Views Bangladesh Logo

শুঁটকির উৎপাদনের সঙ্গে বেড়েই চলেছে আমদানি-রপ্তানিও

দেশজুড়ে উৎপাদন বাড়ছে সুস্বাদু, মজাদার ও পুষ্টিকর বিভিন্ন মাছের শুঁটকির। পাশাপাশি মাছের চাহিদা পূরণে আমদানি হচ্ছে ভারত ও মিয়ানমার থেকে। ইলিশের মতোই শুঁটকির স্বাদ গ্রহণে এদেশ থেকে মাছ নিয়ে যাচ্ছেন ভারতীয়রাও।

দেশের মানুষের বার্ষিক জনপ্রতি মাছের চাহিদা ২০ কেজি ৪৪০ গ্রাম। চাহিদার বিপরীতে বার্ষিক জনপ্রতি খাদ্য হিসেবে মাছ গ্রহণের পরিমাণ ১৮ কেজি ৯৪০ গ্রাম অর্থাৎ দেড় কেজি ঘাটতি থাকে। এই মাছের প্রায় পাঁচ শতাংশ আসে শুঁটকি থেকে।

বছরে প্রায় পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার টন মাছ আহরিত হয় সমুদ্র থেকে, যার ২০ শতাংশ শুঁটকি হিসেবে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়।

রাজধানীর রায়েরবাজার সাদেক খান শুঁটকি মাছের আড়তের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ দুলাল মিঞা জানান, শুঁটকির সবচেয়ে বড় চালান আসছে চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ ও কলমাকান্দা এবং রাজশাহী থেকে। বেশি শুঁটকি উৎপাদিত হয় সুন্দরবনের দুবলারচর এবং কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়ারচর, মহেশখালী ও নাজিরাটেকেও। উৎপাদন বেড়েই চলেছে পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায়ও। এছাড়া শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের নাটোরের সিংড়া চলনবিল, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারীর সৈয়দপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুরেও।

দেশি শুঁটকির মধ্যে সবচেয়ে দামি লাক্ষা ও রূপচাঁদার শুঁটকির উৎপাদনই বেশি। অত্যন্ত সুস্বাদু ও উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় এগুলোর দাম বেশি বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, মোহনগঞ্জ থেকে চ্যাপাশুঁটকি আর কিশোরগঞ্জ থেকে পুঁটিমাছের শুঁটকির বৃহৎ চালান আসছে। আর কম দামের শুঁটকি হচ্ছে মিশালি শুঁটকি। জনপ্রিয়তা রয়েছে লইট্টা, ছুড়ি, টেংরা, পুটি, বোয়াল, শোল, নোনা ইলিশ, সাগরের কাইক্কার শুঁটকিরও।

দেশে সাধারণত অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত শুঁটকি মাছ তৈরির মৌসুম। কমবেশি সবাই চ্যাপা ও লইট্টা শুঁটকির ভুনা খুবই স্বাদ করে খেয়ে থাকেন। অন্য শুঁটকির ঝোলও শহর ও গ্রামের মানুষের প্রিয় খাবার।

প্রতিবেশী দুই দেশ ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ও মিয়ানমার থেকেও শুঁটকি মাছ আসছে দেশে। মিয়ানমার থেকে বেশি আমদানি হচ্ছে লইট্টা, কাঁচকি ও ফাইসসা মাছের শুঁটকি। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকেও ভারতে শুঁটকি যাচ্ছে, বিশেষ করে পাহাড়ি রাজ্যগুলোতো।

মোহাম্মদ দুলাল মিঞা জানান, বঙ্গোপসাগরের পাশ ঘেঁষে প্রায় ১০০ একর বালুচরজুড়ে গড়ে উঠেছে নাজিরাটেকের শুঁটকিমহাল। দেশে উৎপাদিত শুঁটকির প্রায় ৮০ শতাংশই এখান থেকে যাচ্ছে সারা দেশে।

প্রতি মৌসুমে বিশেষ করে শীতের শুরুতে শুধু নাজিরাটেক শুঁটকিমহালেই মাছের গুঁড়াসহ ৫০-৬০ হাজার টন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি উৎপাদিত হয় যার বাজারমূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

ব্যবসায়ীরা আরও জানিয়েছেন, পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় গড়ে উঠেছে ২৬টিরও বেশি শুঁটকির খোলা, যেখানে কাজ করছেন দুই শতাধিক নারীশ্রমিকও।

এই দুই উপজেলার মাছ বেশ সুস্বাদু। বেড়ার সাতটি ও সাঁথিয়ার ১০টি বিলসহ নদী, হাওড় ও খালগুলো থেকে অক্টোবরের শুরু থেকেই মাছ ধরে শুঁটকি উৎপাদিত হয়ে আসছে।

শুঁটকি মাছ সংরক্ষণ ও পদ্ধতি সম্পর্কে মোহাম্মদ দুলাল মিঞা জানান, উচ্ছিষ্ট (পেটের পচনশীল নাড়িভুঁড়ি) অংশগুলো ফেলে দিয়ে তাজা মাছকে প্রখর সূর্যতাপের তপ্ত রোদে বা প্রকৃতির বাতাসে শুকানো হয়। পরে খাবারের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করাকেই শুঁটকি মাছ বলা হয়ে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই প্রাকৃতিক এই পদ্ধতিতে শুঁটকি উৎপাদন বা খাদ্য সংরক্ষিত হয়ে আসছে।

তিনি জানান, জেলেদের কাছ থেকে নদী, হাওড়, বিলের তাজা মাছ সংগ্রহের পর সূর্যের তাপে ও শুষ্ক পরিবেশে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে থাকেন শুঁটকিচাষিরা। প্রতি কেজি শুঁটকি মাছ তৈরিতে প্রকারভেদে তিন থেকে পাঁচ কেজি তাজা মাছের প্রয়োজন হয়। সংরক্ষণ পদ্ধতিতে নির্ভর করে শুঁটকি মাছ ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত খাবার উপযোগী থাকে।

ব্যবসায়ীরা জানান, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি রূপচাঁদার শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৩,০০০-৩,৫০০ টাকা ও লাক্ষা ৪,৫০০-৫,৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর পাইকারিতে প্রতি কেজি লইট্টার শুঁটকি ৬০০-৮০০ টাকা, চ্যাপা ৪৫০-৯০০ টাকা, বোয়াল ৭০০-৮০০ টাকা, শোল ৮০০-১১০০ টাকা, মলা ৬০০-৬৫০ টাকা, চাপিলা ৬০০-৬৫০ টাকা, বাইলা ৬৫০ টাকা, লবণ দেয়া নোনা ইলিশ ৪০০-৬০০ টাকা, ফাইসসা ৪০০-৫০০ আর কাঁচকি মাছের শুঁটকির কেজিপ্রতি দাম ৪৫০-৬০০ টাকা। সাগরের মাছের মধ্যে ছুরি ৭০০-৮০০ টাকা, কাকিলা ৬৪০ টাকা ও চিংড়ির শুঁটকি ৩০০-১,১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেন বিক্রেতারা।

প্রাচীনকাল থেকেই ভাতে-মাছে বাঙালি। বৈচিত্র্যময় বাঙালির লোভনীয় ও ঐতিহ্যের খাদ্যাভ্যাসেরও একটি এই শুঁটকি। বিশেষত শুঁটকি মাছের ভর্তা এদেশের ৮৫ শতাংশ মানুষেরই প্রিয় খাদ্য। তাই এর গুণগতমান উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ নেয়া হলে বাংলাদেশের শুঁটকি বিশ্বজুড়ে উচ্চ স্থানে গিয়ে দেশের অর্থনীতিতে আরও অবদান রাখতে পারে বলেও অভিমত শুঁটকিচাষি ও ব্যবসায়ীদের।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ