Views Bangladesh Logo

ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ: পরমাণু অস্ত্রের আতঙ্ক এবং শক্তিধর দেশগুলোর ভূমিকা

Mohshin  Habib

মহসীন হাবিব

পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে ৭ তারিখ থেকে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা নিয়ে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো, এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে কোনো শক্ত মধ্যস্থতা, অথবা ডি-এক্সলেশনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। হ্যাঁ, চীন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইরান মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাগচি এরই মধ্যে দুদেশ সফর করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দুই দেশের সঙ্গেই টেলিফোনে যোগাযোগ রাখছেন। তারপরও দুই পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশের মধ্যে মধ্যস্থতার মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত করার উদ্যোগ পর্যাপ্ত মনে হচ্ছে না।

বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের উক্তি অনেককেই হতাশ করেছে। তিনি ভারত পাকিস্তান সংঘর্ষ নিয়ে বলেছেন, ‘নট আওয়ার বিজনেস’। অর্থাৎ তাদের মাথাব্যথা নয়। এ ধরনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তৃতীয় কোনো বড় রাষ্ট্রের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কারও এমন মন্তব্য ছিল অনেকটাই অস্বাভাবিক। অবশ্য তার একটি কারণ আছে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন। একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ, অন্যদিকে গাজা পরিস্থিতি এবং ইয়েমেনের হুতিদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এতটাই ব্যস্ত যে, এ মুহূর্তে এদিকে নজর দেওয়ার অবস্থায় নেই। তবে সেক্রেটারি অব স্টেট মার্কো রুবিওর দুদেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক টেলিফোন আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন, এটা একটা ভালো দিক।

অবস্থা যে ভালো না, তার অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। পাকিস্তানের ক্রিকেট লীগ পিএসএল সরিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড; কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাতের আমিরাত ক্রিকেট বোর্ড অনুমোদন দেয়নি। ফলে বাধ্য হয়েই পাকিস্তান এ বছরের পিএসএল স্থগিত করেছে। অন্যদিকে ভারত চলমান আইপিএল টুর্নামেন্ট বাতিল করেছে। আইপিএল একটি বড় টুর্নামেন্ট। এটি খুব ছোটখাটো কারণে বাতিল হওয়ার কথা না। অন্যদিকে দুই দেশেরই অসংখ্য ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই স্থবির অবস্থা ভারত পাকিস্তান কোনো দেশই মেনে নেবে না।

পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতার পর প্রায় ৮০ বছরে অন্তত চারটি বড় যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে এবং অসংখ্য ছোটখাটো সীমান্ত সংঘর্ষ ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৬ সালে এবং ২০১৯ সালে উরি এবং পুলাবমা হামলা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধে জড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এমনকি ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময়ও এতটা বিস্তৃত সংঘর্ষ হয়নি। কারগিল ওয়ার লাইন অব কন্ট্রোল এবং কাশ্মীর এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। বড় যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৭১ সালে।

এবারের এই যুদ্ধাবস্থা নানা কারণে অন্য কয়েকটি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের চেয়ে আলাদা। ১৯৪৭, ৬৫, অথবা ৭১ সালে কারও হাতে পুরো দেশ পুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। এখন আছে। এই সময় ড্রোন, নানা ধরনের আধুনিক শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র, অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান দুই দেশকেই অধিক আত্মবিশ্বাসী করেছে এবং যুদ্ধংদেহী করে তুলেছে। ইতিমধ্যে ভারত হামলা করেছে লাহোর, করাচিসহ পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি শহরে। অন্যদিকে পাকিস্তান ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারতের জম্মু, উদামপুর এবং পাঞ্জাবের পাঠানকোটে। এতটা গভীরে গিয়ে হামলা অবশ্যই বড় যুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়। এবারের এই যুদ্ধের আরও একটি বড় দিক হল, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনির ব্যক্তিগত জীবনেও খুবই মেজাজি মানুষ এবং ভারত বিদ্বেষী।

অন্যদিকে ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারও প্রচণ্ড পাকিস্তানবিরোধী। তাদের রাজনীতির একটি বড় অবস্থান পাকিস্তান বিরোধিতা। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সরকার মনে করে, কাশ্মীরের যত ধরনের নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে তা পাকিস্তানের উসকানিতে হয়ে থাকে। এ কথা ঠিক, ভারত জম্মু কাশ্মীরের অর্থনৈতিক অবস্থা পাল্টে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশকে ভারত বিরোধিতা থেকে সরিয়ে আনতে পেরেছে। জম্মু ও কাশ্মীর এলাকার মানুষ দেখতে পাচ্ছে পাকিস্তানের অধীন কাশ্মীরের অর্থনৈতিক চরম দুর্দশা চলছে, যার ফলে জম্মু কাশ্মীরের মানুষের মধ্যে পূর্বের তুলনায় সহনশীলতা অনেক বেড়েছে। ঠিক দুই বছর আগে কাশ্মীরে গিয়েছিলাম। সেখানে কাশ্মিরীদের মধ্যে আমূল পরিবর্তন দেখা গেছে।

জম্মু কাশ্মীরের রাস্তা-ঘাট অবকাঠামো পাল্টে গেছে, এমনকি ভারতের বহু বড় শহরের চেয়ে শ্রীনগর সুশৃঙ্খল ও পরিপাটি মনে হয়েছে। অন্যদিকে গোটা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে দরিদ্রের ছাপ সুস্পষ্ট। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা সত্যিই নাজুক তা ইনডেক্সের দিকে তাকালেই দেখা যায়। সেইসঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে ডুরান্ড লাইন নিয়ে আফগানিস্তানের সম্পর্ক খুবই অবনতি হয়েছে। বালুচিস্তানের স্বাধীনতাকামীরা বেশ কিছুকাল ধরেই তাদের আন্দোলনের গতি বাড়িয়েছে। প্রায়ই পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা ঘটনা ঘটে চলেছে। পাকিস্তান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বালোচ ইনসার্জেন্সির পেছনে ভারতের হাত রয়েছে।

দুদেশের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আরও একটি বিপজ্জনক দিক হলো, দুই দেশের জনগণই সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে, অর্থাৎ ভারতীয়রা চাপ দিচ্ছে ২২ এপ্রিল পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার পূর্ণ প্রতিশোধ নিতে, অন্যদিকে পাকিস্তানের জনগণও চাচ্ছে ভারতকে ৭ মে হামলার সমুচিত জবাব দিতে। এর পেছনে একটি বড় কারণ হলো সোশ্যাল মিডিয়া। দুদেশের সরকারই সোশ্যাল মিডিয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং নিজেদের জয়ের গল্প শোনাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিপক্ষ কী কী অন্যায় করেছে সেই বয়ান দিয়ে চলেছে। ফলে জনগণ প্রকৃত সংবাদ থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি নিজেরাও সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদের মাধ্যমে মারমুখী হয়ে উঠছে।

জেডি ভ্যান্স যতই বলুক আমাদের মাথাব্যথা নয়, প্রকৃতপক্ষে সব অস্ত্র ব্যবসার দেশেরই এই যুদ্ধ নিয়ে প্রচণ্ড মাথাব্যথা আছে। ফ্রান্সের একটি অত্যাধুনিক রাফায়েল যুদ্ধবিমান পাকিস্তান ভূপাতিত করেছে। ফরাসি গোয়েন্দারা এই খবর যেন মিথ্যা প্রমাণিত হয় তার জন্য সর্বস্তরে চেষ্টা চালিয়েছে; কিন্তু দুদিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে যে রাফায়েল ভূপাতিত হয়েছে। দুই বাড়ির গরু যখন বিক্রির প্রশ্ন ওঠে, তখন কে চায় অন্য বাড়ির গরুর প্রশংসা করতে? বরং অন্য বাড়ির গরুর দুর্বলতা পেলেই তা প্রকাশ করাও একটি বাণিজ্য কৌশল। বরং যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে রাফায়েল বিমান ভূপাতিত করেছে চীনের জে-১০। দুটিই ৪ দশমিক ৫ জেনারেশন বিমান। এতকাল চীনের এই বিমানকে আন্ডার এস্টিমেট করলেও পশ্চিমা দেশগুলোর কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা দিয়েছে।

কারণ তাইওয়ান সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চীনের মুখোমুখি হওয়াটা অসম্ভব নয়। এখন গবেষণা চলছে কী ধনের কীট ব্যবহার করছে এই বিমান। তবে বিভিন্ন দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তির বিবৃতি দিলেও তারা দুই পক্ষে ভাগ হয়ে আছে। তুরস্ক ইতিমধ্যে পাকিস্তানকে বেশকিছু সামরিক সহায়তা দিয়েছে। পাকিস্তানকে তুরস্ক আসিসগার মডেলের ড্রোন সাপ্লাই দিয়েছে বলে ভারতের সামরিক মুখপাত্র কর্নেল সুফিয়া কোরেশি উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া ভারত পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যেই ২ মে তুরস্কের সি-১৩০ হারকিউলিস মিলিটারি এয়ারক্র্যাফট নানা মিলিটারি হার্ডওয়্যার নিয়ে পাকিস্তান এসেছে। অন্যদিকে ভারত ইসরায়েলের ড্রোন ব্যবহার করছে এবং ইসরায়েলের সামরিক সহায়তা গ্রহণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সীমান্তের দুপাশেই রাতদিন গোলাগুলি চলছে। রাত হলেই দুপাশের শহরগুলোতে ব্ল্যাকআউট চলছে। এ অবস্থা থেকে আশু মুক্তি প্রয়োজন শুধু ভারত পাকিস্তানের জন্য নয়, গোটা অঞ্চল এমনকি গোটা পৃথিবীর জন্যই। পরমাণু যুদ্ধ হবে না; কিন্তু কোনো একটি দেশ, বিশেষ করে পাকিস্তান চরম পরাজয়ের মুখে পরলে যে পরমাণু ব্যবহার করবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই এ যুদ্ধ আন্তর্জাতিক মহলকে থামাতে হবে। শুধু অস্ত্র বিক্রি ও বাণিজ্যের দিকে তাকালে হবে না। মানবজীবন রক্ষাও শক্তিশালী দেশগুলোর বড় দায়িত্ব। যদিও আমাদের অভিজ্ঞতা বলে সেদিকে খুব কমই নজর দেওয়া হয়েছে।


মহসীন হাবিব : সাংবাদিক, আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ