স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা
স্বাধীনতা দিবস উদযাপন এখন একটা পণ্যে পরিণত হয়েছে
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বর্ষীয়ান বাম রাজনীতিক। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি। ছাত্রজীবন থেকেই বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ- ডাকসুর প্রথম নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অথবা সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে তিনি সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাধীনতা দিবস উদযাপন নিয়ে সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রবণতা ও রূপান্তর নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজ। সাক্ষাৎকারটি ২৩ মার্চ ২০২৪, জুম প্ল্যাটফর্মে নেওয়া।
রাহাত মিনহাজ: স্বাধীনতা দিবসের মর্যাদা রক্ষায় রাজনীতিবিদদের দায় ও দায়িত্ব কী রকম বলে আপনি মনে করেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আপনি যে প্রশ্ন করেছেন, সেটার জবাবে যাওয়ার আগে আমি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে লাখো শহীদ তাদের জীবন দিয়েছেন, তাদের আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
আপনি জানতে চাচ্ছেন রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যটা আমি বলতে চাই। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন দুই ধারায় প্রবাহিত। একটা হলো আদর্শের রাজনীতি। যেটাকে ধারণ করে আমরা অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছি। আর কিন্তু পুরো দেশকে কাভার করে রাজনীতির প্রধান যে ধারা রয়েছে, সেটাকে আমি বলব, ব্যবসায়িক রাজনীতি। এটা হলো এক ধরনের ব্যবসা। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, অতি সম্প্রতি নির্বাচনের নামে যেসব ঘটনা হলো, তখন নির্বাচন কমিশন থেকে রিপোর্টগুলো আমরা পেয়েছি, তাতে দেখা যায়, একেকজন মন্ত্রী বা এমপি তারা তাদের সম্পদের পরিমাণ গত পাঁচ বছরে কেউ কেউ ৫০ গুণ, কেউ ১০০ গুণ, এমনকি কেউ একজন ১৩০ গুণ বৃদ্ধি করেছেন। তাহলে বাংলাদেশে এ ধরনের রাজনীতি যারা করছেন, তাদের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, রাজনীতি কিংবা মন্ত্রিগিরি-এমপিগিরি- এটাই হলো সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা।
আপনার প্রশ্নের জবাবে যদি তাদের আমি রাজনীতিবিদ হিসেবে গণ্য করি, তাহলে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনা-স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা-সাফল্য-অর্জন, এগুলোর বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। এটা সবাই জানে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের ভূমিকা ছিল খুবই প্রশ্নবিদ্ধ এবং একেবারেই কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, তারাই এখন বড় বড় কর্তৃত্বের আসনে। তবে এটাকে আমি রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করতে রাজি না বরং, রাজনীতির এ ষড়যন্ত্রগুলো সৃষ্টি হয়েছে যে শক্তিগুলোর কারণে, সেটাকেই আমি এর কারণ হিসেবে দায়ী করব।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
রাহাত মিনহাজ: একটু কি উদাহরণ দিয়ে, আরও পরিষ্কার করে বলা যায়?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: উদাহরণ হিসেবে আমি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কথা বলতে পারি। তখনো অনেকের মধ্যে ধারণা ছিল, দেশ তো বিরাজনীতিকরণের মধ্যে চলে গেছে। ব্লাডি পলিটিশিয়ানস- এসব শব্দ যে আইয়ুব খানের আমলে ব্যবহার করা হতো, তখনো বাংলাদেশের শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে এসব কথাবার্তা বলা হয়েছিল; কিন্তু মানুষ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি, গণজাগরণ মঞ্চ হঠাৎ করে কীভাবে তৈরি হলো। সুতরাং, এখনো আমি মনে করি, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দেশের রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবেই চিন্তা করে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অবস্থান যাতে সঠিক জায়গায় সুনিশ্চিত থাকে, তার জন্য মানুষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে আমি মনে করি। যে কারণেই গণজাগরণ মঞ্চ আবির্ভূত হয়েছিল। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়েছিল। কোনো সন্দেহ রাখবেন না, মানুষের মনের ভেতরের যে দেশপ্রেম, সেটা এখনো ষোলোআনা অটুট আছে। সেটা শুধু বিস্ফোরণের অপেক্ষা করছে।
রাহাত মিনহাজ: স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোতে দেখা যায়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নতুন প্রজন্মের যারা আছেন, তারা একরকম উৎসব করেন; কিন্তু এই দিবসগুলোর যে চেতনা, মহিমা, সেগুলো হয়তো তারা ধারণ করেন না। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আপনি নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে সাধারণভাবে যে উক্তিগুলো করেছেন, সেটাকে আমি সম্পূর্ণ সত্য বলে মেনে নিতে পারছি না। আমি মনে করি, প্রত্যেকটা মানুষ হৃদয়ে-অন্তরে এ দিবসগুলোকে তার স্বমহিমায় বিবেচনা করেন, গণ্য করেন। সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়। মানুষের মনের ভেতরে যে দেশপ্রেম তা তো প্রকাশ্যে আসে না। প্রকাশ্যে আসে সেগুলোই, যেগুলো প্রদর্শনবাদী আয়োজন। একটা গোষ্ঠীর কারণে দিবস উদযাপনটা একটা কমোডিটি বা পণ্যে পরিণত হয়েছে। মনে করেন, আমি লাখখানিক টাকা খরচ করে যদি একটা অনুষ্ঠান করি, তাহলে সেটার বিনিময়ে আমার প্রভাব বৃদ্ধি করে এক কোটি টাকা সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারব। সুতরাং দিবস উদযাপনের ভেতরে একটা স্বার্থভোগ এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ কীভাবে চরিতার্থ করা যায়, সে বিবেচনাটা সামনে চলে এসেছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো এ প্রবণতাটা থাকবে সেটা মেনে নিলাম; কিন্তু রাষ্ট্র-সরকার-রাষ্ট্রযন্ত্র সবাই একই কাজ করছে। এটা কেবল একটা দলের কথা না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি- সব দলই, দিবস উদযাপনকে একটা ইনভেস্টমেন্ট এবং ব্যবসাতে পরিণত করাচ্ছে। সমস্যাটা এই এখানেই।
রাহাত মিনহাজ: আমরা ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি। আপনি এদেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন এবং প্রত্যেকটা স্বাধীনতা দিবস দেখেছেন, পর্যবেক্ষণ করেছেন। ৫৩ বছরে এসে, আমাদের স্বাধীনতা দিবস পালন, উদযাপনের যে আয়োজন থাকে, এসব ক্ষেত্রে কোনো রূপান্তর বা পরিবর্তন আজকের দিনে আপনার চোখে পড়ে কি না?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের ভেতরে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, সেখান থেকে ব্যবসায়িক বিবেচনাগুলো ক্রমেই প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পরে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পলিসিটা নেয়া হয়। সে পলিসি হলো- টাকা বানাও, টাকা বানাও; কিন্তু এটার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করলে বলা হয়, টাকা হোক কিছু লোকের কাছে। এই টাকা চুইয়ে পড়তে পড়তে এক সময় গরিবের কাছে আসবে; কিন্তু সেই টাকা তো চুইয়ে নিচের দিকে আসছে না। সেই টাকা চলে যায় সুইজারল্যান্ড, কানাডা ও মালয়েশিয়ায়। এভাবে কিন্তু আমাদের দেশের সমস্ত শাসন-ক্ষমতা, অথনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে এই লুটেরা, ধনিক শ্রেণির হাতে। সে কারণে আমরা দেখতে পাই, দিবস উদযাপন বিষয়বস্তুর দিক থেকেও পরিবর্তন হয়েছে। এটা সবাই হিসাব করে লেনদেনের হিসাব দিয়ে।
আবার উদযাপনের ধরনটাও পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন আমার খুবই আপত্তি, একুশে ফেব্রুয়ারির আয়োজন নিয়ে। এদিন তো প্রভাতফেরি প্রধান আয়োজন হওয়ার কথা। বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রভাত শুরু হয় সূর্যোদয়ের সময়। মধ্যরাতে বা রাত ১২টায় না। এটা হলো ইউরোপিয়ান কালচার; কিন্তু আমাদের এখানে মধ্যরাতে, যখন টেলিভিশন থাকবে, লাইট থাকবে, তখন সবাই হুড়োহুড়ি করে। কীভাবে একটা বিশ্রী, কুৎসিত ঘটনাবলির জন্ম দেওয়া হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের ব্যাপারটাও সে রকম হয়।
রাহাত মিনহাজ: স্বাধীনতা দিবস পালন বা উদযাপন করা নিয়ে যদি আর কিছু বলতে চান...
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ছোটখাটো মনের অনেক দুঃখের কথা এখানে বলা যাবে। যেমন বিভিন্ন দিবসে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব অনুষ্ঠান হয়, সেখানে কাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়? অবশ্য দু-একটা অনুষ্ঠানে যে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, তা নয়; কিন্তু আমি তো দেখি সেখানে ভরে আছে আমলাতন্ত্রের লোকজন, সিভিল-মিলিটারি এবং বড় বড় সিআইপি (কমার্শিয়ালি ইমপোর্ট্যান্ট পারসন) লোকজন দিয়ে। যাদের কথা আমি আগেই বললাম, কোটি কোটি টাকা কামাই করছে, সেটা দিয়ে সে নিজেকে কমার্শিয়ালি ইমপোর্ট্যান্ট পারসন হিসেবে অধিষ্ঠিত করছে। এদেরই সমাবেশ সেখানে করা হচ্ছে; কিন্তু যারা ত্যাগের ভেতর দিয়ে এ দেশটাকে স্বাধীন করেছিল, সেই রিকশাওয়ালা, মুটে, মজুর, তারা হলো প্রান্তজন। তাদের স্থান এখানে নেই। এটাই হলো গোড়ায় গলদ।
রাহাত মিনহাজ: স্বাধীনতা দিবসে আপনার প্রত্যাশা কী?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমাদের দেশকে সমাজতন্ত্রের পথে গড়ে তুলতে হবে। এ অঙ্গীকার নিয়ে এ দেশ স্বাধীন করা হয়েছিল। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ঝাণ্ডা তুলে নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। সে পথ থেকে আমাদের দেশ একেবারে উল্টোপথে চলছে। আমি যখন ১৯৭২ সালে ডাকসুর ভিপি ছিলাম, তখন আমাদের স্লোগান ছিল, এবার দেশ গড়ার সংগ্রাম। সেই ভিত্তিতে যে কাজগুলো আমরা করেছিলাম, সেটা কনটিনিউ হয়নি, দুঃখজনক; কিন্তু সেটাই উচিত ছিল।
রাহাত মিনহাজ: স্যার আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আপনাকেও ধন্যবাদ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে