অপরিণত দলের সূচনা বিজয়
ব্রিটিশরা যেখানে ঔপনিবেশ গড়েছিল, সেখানেই মোটামুটি রোপিত হয়েছে ক্রিকেট খেলার বীজ। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করার পর, কোনো কোনো দেশ সেই বীজের পরিচর্যা করে বৃক্ষে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। এখন তো বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করছে তারাই। অথচ ব্রিটিশদের প্রথম ঔপনিবেশ আমেরিকায় ক্রিকেটের প্রচলন ঘটলেও সেই ধারাটা অব্যাহত থাকেনি। যদিও প্রাথমিক অবস্থায় খেলাটি সেখানে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল। সেই জনপ্রিয়তা একটা পর্যায়ে তলানিতে নেমে আসে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর আমেরিকার ব্যাপ্তি ক্রমেই বাড়তে থাকে। একে একে যুক্ত করা হয় বিভিন্ন রাজ্য। তাতে বৃদ্ধি পায় দেশটির আয়তন ও বৈচিত্র্য। নানা বর্ণ, গোত্র, ভাষা, সংস্কৃতির সংমিশ্রণে দেশটির স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা গড়ে ওঠে। এ কারণে আমেরিকানরা ব্রিটিশ-প্রভাব থেকে নিজেদের ধীরে ধীরে সরিয়ে নেয়। দুই দেশের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, বাগভঙ্গিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে, এমনকি সামাজিক শিষ্টাচারের সূক্ষ্মতায়ও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। উভয় দেশের ভাষা ইংরেজি হলেও উচ্চারণ ও বানানরীতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভেদ রয়েছে। মার্কিনিরা সচেতনভাবে গড়ে তোলে এই পৃথকত্ব।
একইভাবে পরিবর্তন আসে দুই দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রেও। গতিময়তা হচ্ছে মার্কিনিদের জীবনের মূলমন্ত্র। যেখানে গতি নেই, সেখানে তাদের খুব একটা আগ্রহী হতে দেখা যায় না। স্বভাবধর্মে তারা ব্রিটিশদের থেকে আলাদা হওয়ায় খেলার মাঠেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। বেসবল, বাস্কেটবল, সকারের মতো গতিময় খেলাগুলোর জনপ্রিয়তা যুক্তরাষ্ট্রে অত্যন্ত তুঙ্গে৷ সঙ্গত কারণেই মন্থর গতির খেলা হিসেবে পরিচিত ক্রিকেটের প্রতি আমেরিকানদের আকৃষ্ট হওয়ার কারণ নেই। এটা তাদের স্বভাবের সঙ্গে একদমই যায় না; কিন্তু আমেরিকানদের ছাড়া কোনো কিছু বিশ্বব্যাপী জমিয়ে তোলা মোটেও সহজ নয়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। আর এ ক্ষেত্রে তাদের তুরুপের তাস হয়ে উঠেছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। এ খেলাটির গতিময়তা, বীরত্ব ও সাহসিকতা মার্কিনিদের স্বভাবধর্মের সঙ্গে অনেকটা খাপ খেয়ে যায়। মারকুটে ব্যাটিংয়ের সঙ্গে আছে ঝলমলে চিয়ারলিডার্স, উচ্চকিত সংগীত আর গ্ল্যামারাস পরিবেশ। অর্থাৎ তাতে আছে কড়া পাকের বিনোদনের সব রকম উপাদান, যা মার্কিনিদের প্রলুব্ধ করতে পারে। অবশ্য কোনো কিছু লুফে নিলেও তাতে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে মার্কিনীকরণ করাটা তাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। একসময় সেটাই স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে পরিচিত হয়। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তেমনটা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। মার্কিনীকরণ করা হলে ক্রিকেটের বর্তমান খোলনলচে বদলে যাওয়ার পাশাপাশি তার কদর ও কাটতি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে৷ ক্রিকেট খেলা নিয়ে তাদের যথেষ্ট ফ্যাসিনেশন রয়েছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা ক্রিকেটের চর্চা করে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেট দল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এসব বিবেচনা করে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দুই আয়োজক দেশের একটি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নেয়া হয়েছে। অন্যটি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যদিও যতই মাখামাখি ও হৃদ্যতা থাকুক না কেন, ব্রিটিশদের খেলা হিসেবে পরিচিত ক্রিকেটকে মার্কিনিরা কতটা আপন ভাবতে পারবে, তা নিয়ে অবশ্য সংশয় রয়েছে।
সাবেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশের অংশ বাংলাদেশ ক্রিকেটে কেন এত পিছিয়ে আছে? ব্রিটিশদের দখলকৃত ঔপনিবেশ ছিল এই উপমহাদেশ। অর্থাৎ আজকের ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ। ১৯০ বছরের শাসনামলে তারা এ অঞ্চলের মানুষদের ক্রিকেট খেলায় বেশ ভালোভাবেই আগ্রহী ও দীক্ষিত করতে পেরেছে। সেই ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশের তিনটি দেশই ক্রিকেটের অভিজাত ঘরানায় স্থান করে নিয়েছে; কিন্তু ভারত আর পাকিস্তান যতটা দাপুটে দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে, বাংলাদেশ তেমনটা পারছে না। অথচ ভারতীয় উপমহাদেশের পর, পাকিস্তান আমলে পূর্ব-বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানে ক্রিকেটের চর্চার কোনো কমতি ছিল না। ব্রিটিশ রাজের আমলে পূর্ব-বাংলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ক্রিকেট। পৃষ্ঠপোষকতায় প্রধানত এগিয়ে আসে জমিদার ও ধনিক শ্রেণি।
পরবর্তী সময়ে ক্রিকেটে পাকিস্তান দলের সাফল্যে আপ্লুত ও উজ্জীবিত হয় তদানীন্তন পূর্ব-বাংলা এবং পরবর্তীকালে পূর্ব-পাকিস্তানের ক্রীড়ানুরাগীরা। অনেকের কাছে ক্রিকেট হয়ে ওঠে ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। বিশেষ করে বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে ক্রিকেটের লালনকেন্দ্র। তারপরও এ মাটিতে ক্রিকেট শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরে কোনো বাঙালি ক্রিকেটার টেস্ট খেলার সুযোগ পাননি। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের সঙ্গে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি ক্রিকেটাররা একদমই সুবিধা করতে পারেননি। সেই সময় পাকিস্তান টেস্ট ক্রিকেট দলের প্রথম অধিনায়ক আবদুল হাফিজ কারদার নিয়মিতই খেলতে ও বিভিন্ন কাজে পূর্ব-পাকিস্তান সফরে আসতেন। তিনি সেই সময় মন্তব্য করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জলবায়ু, কন্ডিশন ও অন্যান্য বিষয় ক্রিকেট খেলার অনুকূলে নয়। যদিও পরবর্তীতে এ মন্তব্য থেকে তিনি সরে আসেন।
আদতে দীর্ঘ সময় ক্রিকেটের সংস্পর্শে থেকে এবং এর চর্চা ও অনুশীলন করেও বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাঝে মাঝেই চমক সৃষ্টি করলেও আজ অব্দি বড় কোনো টুর্নামেন্টে শিরোপা কিংবা বিশ্বকাপে আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। বাংলাদেশের খেলায় কোনো ধারাবাহিকতা নেই। জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায়। আইসিসি ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপে টুকটাক সাফল্য পেলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স একদমই হতাশাজনক। শুধু বিশ্বকাপেই নয়, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেই বাংলাদেশের পারফরম্যান্স অনুজ্জ্বল।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টি–টোয়েন্টি সিরিজ হার, প্রস্তুতি ম্যাচে ভারতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ—এমন সব পারফরম্যান্সের পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নিজেদের প্রথম ম্যাচেই জয় তুলে নেয়াটা গৌরবের। তবে শেষ হাসি উবে যাওয়ার দশা হয়েছিল। কারণ শ্রীলঙ্কার ৯ উইকেটে ১২৪ রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশ একপর্যায়ে হাতে ২ উইকেট রেখে ১২ বলে ১১ রানের সমীকরণে ছিল। এই অবস্থায় যেকোনো কিছুই ঘটতে পারত। যা হোক বাংলাদেশের বিজয় হয়েছে এটাই আনন্দের। কিন্তু এটা তো ঠিক, শক্তির খেলায় বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা কখনোই আশার আলো দেখাতে পারেননি। আর টি-টোয়েন্টি তো শক্তি, সামর্থ্য ও সাহসের খেলা। সম্ভবত এ কারণেই ক্রিকেটের খুদে সংস্করণে বাংলাদেশ ম্লান হয়ে আছে। বাংলাদেশ দলের প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু জানিয়েছেন, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখনো পরিণত দল নয়।
অপরিণত দল নিয়ে এবার যুক্তরাষ্ট্র এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ মিশনে গিয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে প্রত্যাশা নিয়ে গেলেও চরমভাবে নিরাশ হয়ে ফিরেছে। প্রস্তুতি ম্যাচে দলের হাড্ডিসার অবস্থা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একটি বিশ্বকাপ তো হুট করে আসে না। প্রতিটি দলই এ জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নেয়। বিশ্বকাপে সেরা দল নিয়ে সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শনের চেষ্টার কমতি থাকে না। ছোট দলগুলোও স্মরণীয় কিছু করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের তো তার ব্যতিক্রম নয়। বরাবরই এমন প্রত্যাশা নিয়ে বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে আসছে। অবশ্য বিশ্বকাপ দল নিয়ে কমবেশি বিতর্ক হয়েছে; কিন্তু এবার বিশ্বকাপ শুরুর আগেই দলের মধ্যে হচপচ অবস্থা। যে উদ্যম, যে ইচ্ছেশক্তি, যে প্রফুল্লতা নিয়ে বাংলাদেশ দলের অংশ নেয়ার কথা, তার যথেষ্ট কমতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোথায় যেন ছন্দ কেটে গেছে। ক্রিকেটাররা খেলায় ঠিকমতো মনোনিবেশ করতে পারছেন না। নিজেদের মধ্যে খামতি রয়ে গেছে বোঝাপড়ায়। দলের প্রধান নির্ভরতা সাকিব আল হাসানের ‘সেকেন্ড হোম’ যুক্তরাষ্ট্রে নানান কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে খেলার প্রতি তার মনোযোগ সরে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সাকিব তো বরাবরই এমন কিছু না কিছু ভজঘট পাকিয়ে থাকেন। অবশ্য মাঠে নেমে তা পুষিয়ে দেন। বয়সের কারণে তিনি চাইলেও আগের মতো ম্যাজিক দেখাতে পারবেন কি না, সেটা তার বিবেচনায় রাখতে হবে।
আরও একটি বিশ্বকাপ খেলার ইচ্ছের কথা জানালেও সেটা কি তার কথার কথা? তা ছাড়া চাইলেও খেলার সক্ষমতা থাকবে কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে হতে পারে এটাই তার শেষ বিশ্বকাপ। ভারতের রোহিত শর্মা আর সাকিবই সব কটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছেন। বিশ্বকাপে সর্বাধিক উইকেট সাকিবের। সেই আলোকে এই বিশ্বকাপটি স্মরণীয় করে তোলার ক্ষেত্রে তিনি অনেক বেশি মনোযোগী হবেন বলে ক্রিকেটানুরাগীরা মনে করেন। দলকে চাঙা করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। অনুশীলনে গুরুত্ব দেয়ার পরিবর্তে দল যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের আনন্দ-ফুর্তিতে আছে বলে মিডিয়ায় এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে। ক্রিকেটাররা এমন মনোভাব পোষণ করলে দলের বিপর্যয় ঘটার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক: সম্পাদক, পাক্ষিক ক্রীড়াজগত
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে