সাপ্তাহিক ছুটির সামঞ্জস্যহীনতা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সমস্যা সৃষ্টি করছে
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশকে নানা সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রতিকূলে বিরাট ঘাটতি রয়েছে, এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে বাণিজ্য ঘাটতি থাকবেই। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমদানি ব্যয় এবং রপ্তানির আয়ের মধ্যে যে গ্যাপ সেটাই বাণিজ্য ঘাটতি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমাদের প্রতিকূলে ঘাটতি থাকবেই। কারণ আমরা প্রতি বছর যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করছি তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করছি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্যিক ভারসাম্য আমাদের প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ভোগব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই বর্ধিত ভোগব্যয় মেটানোর জন্য বাইরে থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের পণ্য রপ্তানি সেভাবে বাড়ছে না। ফলে আমদানি ব্যয় এবং রপ্তানি আয়ের মধ্যে সৃষ্ট ব্যবধান ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের আমদানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও সেই ব্যয় মেটানোর জন্য আমাদের খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয় না। কারণ প্রতি বছর প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে প্রেরণ করছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ পথে ২০ থেকে ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রতি বছর দেশে প্রেরণ করছে। এ ছাড়াও হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আসছে। ফলে আমদানি ব্যয় মেটাতে আমাদের তেমন একটা অসুবিধা হচ্ছে না। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পরিবার দেশে থাকে। তাদের চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতে হয়। আমদানি ব্যয় আমাদের অর্থনীতির একটি অংশ। দেশ উন্নয়নের পথে ধাবিত হলে আমদানি বৃদ্ধি পাবেই। আগামীতেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভারসাম্য আমাদের প্রতিকূলে থাকবে এতে চিন্তিত হবার কিছু নেই। সমস্যা দেখা দেয় তখনই যখন আমাদের রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ দুর্বল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি কিছু পণ্য আমদানির ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে বা এলসি খোলার ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ করেছে। এতে সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি ব্যয় কিছুটা হলেও কমেছে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, আমদানি কমাতে গিয়ে আমরা যেনো শিল্পে ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি ব্যাপকভাবে কমিয়ে না ফেলি।
কোনো কারণে আমদানি হঠাৎ করেই ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে কোনো আমদানি ব্যয় এভাবে বাড়ছে। অনেক সময় দেখা যায়, অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি না পেলেও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এর পেছনে অর্থ পাচার একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে। আমদানি বৃদ্ধি পাওয়াটা সব সময় খারাপ নয়। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে আমদানির আড়ালে যেনো কেউ অর্থ পাচার করতে না পারে। অর্থ পাচার যেভাবেই করা হোক না কেনো তা একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অর্থ পাচার বৃদ্ধি পেলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ বৃদ্ধি পায়। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পায়। অর্থ পাচার একটি দেশের অর্থনীতিকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কাজেই অর্থ পাচার কখনোই কাম্য হতে পারে না। তাই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে যেনো অর্থ পাচার না হতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভারসাম্য বাংলাদেশের প্রতিকূলে রয়েছে এটা কমিয়ে আনার জন্য আমাদের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় কাঁচামাল নির্ভর পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। একই সঙ্গে রপ্তানি গন্তব্য বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য সীমিতসংখ্যক পণ্য এবং সামান্য কিছু দেশ ও অঞ্চলের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমাদের নতুন নতুন রপ্তানি পণ্য ও রপ্তানি গন্তব্য খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগজুড়ে আছে তৈরি পোশাক; কিন্তু এই খাতটি আমদানি নির্ভর বলে জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। তৈরি পোশাক ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ তৈরি করা গেলে এই খাতের মূল্য সংযোজনের হার অনেকটাই বৃদ্ধি পাবে। এ ক্ষেত্রে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ অগ্রগতি সাধন করেছি। নিটওয়্যার খাতে মূল্য সংযোজনের হার ৮৪ শতাংশের মতো। আর ওভেনে এটা ৪০ শতাংশের মতো।
আমাদের আমদানি যতটুকু করা দরকার তা করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের আমদানি বিকল্প শিল্প স্থাপনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমদানি বিকল্প শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা যেতে পারে। আমদানি বিকল্প শিল্প স্থাপন করলেই হবে না সে সব শিল্পে উৎপাদিত পণ্য যাতে তুলনামূলক সস্তা এবং গুনগত মানসম্পন্ন হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। আমদানি বিকল্প শিল্প স্থাপন করার বিষয়টি উৎসাহিত করা হলেও কাউকে আমদানি বিকল্প শিল্পের নামে অতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ দেয়া যাবে না। আমাদের মূল বিবেচ্য বিষয় হতে হবে, আমদানিকৃত পণ্যই হোক বা আমদানি বিকল্প পণ্যই হোক ভোক্তা যেন তুলনামূলক কম মূল্যে উন্নত মানের পণ্য পেতে পারে। আমদানি বিকল্প শিল্প স্থাপনের নামে কোনো শিল্পকেই অতিরিক্ত প্রোটেকশন দেয়া ঠিক হবে না। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখিকরণ এবং নতুন নতুন রপ্তানি বাজার খুঁজে বের করার কথা অনেক দিন ধরে বলা হলেও এ ক্ষেত্রে আমাদেও সাফল্য খুবই কম। এই ক্ষেত্রে দৃষ্টি দিতে হবে। আগামীতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কঠিন চ্যালেঞ্জে মুখে পড়তে হবে। কাজেই আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ এবং গুনগত মান সম্পন্ন করতে হবে। আমাদের দেশে যেসব শিল্প-কারখানা স্থাপিত হচ্ছে তা যাতে পরিবেশ সহনীয় হয়। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো কারখানা স্থাপন করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। কার্বণ নিঃসরণ কম করে তা নিশ্চিত করতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নত দেশগুলোতে সাপ্তাহিক ছুটি হচ্ছে শনি এবং রোববার। আর বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটি হচ্ছে শুক্র ও শনিবার। সাপ্তাহিক ছুটির এই সামঞ্জস্যহীনতা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সমস্যার সৃষ্টি করছে। বিষয়টি আমাদের দেশে ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। পাকিস্তানসহ অনেক মুসলিম দেশে কিন্তু শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি নয়। শুক্রবার অফিস খোলা রাখা হয়। জুম্মার নামাজ আদায়ের জন্য আধা ঘণ্টা ছুটি দেয়া হয়। তারপর যথারীতি অফিস চলে। আমরা এমনিতেই পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে ১২ ঘণ্টা এগিয়ে আছি। শুক্র-শনিবার আমাদের দেশে সাপ্তাহিক ছুটি। আর পশ্চিমা দেশগুলোতে শনি-রোববার সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে তিন দিন এবং আরও ১২ ঘণ্টা মিলে সাড়ে তিন দিন কার্যত অফিস বন্ধ থাকে। এটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় তা নয়, জটিল করে তোলে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কিছু বিকল্প চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। আমরা অফিস সংক্ষিপ্ত আকারে খোলা রাখতে পারি। বন্ধের দিনগুলোতে স্বল্পসংখ্যক কর্মী দিয়ে অফিস পরিচালনা করা যেতে পারে। বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং আর্থিক লেনদেন করা যায় এমন কিছু কর্মীকে দিয়ে অফিস পরিচালনা করা যেতে পারে। এভাবে বিকল্প উপায়ে ইস্যুটিকে ম্যানেজ করে নেয়া যেতে পারে। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে ধর্মীয় কোনো সম্পর্ক নেই। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি রাখতে হবে ধর্মেও কোথাও এমন নির্দেশনা দেয়া নেই। সাপ্তাহিক ছুটি সপ্তাহের যে কোনো দিন হতে পারে। এতে কোনো সমস্যা নেই।
সম্প্রতি কিছু রাপ্তানি পণ্যের ওপর থেকে আর্থিক প্রণোদনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এটা নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। কিন্তু আমি মনে করি, এটা আমাদের রপ্তানির ওপর খুব বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে না। কারণ আজ হোক কাল হোক আমাদের এক সময় রাপ্তানি ক্ষেত্রে আর্থিক প্রণোদনা তুলে দিতে হবে। এটা বছরের পর বছর চলতে পারে না। আন্তর্জাতিক বাজারে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় আমাদের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। অন্যথায় আমাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হবে। সরাসরি আর্থিক প্রণোদনা না দিয়ে অন্যভাবে হয়তো তাদের সহায়তা করা যেতে পারে। যেমন কোনো একটি প্রশিক্ষণ একাডেমি তৈরি করা হলো সেখান থেকে দক্ষ কর্মীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে কারখানায় গিয়ে কাজ করল। এতে কারখানাগুলো দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত কর্মী পেতে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দর সারা বছর খোলা রাখা যেতে পারে। পরিবহন খাতে যে জটিলতা আছে তা নিরসন করা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের মতো শিল্পের জন্য আবশ্যিক উৎপাদন উপকরণগুলো যদি সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করতে পারি তাহলে সেটা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে