ভারত-পাকিস্তান বিবাদের প্রভাব পড়বে বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক রাজনীতিতে
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই কাশ্মীর, সীমান্ত সংঘর্ষ, সন্ত্রাসবাদ ও রাজনৈতিক বিভাজনকে কেন্দ্র করে দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি নতুন করে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হয় তবে শুধু ভারত ও পাকিস্তান নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশের ওপর এর ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে। অর্থনীতি, নিরাপত্তা, শরণার্থী সমস্যা, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা- সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনৈতিক প্রভাব
বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য করে, যার মধ্যে অধিকাংশই ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারত থেকে আসা পণ্যের জোগান ব্যাহত হলে বাংলাদেশের বাজারে বিশেষ করে কাঁচামাল, ওষুধ, কৃষিপণ্য ও ইলেকট্রনিক পণ্যের সরবরাহ সংকট দেখা দিতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে।
বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানকে সংযুক্ত করে গঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক পরিবহন রুটগুলো- যেমন বেনাপোল, চট্টগ্রাম বন্দর ও আগরতলা করিডোর- যুদ্ধের সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। এতে দেশীয় শিল্প, গার্মেন্টস খাত ও নির্মাণ শিল্পে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।
যুদ্ধের ছায়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। এতে বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) প্রবাহ কমে আসবে। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে যৌথ পর্যটন উদ্যোগ ও তীর্থযাত্রা বন্ধ হয়ে যাবে যা হাজার কোটি টাকার ক্ষতির কারণ হতে পারে।
নিরাপত্তা ও সামরিক চাপ
যুদ্ধ শুরু হলে ভারত তার পূর্ব সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করবে, যার প্রভাব বাংলাদেশ সীমান্তে পড়বে। সীমান্তে বিএসএফের তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে ফলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে আগের মতো মানুষজন ও পণ্য চলাচল ব্যাহত হবে। বাংলাদেশ সরকারকেও সীমান্তে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করতে হতে পারে।
যুদ্ধকবলিত অঞ্চলে চরমপন্থি গোষ্ঠী সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে থাকে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আবহে বাংলাদেশের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা স্লিপার সেল বা জঙ্গি সংগঠনগুলো সক্রিয় হতে পারে। পাকিস্তানপন্থি জঙ্গি সংগঠন যেমন জামাত-উল-মুজাহিদিন বা হিযবুত তাহরীর নতুন করে তৎপর হয়ে উঠতে পারে।
শরণার্থী সংকট ও মানবিক চাপ
যুদ্ধের সবচেয়ে বড় মানবিক ফলাফল হতে পারে শরণার্থী সংকট। ১৯৭১ সালে যেমন লাখ লাখ মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তেমনিভাবে পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও কাশ্মীর সীমান্ত অঞ্চল থেকে যুদ্ধের ভয়াবহতা এড়াতে হাজার হাজার মানুষ ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। নতুন করে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের ফলে যদি বাংলাদেশে শরণার্থী প্রবেশ শুরু হয়, তবে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে আবারও বাংলাদেশকে মানবিক দায়িত্ব পালনের জন্য চাপ দেয়া হতে পারে যা দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোর ওপর নতুন বোঝা তৈরি করবে।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। যে কোনো পক্ষকে সরাসরি সমর্থন করা হলে অন্য পক্ষের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে। বিশেষ করে ভারত বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যিক ও কৌশলগত অংশীদার হওয়ায় তাকে চাপে ফেলা সম্ভব নয়, আবার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থনে পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করাও অনেক সময় রাজনৈতিক দাবির অংশ হয়ে ওঠে।
ওআইসি, জাতিসংঘ, সার্কসহ আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলোতে বাংলাদেশকে দোদুল্যমান অবস্থানে থাকতে হতে পারে। যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নিয়ে উভয় পক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে দুঃসাধ্য।
সার্ক ও আঞ্চলিক সংহতির মৃত্যু
পাক-ভারত যুদ্ধ হলে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। এর ফলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ হারাবে। এমন পরিস্থিতিতে BIMSTEC-এর মতো বিকল্প প্ল্যাটফর্মকে শক্তিশালী করার দিকে নজর দিতে হবে।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেল ও বিনোদন সামগ্রী (যেমন বলিউড সিনেমা) সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন সাংস্কৃতিক নির্ভরতা কমবে অন্যদিকে দেশের মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির ওপর চাপ বাড়বে দর্শকদের চাহিদা মেটাতে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ভারতে চিকিৎসার জন্য যায়। যুদ্ধ শুরু হলে এ প্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যার ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে। জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা খাতে প্রস্তুতি নিতে হবে। যদিও ভারতের ভিসা জটিলতায় আগের তুলনায় এখন খুবই কমসংখ্যক মানুষ ভারতে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে মধ্যপ্রাচ্যসহ দক্ষিণ এশিয়ায় জ্বালানির সরবরাহ ও ট্রানজিট রুটে বিঘ্ন ঘটবে। তেলের দাম বিশ্ববাজারে বেড়ে যাবে, যার সরাসরি প্রভাব বাংলাদেশে ডিজেল, পেট্রোল ও রান্নার গ্যাসের দামে পড়বে।
সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো- এই দুটি দেশই পারমাণবিক শক্তিধর। যদি যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি থেকেই যায়। এর ফলে শুধু ভারত-পাকিস্তান নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ এবং তেজস্ক্রিয় বৃষ্টিপাতের মতো মারাত্মক পরিবেশগত সংকট দেখা দিতে পারে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অভিঘাত এককভাবে শুধু এই দুই দেশের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকবে না। আঞ্চলিক রাজনীতি, অর্থনীতি, নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও পরিবেশ- সব কিছুতেই এর প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের জন্য এটি হবে এক গভীর কূটনৈতিক ও মানবিক চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধ এড়াতে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক শান্তি প্রচেষ্টায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে এবং নিজস্ব স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত বিকল্প প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে- অর্থনীতি, সীমান্ত নিরাপত্তা, শরণার্থী ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি- সব দিক থেকেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ একটি ভৌগোলিকভাবে কৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত দেশ এবং ভারত ও পাকিস্তানের যে কোনো সামরিক উত্তেজনা বা যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের ওপর পড়বে। তিনি বলেন, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্যিক লেনদেন রয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে সীমান্তে নিরাপত্তা ও যোগাযোগ সমস্যার কারণে এই লেনদেন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, যে কোনো যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিতে চায়। এতে বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
যুদ্ধের ফলে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে যোগাযোগ ব্যাহত হলে জ্বালানির আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে, যার প্রভাব দেশের সাধারণ বাজারে পড়তে পারে বলেও তিনি মনে করেন।
যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে উদ্বাস্তু সমস্যা তৈরি হতে পারে যা বাংলাদেশকে মানবিক ও অর্থনৈতিক চাপে ফেলতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ভারত-পাকিস্তানের এই সংঘাতে বংলাদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে ভারতের আকাশপথে কোনো সমস্যা হয় কি না- সেটা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ মনে করে কূটনৈতিক দিক থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিত। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নিরসন করে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল অবস্থানে ফিরে আসবে বলে বাংলাদেশ আশা করে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে