Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

অফশোর ব্যাংকিং আইনের খসড়া

আয়কর আইন অগ্রাহ্য, এনবিআরের আপত্তি

Md. Zahidul  Islam

মো. জাহিদুল ইসলাম

শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ফশোর ব্যাংক ইউনিটের অর্জিত মুনাফা বা সুদের ওপর আয়কর বা অন্য কোনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আরোপিত হবে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৈরি করা অফশোর ব্যাংকিং আইন ২০২৪-এর খসড়ায় এ বিধান রাখা হয়েছে। খসড়ার ওপর স্টেকহোল্ডারদের মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামত পাওয়ার পর যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে।

তবে খসড়া প্রণয়নের আগে স্টেকহোল্ডারদের মতামত আমলে নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, অফশোর ব্যাংক আইন ২০২৪-এর খসড়া অনুমোদনের আগে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত যৌথ পরামর্শ সভায় আয়কর-সংক্রান্ত প্রস্তাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রতিনিধি আপত্তি জানিয়েছিলেন। সেই আপত্তি শুধু মতামত হিসেবেই গ্রহণ করে হয়েছিল, আমলে নেয়া হয়নি। পরবর্তীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে এনবিআরের কাছে খসড়া আইনের ‘কর ও শুল্ক হইতে অব্যাহতি’ সংক্রান্ত ধারার বিষয়ে মতামত জানতে চায়। এরপর এনবিআরের আয়কর অনুবিভাগের পক্ষ থেকে মতামত পাঠানো হয়েছে।

মতামতে আয়কর আইন ২০২৩-এর ধারা ৭৬ এর উপ-ধারা (২) উল্লেখ করে বলা হয়েছে, অন্য কোনো আইনে কোনো প্রকার কর অব্যাহতি প্রদান করা হলে সেই কর অব্যাহতি ততক্ষণ পর্যন্ত কার্যকর হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না এনবিআর সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অব্যাহতি-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। এই আইন অগ্রাহ্য করার কোনো আইনি সুযোগ নেই বলে এনবিআরের মতামতে জানানো হয়েছে। নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী, যে ক্ষেত্রে আয়কর আইন ব্যতীত অন্য কোনো আইনগত দলিলের বিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে কর অব্যাহতি প্রদান করা হলে অন্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণীকে অব্যাহতি প্রদান না করলে তা কার্যকর হবে না।

প্রস্তাবিত খসড়া আইনের দফা ১৩(ক)-তে বলা হয়েছে, অফশোর ব্যাংকিং ব্যবসায় অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট কর্তৃক অর্জিত সুদ বা মুনাফার ওপর আয়কর বা অন্য কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর আরোপ করা যাবে না। আইনের এই ধারার সঙ্গে একমত পোষণ করে না এনবিআর। মতামতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, এ ধরণের আইনি বিধানের প্রস্তাব রাজস্ব সংগ্রহে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং বিদ্যমান করভিত্তি দুর্বল করবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পরিচালিত সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিদ্যমান আইন অনুসারে করযোগ্য। বাংলাদেশের সব ব্যাংক তাদের অফশোর ইউনিট সহকারে এ যাবতকাল পর্যন্ত কর পরিশোধ করে আসছে। আকস্মিকভাবে এ ধরনের কর অব্যাহতি রাজস্ব আহরণকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

মতামতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি সাপেক্ষে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবসায় অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট কর্তৃক আমানতকারী বা বৈদেশিক ঋণদাতাদের প্রদেয় সুদ বা মুনাফা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ করমুক্ত থাকবে প্রতিস্থাপনের অনুরোধ করা হয়েছে।
এর আগে অফশোর আইনের খসড়ায় বলা হয়েছিল, আপতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন-অফশোর ব্যাংকিং ব্যবসায় অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট কর্তৃক আমানতকারী বা বৈদেশিক ঋণদাতাদের প্রদেয় সুদ বা মুনাফার ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর আরোপ করা যাবে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, কর অব্যাহতি কে পাবে, কে পাবে না; তা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশে শুধু আয়কর আইনের মাধ্যমে কর অব্যাহতি প্রদান করা যায়। অন্য কোনো আইন দিয়ে কর অব্যাহতির কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, একটা আইন হতে গেলে অনেকগুলো যৌথ পরামর্শ সভা হয়। আইনে পরিণত হওয়ার আগে যৌথ পরামর্শ সভা ছাড়াও স্টেকহোল্ডারদের সাথে মিটিং হয়। সেখানে যার যা মতামত তা দেবে। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

একটা আইন পাস হতে গেলে সকল স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ লাগে। তারপরই নির্ধারিত হবে কোনোটা কিভাবে হবে। এখানে এনবিআরসহ অন্যান্য প্রতিনিধিরা থাকবে। এর আগে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হওয়ার পর কর অব্যাহতি নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল। পেনশন স্কিমের আইন অনুযায়ী, স্কিমের টাকা কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত। তবে আয়কর আইনের ক্ষমতাবলে যে সব খাত অব্যাহতিপ্রাপ্ত, সেই তালিকায় ছিল না সর্বজনীন পেনশন স্কিম। পরে এনবিআর এসআরও জারি করে সর্বজনীন পেনশন স্কিমকে অব্যাহতি প্রদান করে।

উল্লেখ্য, অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের অভ্যন্তরে পৃথক ব্যাংকিং সেবা। বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ প্রদান ও বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ে। স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব হয় অফশোর ব্যাংকিংয়ে। ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতিমালা অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয় না। কেবল মুনাফা ও লোকসানের হিসাব যোগ হয় ব্যাংকের মূল মুনাফায়। জানা গেছে, ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে। ওই নীতিমালার আলোকে বিভিন্ন ব্যাংকে অফশোর ব্যাংক ইউনিটের কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। তবে ওই নীতিমালা জরিমানা ও শাস্তির বিধানটি দুর্বল ছিল। এখন পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বর্তমান নীতিমালায় দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে থাকা সম্পূর্ণ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকিং কার্যক্রম করতে পারবে। এক্ষেত্রে ঋণ বিতরণ ও আমানত নিতে পারবে; কিন্তু যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিতে হবে। ১৯৮৫ সালে এক আদেশে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট গঠনের অনুমোদন দেওয়া হয়। নীতিমালা না থাকায় ব্যাংকগুলো ইচ্ছামতো অফশোর ব্যাংকিং পরিচালনা করেছে। এর মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাংক অর্থ পাচার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের পরে প্রতিটি ব্যাংককে একটি নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এখন একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, অফশোর ব্যাংক ইউনিটের মাধ্যমে অর্জিত সুদ বা মুনাফার ওপর আয়কর বা অন্য কোনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আরোপিত হবে না। একইভাবে এই ইউনিটের আমানতকারী বা ঋণগ্রহীতাকে দেওয়া সুদ বা মুনাফার ওপর আয়কর, অন্য কোনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর দিতে হবে না। এ ছাড়া ওই ইউনিটের আমানতকারী বা বৈদেশিক ঋণদাতাদের হিসাবের ওপর শুল্ক ও লেভি আরোপ করা হবে না। খসড়া আইনে আরও বলা হয়েছে, কোনো অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট আইনের ব্যত্যয় ঘটালে সে প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ২ হাজার মার্কিন ডলার বা সমপরিমাণ বাংলাদেশি টাকা জরিমানা আরোপ করা হবে। আইনের বিধান লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রথম দিনের পর দ্বিতীয় দিন থেকে প্রতিদিনের জন্য ১০০ মার্কিন ডলার বা সমপরিমাণ দেশীয় মুদ্রা জরিমানা আরোপ করা হবে।

এ ছাড়া অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের কোনো পরিচালক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী জ্ঞাতসারে বাংলাদেশ ব্যাংককে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করলে সর্বোচ্চ ৫ হাজার মার্কিন ডলার বা সমপরিমাণ দেশীয় টাকা জরিমানা করা হবে। তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে এই ইউনিটের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর, ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করলে সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ ২ হাজার মার্কিন ডলার বা সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা করা হবে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, অফশোর ব্যাংক ইউনিটের নথি পৃথক ভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সময় অন্তর ইউনিট পরিদর্শন করতে পারবে। তবে পরিদর্শনকালে কোনো আমানতকারীর হিসাবের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বা আদালতের অনুমতি ছাড়া সরবরাহ করা যাবে না।

অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ইপিজেড, পিইপিজেড, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত গ্রহণ করতে পারবে। পাশাপাশি ঋণ দেওয়া, বিনিয়োগ, ঋণপত্র গ্যারান্টি, বিল ডিসকাউন্ট, বিল নেগোশিয়েন এবং অন্যান্য বৈদেশিক বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট বহিঃলেনদেন সেবা দিতে পারবে। এ ব্যাংকিং ইউনিটে যে কোনো বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব পরিচালনা করা যাবে। এর বাইরে অন্য কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ফান্ডেড বা নন ফান্ডেড ব্যাংকি লেনদেন করা যাবে না।

খসড়া আইনের বিধিনিষেধে বলা হয়েছে, তফশিল ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যক্তি অফশোর ব্যাংক ব্যবসা করতে পারবে না। লাইসেন্স পাওয়ার ৬ মাসের মধ্যে অফশোর ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। অন্যথায় লাইসেন্স বাতিল হবে। আর বাতিল বা স্থগিতের পর এর কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। লাইসেন্স ছাড়া অফশোর ব্যাংক শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না। লাইসেন্সের শর্ত পালন না করা এবং অফশোর ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করলে বাতিল হলে লাইসেন্স। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে স্বেচ্ছায় লাইসেন্স সমর্পণ করতে পারবে। তবে সংশ্লিষ্ট অফশোর ব্যাংকের দায়ের বিপরীতে পর্যাপ্ত সংস্থান থাকলে লাইসেন্স সমর্পণের অনুমোদন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ