Views Bangladesh Logo

স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও গণতন্ত্রের খোঁজে বাংলাদেশ

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর আজও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অপেক্ষায় বাংলাদেশ। রাজনীতির নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আবারও নির্বাচন, ক্ষমতার পালাবদল এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় শুদ্ধতর শাসন ও সরকারি সেবা নিশ্চিতের প্রতীক্ষায় এই দেশ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, যে স্বপ্ন নিয়ে একাত্তরে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম, তা পূরণ হয়নি প্রায় সাড়ে ৫ দশকেও। বাহাত্তরের সংবিধানে আনা হয়েছিল যে মূলনীতিগুলো, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- সব রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় সেগুলোও লঙ্ঘিত হয়ে আসছে।

এই সুদীর্ঘ সময়কালে বারবার এসেছে একদলীয়, একনায়কতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা এবং সেনাশাসন। গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বারবারের গণতন্ত্রের পুনঃযাত্রাও থেমে গেছে। রাজনীতিতে নতুন মোড় এবং ইতিহাসের গতিপ্রকৃতির জন্ম দেয়া ঘটনাগুলোও ফিরিয়ে আনতে পারেনি জনগণের উন্নয়নের গণতন্ত্রকে।

সত্তরের নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ২৮৮টি আসন পেয়ে সারা দেশেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জান্তা সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে। বাঙালির আন্দোলন, মিছিল ও প্রতিরোধ-সংগ্রামে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে সারা পূর্ব বাংলা উত্তাল থাকে। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের জনসভায় বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে বর্বর সেনাবাহিনী পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম গণহত্যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালালে স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. রওনক জাহান বলেন, ১৯৭০ সালে নির্বাচনের পরে ক্ষমতার পালাবদলকে কেন্দ্র করেই কিন্তু সেদিন মুক্তিযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। ওই নির্বাচনই তাই স্বাধীন দেশের সংবিধানের মূলনীতিতে গণতন্ত্র স্থাপন এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার সুতিকাগার বলে মনে করেন অন্য বিশ্লেষকরাও।

ফের গণতন্ত্রের খোঁজ
সত্তরের নির্বাচনে গঠিত গণপরিষদের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে গঠিত প্রথম সংসদ গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে। তবে স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দলে একীভূত করা হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আরও অনেক দলকে, যেটি বাকশাল নামে পরিচিত।

এই সরকার ও রাজনৈতিক পদ্ধতি গণতন্ত্রের প্রতি বিরাট আঘাত বলে সমালোচিত হয় দেশ-বিদেশে। তবে বিপথগামী সেনারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করলে সেটি আর বাস্তবায়িত হতে পারেনি। বলা হয়ে থাকে মুজিব হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ডানপন্থি রাজনীতির খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে, শুরু হয় হারানো গণতন্ত্রকে ফেরানোর দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা বলেন, শেখ মুজিবের ক্ষমতা অল্প সময়ের মধ্যেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। তিনি তো গণতন্ত্র পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। তার আগেইতো তার রেজিমকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। বাম এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধজাধারীরা সেটি করেছিলেন।

লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘বাকশাল গঠনের পরে দেশের ওপর ফ্যাসিস্ট জুলুম আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। সব দল ও খবরের কাগজ বন্ধ এবং নিষিদ্ধ করে দিয়ে, লোকজনকে ধরপাকড় করে ব্যাপকভাবে জুলুম করেছিলেন সরকারপক্ষ। বাকশাল ছিল একনায়কতন্ত্র। সেজন্য মানুষই তা গ্রহণ করেনি।’

জিয়া-এরশাদের সেনাশাসন
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পাল্টা সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা কেড়ে নেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। এই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিকেই খোল-নলচে বদলে দেয়। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সামরিক শাসনের সূচনায় গণতন্ত্রের পিছুহটা এবং মধ্য-ডানপন্থি রাজনীতির আবির্ভাব ঘটে। তবে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রেখে নিজে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন।

কিন্তু এক বছর পরে ১৯৭৬ সালের ১৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি সায়েমকে সরিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে নেন। জিয়া সরকার ১৯৭৬ সালে ২৮ জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি জারি করলে নিবন্ধন ও রাজনীতির ছাড়পত্র পায় নতুন-পুরোনো অনেক রাজনৈতিক দল। এর পাঁচ মাস পরেই ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সরিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেই রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন।

জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাষ্ট্রপতি হবার দেড় বছরের মাথায় বিএনপি গঠন করেন। এই রাজনৈতিক দলটি নতুন এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগের প্রতি। ১৯৮০ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন জেনারেল জিয়াউর রহমান।

লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন জিয়া, যা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করে। জিয়াউর রহমান কখনো ধর্মশ্রয়ী রাজনীতি করেননি বরং তিনি বহুদলীয় রাজনীতি চালু করেছিলেন। তবে এটাও ঠিক যে, তার উদার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সুযোগেই দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তার আমলেই পুনর্জাগরণ শুরু করে।

তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসন জারি করেন। জেনারেল এরশাদ পূর্বসুরি জিয়ার ধাঁচেই রাজনীতি করতে প্রতিষ্ঠা করেন মধ্য-ডানপন্থি রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি। জেনারেল এরশাদ ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক শাসক। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।

নব্বই ও চব্বিশের গণআন্দোলন এবং ফের গণতান্ত্রিক যাত্রা
১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালের সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পুরো এরশাদের আমলে বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাকর্মীরা দফায় দফায় সেনাবাহিনীর হামলা ও নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৮৯ সালের ১০ অক্টোবর ছাত্রনেতা জেহাদের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় আন্দোলন বেগবান হয়। গড়ে ওঠে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। রাজনৈতিক দলগুলোও এই আন্দোলনে যোগ দিলে তীব্র গণঅভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হন।

দেশের ইতিহাসে তর্কাতীতভাবে প্রথম অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনে ১৯৯১ সালে গঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এটি ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচন। ফের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরে দেশ। ১৯৯৬ সালে আন্দোলনের মুখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনি ভিত্তি দিয়ে খালেদা জিয়ার সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।

গণতন্ত্র চালু থাকলেও ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ফের রাজনৈতিক সংকটে পার করে। এর সূচনা ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই। ২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি দায়িত্ব নেয়া সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদ সরকার ২০০৮ এর ডিসেম্বরে নির্বাচন দেয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে জয়লাভ এবং ২০০৯ সালের শুরুতে সরকার গঠন করে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. রওনক জাহান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই দেশে নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এই সরকারের কাছে প্রত্যাশার পারদ ছিল অনেক উঁচুতে; কিন্তু প্রায় ১৭ বছর টানা দেশ শাসন করলেও আওয়ামী লীগ তা তো পূরণ করতে পারেইনি, বরং ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে স্বৈরতন্ত্রের পথে গেছে, যার ফলে এসেছে চব্বিশের গণআন্দোলন। ক্ষমতা ও দেশ ছাড়তে হয়েছে প্রবল ক্ষমতাশালী শেখ হাসিনাকেও।

অপেক্ষার প্রহরে জাতি

বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই গণআন্দোলনের পরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠিত হয়েছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির পরে এটিকে তৃতীয় ‘কিংস পার্টি’ বলছেন অনেকে। তবে পার্থক্য হলো প্রথম দুটি এসেছে সেনা শাসনামলে আর এই পার্টি এসেছে ছাত্র-তরুণ নেতৃত্ব থেকে। দেশে যে সংস্কার এবং গণতন্ত্রের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তা নির্বাচন এবং পরের সরকারের ইচ্ছা এবং প্রজ্ঞার ওপরে নির্ভর করবে বলেও মন্তব্য তাদের।

গবেষক বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘শাসন ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের প্রয়োজনে যে সংস্কার দরকার, তা কতটুকু হবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে দেশের প্রয়োজনে এখন দরকার প্রয়োজনীয় সংস্কারটুকু শেষে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি। দরকার নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়া।’

প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত এবং যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন দরকার উল্লেখ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. রওনক জাহান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে সব শাসকই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন; কিন্তু তা করেছেন নিজেদের সুবিধা বিবেচনায়, জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নয়। এবার সুযোগ এসেছে। আমাদের উচিত জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের পথকে উন্মুক্ত করা।’

‘চব্বিশের গণআন্দোলন হয়েছে শুধু স্বৈরতন্ত্র পতনের জন্য নয়। হয়েছে অবাধ ভোটাধিকার, দুর্নীতিমুক্ত সরকারি দাপ্তরিক এবং অর্থনৈতিক সেবা পেতে। আর সবই সম্ভব হবে যোগ্য নেতৃত্ব ক্ষমতায় এলে। আর তাই সবার দৃষ্টি এখন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে। আন্দোলনের ফলতো নির্বাচিত সরকারের কার্যক্রমই বলে দেবে।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ