সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা
মুক্ত গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে স্বাধীন মত প্রকাশের বিকল্প নেই
গত শুক্রবার (৩ মে) ছিল বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। দিবসটি উপলক্ষে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৪ সালের সাংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক প্রকাশ করেছে। বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম, স্কোর ২৭ দশমিক ৬৪। ২০২৩ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৩তম। স্কোর ছিল ৩৫ দশমিক ৩১। এমন তথ্য সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষেত্রে যেমন অশনিসংকেত, তেমনি দেশের মতপ্রকাশের ক্ষেত্রেও।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবনমন প্রতি বছরই ঘটছে। সবচেয়ে বড় অবনমন ঘটেছিল ২০২২ সালে। ২০২১ সালের তুলনায় ওই বছর সূচকে বাংলাদেশের ১০ ধাপ অবনমন হয়েছিল। পরের বছর আরও এক ধাপ পেছায় বাংলাদেশ। আর এবার দুই ধাপ পিছিয়েছে। সে হিসাবে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে তিন বছরে সূচকে বাংলাদেশের ১৩ ধাপ অবনমন ঘটল, ১৫২তম থেকে ১৬৫তম অবস্থানে নেমে গেল বাংলাদেশ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, তার ওপর ভিত্তি করে আরএসএফ এই সূচক প্রকাশ করে। রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনি সুরক্ষা, সামাজিক ও নিরাপত্তা- এই পাঁচ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক তৈরি করা হয়। গত বছরের তুলনায় সামাজিক ও নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকলেও বাকি তিনটি ক্ষেত্রে অবনমন হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্য বেশ কয়েকটি দুঃসংবাদ এসেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঠাঁই পায়নি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার মানে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩তম। বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা শীর্ষে। ঢাকার বাতাসে পাওয়া গেছে পাঁচ প্রকার বিষাক্ত গ্যাস। দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
এসব খবর আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছে। সত্যি বলতে এসব খবরের চেয়েও বড় দুশ্চিন্তার বিষয় স্বাধীনতা সূচকে সংবাদমাধ্যমের অবনমন। কারণ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কমে গেলে অন্যান্য গণতান্ত্রিক পরিবেশও ব্যাহত হয়। আর গণতান্ত্রিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে একটি রাষ্ট্র কোনোভাবেই আর তার রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনি সুরক্ষা, সামাজিক ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে পিছিয়ে যাওয়া মানে স্বাভাবিকভাবেই অন্যসব বিষয়েরও অবনতি। একটা কথা আমাদের সবাইকে স্মরণে রাখতে হবে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেই তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যাপারে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।
কিন্তু কেন কমছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা? কারণটি কারও অজানা নয়। অভিযোগ আছে বাংলাদেশের বেশির ভাগ সংবাদ মাধ্যমের মালিকপক্ষ রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী। তাই তাদের সরকার ক্ষমতায় থাকলে তাদের সংবাদ মাধ্যমগুলো এক ধরনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। আরএসএফের ভাষ্যমতে, ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকরা পছন্দ না হলে সাংবাদিকদের ওপর সহিংস হামলা চালিয়ে আসছে। কোনো সাংবাদিককে চুপ করিয়ে দিতে বা সংবাদমাধ্যমকে বন্ধ করতে বিচারিক হয়রানি অব্যাহত রয়েছে। এ ধরনের বৈরী পরিস্থিতিতে সরকারি ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করে এমন বিষয় সম্পাদকরা সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে যান।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে যে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) করা হয়েছে, তারও সমালোচনা করেছে আরএসএফ। তারা বলেছে, বাংলাদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমের বেশির ভাগই হয়েছে এদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করা বড় ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। তারা নিজেদের সংবাদমাধ্যমকে দেখেন প্রভাব বিস্তার ও মুনাফা তৈরির একটি হাতিয়ার হিসেবে। এ ক্ষেত্রে তারা সম্পাদকীয় স্বাধীনতা বজায় রাখার চেয়ে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন।
আমরা মনে করি, দেশে বিদ্যমান নানান ধরনের আইন, নির্যাতন ও নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ এবং বিভিন্ন ধরণের বিধিনিষেধের কারণেই বাংলাদেশে সাংবাদিকদের জন্য কাজ করার পরিধি ক্রমেই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তা ছাড়া সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশে যে ধরণের বিধিনিষেধ দেয়া হচ্ছে তাতে গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। তাই গণমাধ্যম কর্মীরা যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন নীতিনির্ধারকদের সে পথ সুগম করতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে