ইন্দিরা-তাজউদ্দীন বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের মহাপরিকল্পনা
ঢাকায় ভয়াবহ গণহত্যা শুরুর পর দীর্ঘ, দুর্গম এক পথ পাড়ি দিয়ে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় চুয়াডাঙ্গার ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছান তাজউদ্দীন আহমদ। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন তখনকার আওয়ামী নেতা ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। সন্ধ্যার পর ভারতীয় সীমান্তের অংশে তাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বিএসএফের আঞ্চলিক প্রধান, ডিআইজি গোলক মজুমদারের। প্রাথমিক আলোচনার পর গোলক মজুমদারের সঙ্গে তারা কলকাতায় যান। সেখানে তাদের সঙ্গে দেখা হয় বিএসএফের প্রধান কে এফ রুস্তমজীর (খুসরো ফারামুর্জ রুস্তমজী)।
রুস্তমজী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর খুবই বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। এরপর কলকাতায় আসাম হাউসে বিএসএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যে বৈঠক থেকে প্রাপ্ত তথ্য দিল্লির হাউকমান্ডকে অবহিত করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। এরপর সবুজ সংকেত পেয়ে ১ এপ্রিল রাতে আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি যান তাজউদ্দীন আহমদ। তাদের বহনকারী বিমানে ভারতীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন গোলক মজুমদার ও এস চট্টোপাধ্যায়। দমদম এয়ারপোর্ট থেকে একটি রাশান মালবাহী বিমানে করে তারা দিল্লির পথে রওনা হয়েছিলেন। তবে এই যাত্রার বিষয়ে বিশেষ গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছিল। দিল্লিতে তাদের রাখাও হয়েছিল একটু গোপনীয় স্থানে। তারা ছিলেন ভারতীয় প্রতিরক্ষা দপ্তরের একটি কলোনিতে, মূলত যা ছিল বিএসএফের একটি অতিথিশালা।
এ সময় দিল্লিতে কে এফ রুস্তমজী ও গোলক মজুমদার ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বৈঠকের বিষয়ে কাজ করেছিলেন। আর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ চেষ্টা করছিল তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের পরিচয় নিশ্চিত করার। কারণ রাজনৈতিক কাঠামোয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরই তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন দ্বিতীয় প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাই দিল্লিতে আসা এই ব্যক্তি আসলেই তাজউদ্দীন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন ছিল। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে এই নিবন্ধের লেখককে জানিয়েছেন, তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে ‘র’ তখন দিল্লিতে থাকা অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমানের সাহায্য নিয়েছিল।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ফলাফল নির্ধারণী দুই দফার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল তিন ও চার এপ্রিল ১৯৭১। বৈঠকটি হয়েছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফদার জং রোডের বাসভবনে। এ বৈঠকে তাজউদ্দীনের সহযোগী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন না। তবে ভারতীয় পক্ষে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বিএসএফের প্রধান কে এফ রুস্তমজী, ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্যসচিব পিএন হাসকার (পরমেশ্বর নারায়ণ), প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ও ‘র’এর একজন অফিসার। তিন এপ্রিল প্রথম বৈঠকের ধারাবাহিকতায় পরদিন চার এপ্রিল তাজউদ্দীনের সঙ্গে আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর স্টাডি রুমে অনুষ্ঠিত এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অনানুষ্ঠানিক এই বৈঠক সম্পর্কে ভারতের তরফ থেকে দাপ্তরিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। পরে তাজউদ্দীন আহমদের সহযোগী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ ও ভারতীয় সাংবাদিক মানস ঘোষের ‘বাংলাদেশ ওয়ার: রিপোর্ট ফ্রম গ্রাউন্ড জিরো’ থেকে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। অতি জরুরি এই বৈঠক নিয়ে কিছু আলোচনা আছে মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থেও। এই তিনটি গ্রন্থের তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের এক সাক্ষাৎকার প্রেক্ষাপটে জানা যায়, অনানুষ্ঠানিক ও খানিকটা গোপন এই বৈঠকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে যথাযথ সম্মান দেখান। আর বৈঠকের শুরুতেই তিনি তাজউদ্দীনের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন।
আলোচনার একপর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীকে জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব এর মধ্যেই বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয়েছে। আর এই সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ভারতীয় সরকারের কাছে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের জন্য অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ কামনা করছেন। একইসঙ্গে কামনা করছেন শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্য। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে তাজউদ্দীন আহমদ সরকার গঠিত হয়েছে এমন কথা বললেও আসলে সে সময় কোনো ধরনের সরকার গঠিত হয়নি। আগ বাড়িয়ে তাজউদ্দীন আহমদের এমন দাবিকে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বিশেষ করে শেখ মণির নেতৃত্বে যুবনেতারা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। যা নিয়ে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছিল।
আলোচনার এক পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীকে সরকার গঠিত হওয়ার কথা বললেও, তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, এই সরকার সম্পর্কে ভারতীয় ও বিশ্ববাসী খুব একটা জানেন না। তাই আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি ও সমর্থন, এমন কী ভারতীয়দের সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য এই সরকারের প্রকাশ্যে আসা উচিত। এ সময়ই ইন্দিরা গান্ধীই ইঙ্গিত দেন, এই সরকারের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সামনে শপথ নেওয়া জরুরি। প্রথম দিনের আলোচনায় তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে খুবই আশাব্যঞ্জক, ইতিবাচক সাড়া পান। সাংবাদিক মানস ঘোষের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম দিনের বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধী টানা প্রায় ৩০ মিনিট তাজউদ্দীনের কথা সর্বোচ্চ মনোযোগ সহকারে শুনেছিলন। যাতে তিনি বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কথা তুলে ধরেন। তুলে ধরেন স্বাধীন বাংলাদেশের যৌক্তিকতা।
আলোচনায় তাজউদ্দীন আহমদের দাবি দুটির বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধী ইতিবাচক মনোভাব দেখান। তবে তিনি একটি নিয়ামতান্ত্রিক সরকারের কথা বারবার উল্লেখ করেছিলেন। যাতে ভারতের অভ্যন্তরে ও বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সাহায্য পাওয়া যায়। আর এই বৈঠকের পরই ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও সেনাবাহিনীকে যথাযথ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কারণ এরপরই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দ্রুত অনেক ঘটনা ঘটতে থাকে। ৭ এপ্রিল থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতীয় সীমান্ত উন্মুক্ত করা হয়। ৮ এপ্রিলেই প্রবাসী সরকারের বিবৃতি ও দলিলের অনুবাদ সম্পন্ন হয়। একই সঙ্গে এ সময় সরকার গঠন সম্পর্কিত তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতি রেকর্ড করা হয়। যে বিবৃতি বা সরকার গঠনের ঘোষণা ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ বেতার যোগে সম্প্রচার করা হয়েছিল। এ ঘোষণা ১১ এপ্রিল আবার ‘আকাশবাণী’ থেকে পুনরায় সম্প্রচার করা হয়।
এদিকে বৈঠকের পরই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নগেন্দ্র সিংয়ের সহযোগিতায় একটি ডাকোটা বিমানে করে সীমান্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের খুঁজতে বের হন তাজউদ্দীন আহমদ। লক্ষ্য ছিল প্রবাসী সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। প্রথমে শপথ অনুষ্ঠান চুয়াডাঙ্গায় হওয়ার কথা থাকলেও পরে তা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে অনুষ্ঠিত হয়। যাত্রা শুরু করে মুজিবনগর সরকার। যদিও এই সরকারের পথচলা খুব একটা সহজ ছিল না। দলীয় কোন্দল থেকে শুরু করে নানা সমস্যায় এই সরকারের পথচলা কঠিন হলেও, ইন্দিরা গান্ধীর অকুণ্ঠ সমর্থনে এই সরকার অনেক বিপদ কাটিয়ে ওঠে। অনেকেই মনে করেন, তাজউদ্দীনের প্রতি ইন্দিরা গান্ধীর এই অগাধ আস্থা তৈরি হয়েছিল এপ্রিলের তিন ও চার তারিখ অনুষ্ঠিত ওই দুই দফার বৈঠকে, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে