কিন্তু বীমা করা থাকে বিধায় আমানতের টাকা ফেরত পেতে সমস্যা হয় না। বাংলাদেশে কোন ব্যাংক দেউলিয়া হয় না- আমার মুখে এ কথা শুনে সেমিনারের অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী বিস্মিত হয়েছিলেন।

প্রতি বছর ব্যাংকের সবলতা-দুর্বলতা নিরূপণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে, ২০০০-২২ সালে আমিও এই কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। তবে এক ব্যাংকের নিরূপিত আর্থিক অবস্থা অন্য ব্যাংককে জানানো হতো না, এমন কী জনসাধারণের জন্যও তা উন্মুক্ত ছিল না। একবার একটি ব্যাংকের হাতে কীভাবে যেন সব ব্যাংকের নিরূপিত অবস্থান পৌঁছে যায় এবং সেই ব্যাংকের অবস্থান সবল হওয়ায় তারা সব ব্যাংকের তুলনামূলক অবস্থা মিডিয়ায় প্রচার করে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থানের কথা প্রচার করে দেয়। এই প্রচারে বাংলাদেশ ব্যাংক এত বেশি ক্ষেপে গিয়েছিল যে, ওই ব্যাংকের এমডি লিখিত মাফ চেয়ে চাকরি রক্ষা করেছিলেন। ব্যাংকের অবস্থা খারাপ একদিনে হয়নি। আগেও যে খুব ভালো ছিল, তা কিন্তু নয়।

আশি, নব্বই দশকেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৫ শতাংশের বেশি। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এক সময় সিবিএ-এর দৌরাত্ম্য ছিল সীমাহীন। বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা অফিসের কাজ করত না, তারা ঘুরে বেড়াত, ঋণ অনুমোদন করাত, মাঝে মাঝে সিনিয়র কর্মকর্তাদের নাজেহাল করে নিজেদের ক্ষমতার জাহির করত। সোনালী ব্যাংকের সিবিএ নেতা বাকির হোসেনের এত প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল যে, তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে সদলবলে এসে গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমেদকে তার চেম্বারে অশালীন ভাষায় শাসিয়ে গিয়েছিলেন; বাকিরের এই আচরণ তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে অবহিত করা হলেও বাকিরের কিচ্ছু হয়নি; কারণ বাকির হোসেন অর্থমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে বিদায় ও অভ্যর্থনা জানানোর লাটবহরে অন্তর্ভুক্ত থাকতেন। রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বলেই ব্যাংকগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে, নতুবা সব ব্যাংক বহু আগেই দেউলিয়া হয়ে যেত।

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের গভর্নিংবডির নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে বাকির হোসেনের কোটি টাকা খরচের কাহিনি তখনকার মিডিয়ায় বের হয়েছিল। এখন সিবিএ-এর দৌরাত্ম্য কিছুটা কমেছে, বেড়েছে দুর্নীতিবাজ আর ঘুষখোর কর্মকর্তার দৌরাত্ম্য। ব্যাংকগুলোর অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি সীমাহীন। আমাদের দেশীয় ব্যাংকগুলোর এলসিকে পুনঃনিশ্চিত করে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি ব্যাংক ও বিদেশি ব্যাংকের প্রতিনিধি অফিসগুলো। এই ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এলসি বণ্টনে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের কথা শোনা যায় এবং সব ঘুষ পরিশোধিত হয় ডলারে বিদেশে। সাধারণ ব্যবসায়ীদের লোন পাইয়ে দেয়ার জন্যও ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তারা দালাল শ্রেণি তৈরি করেছেন, মতিঝিলে খুঁজলেই অসংখ্য দালাল পাওয়া যাবে, এদের কাছে প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরি করা থাকে। দালাল না ধরলে জুতোর সুকতলা ক্ষয় করেও লোন পাওয়া যায় না, পাওয়া গেলেও অতিরিক্ত বিলম্বের কারণে সেই লোনের আর উপযোগিতা থাকে না, উপযোগিতা থাকে না বলেই ঋণখেলাপি হয়।

ঋণখেলাপি বা ব্যাংক দুর্বল হওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায় নিরূপণ করা অতি প্রয়োজন। এক সময় ডেপুটি গভর্নর হওয়ার জন্য সম্ভাব্য প্রার্থীরা জাঁদরেল ব্যবসায়ীর কাছে দৌড়াতেন, এবং ডেপুটি গভর্নর হয়ে তাদের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা তপশিলি ব্যাংকের প্রশিক্ষণ একাডেমিতে পড়াতে পারবেন না মর্মে গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের সময় একটি নির্দেশনা জারি হয়েছিল, কারণ পড়ানোর সম্মানীর পরিমাণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে লক্ষ টাকার স্তরে থাকত। বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে আমি প্রায়ই গভর্নর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিনকে বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতি সম্পর্কে অবহিত করতাম। দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির ক্রমাবনতি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক নিয়োগ দেয়া হয়; তারা বোর্ড মিটিংএ যোগ দিয়ে বোর্ডের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে থাকেন; কিন্তু বোর্ডে উপস্থাপিত শুধু মেমোরেন্ডাম পর্যবেক্ষণ করে ব্যাংকের সার্বিক অনিয়ম উদ্ঘাটন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকলে অনিয়মের বিরুদ্ধে একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয়। মনস্তাত্ত্বিক চাপটিও থাকবে না যদি পর্যবেক্ষক তার অবসর-উত্তর জীবনে ওই ব্যাংকেই চাকুরির অফার পেয়ে যান। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ অতিরিক্ত ব্যাংক। বাংলাদেশের অর্থনীতি এত বড় নয় যে, ব্যাংকিং সেবা দেয়ার জন্য ৬১টি ব্যাংক লাগবে। করপোরেট ব্যবসায়ীদের নিয়ে ব্যাংকগুলো রীতিমতো টানাটানি করে। শিল্পায়নে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ দেয়ার কথা নয়, তারা ঋণ দেবে ব্যবসায়। বিদেশি ব্যাংকগুলো সচরাচর শিল্প খাতে ঋণ দেয় না; তাদের কার্যক্রম এলসি আর কমিশন ব্যাংকিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারা কৃষিতে নেই, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার ধার ধারে না, তারা শিল্প বিনিয়োগে উৎসাহী নয়; তাই তাদের খেলাপি ঋণও অনেক কম। শিল্পে পুঁজির জোগান দেয়ার জন্য স্টক মার্কেটের বিকাশ জরুরি। উদ্যোক্তাদের পুঁজির চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর বর্তানো হয়েছে বলেই খেলাপি ঋণ বেশি। কোনো শিল্পকে লাভজনক অবস্থায় দাঁড় করানো খুব সহজ নয়। ট্যাক্স ফাঁকি দিত বলেই পাকিস্তান আমলের আদমজী জুটমিল লাভজনক ছিল। এখনো শিল্পপতিরা হয়তো তাই করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব খেলাপি ঋণ ও ঋণ-সংক্রান্ত অনিয়মের জন্য অনেকাংশে দায়ী। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও প্রাইভেট ব্যাংকগুলো শুরু থেকেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। সরকার বারবার মূলধনের জোগান দিয়ে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার আরেকটি কারণ ঋণ প্রদানে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অযাচিত হস্তক্ষেপ। প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর প্রশাসন, ঋণ প্রদান সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় পরিচালকদের ইশারায়, স্বেচ্ছাচারিতায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ডেপুটি গভর্নর একটি প্রাইভেট ব্যাংকের এমডি হয়েছিলেন, তিনি কারণে-অকারণে ব্যাংকের মালিকের পা ছুঁয়ে সালাম করতেন। অবশ্য পা ছুঁয়ে সালাম না করেও গত্যন্তর থাকে না, ব্যাংকের পরিচালক, আমলা, রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের আবদার রক্ষা করতে করতেই তাদের রক্তচাপ বেড়ে যায়। মুক্তবাজার অর্থনীতি বিচারে সব দুর্বল ব্যাংকের অবসায়ন দরকার, জোর করে টিকিয়ে রাখার কোনো অর্থ হয় না; কিন্তু এই অবসায়নে সমস্যার সমাধান না হয়ে নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে, অবসায়ন করার সঙ্গে সঙ্গে সবল ব্যাংকগুলোর ওপরও জনগণের আস্থা থাকবে না।

বর্তমানে দুর্বল ব্যাংকগুলোর ওপর জনগণের আস্থা না থাকায় শত নীতি-পদ্ধতি প্রয়োগ করেও ব্যাংকগুলোকে সবল করা যাচ্ছে না, দুর্বল ব্যাংকে সরকারও তাদের তহবিল রাখে না। কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল; কিন্তু সম্ভব হয়নি। তাই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করাই আস্থার সংকট কাটানোর একমাত্র পথ। বিভিন্ন দেশে প্রায় প্রতিদিন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থে স্বেচ্ছায় পরষ্পর একীভূত হচ্ছে; কিন্তু আমাদের দেশে দুর্বল ব্যাংকগুলো স্বেচ্ছায় মার্জ হবে না, মার্জ হলে পরিচালকদের ক্ষমতা হারানোর ভয় রয়েছে; তাই ব্যাংকের মালিকরা তাদের ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করতে রাজি থাকলেও মার্জ করতে রাজি হবে না। জোর করতেই হবে, অপ্রিয় হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কাজটি করা ফরজ।

লেখক: কলামিস্ট, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ