Views Bangladesh Logo

সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত: দুই দেশে এর কতটা প্রভাব পড়তে পারে?

জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর বেশ কয়েকটি কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত সরকার। যার মধ্যে অন্যতম হলো ভারত-পাকিস্তান সিন্ধু জলচুক্তিতে স্থগিতাদেশ। নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে নিরাপত্তা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিএস) বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি একটি বিবৃতি জারি করেছেন। এই বিবৃতিতে তিনি বলেন যে, ভারত-পাকিস্তানের ১৯৬০ সালের সিন্ধু নদের জলচুক্তি তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্যভাবে সীমান্তে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করা বন্ধ না করা অবধি এই সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে।

সিন্ধু জলচুক্তি কী?

ব্রিটিশ আমলে দক্ষিণ পাঞ্জাবের সিন্ধু নদ উপত্যকায় একটি বৃহৎ খাল নির্মিত হয়েছিল। এর ফলস্বরূপ এই অঞ্চলটি পরবর্তীতে দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রধান কৃষিপ্রধান অঞ্চলে পরিণত হয়; কিন্তু ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের সময় যখন পাঞ্জাব বিভক্ত হয় তখন এর পূর্ব অংশ ভারতে এবং পশ্চিম অংশ পাকিস্তানের অংশ হয়। এছাড়াও দেশভাগের সময়, সিন্ধু নদী উপত্যকা এবং এর বিশাল খালগুলোও বিভক্ত হয়ে যায়; কিন্তু পাকিস্তান এখান থেকে যে জল পেত তার জন্য সম্পূর্ণরূপে ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল।


ফলে জলপ্রবাহ বজায় রাখার লক্ষ্যে, ১৯৪৭ সালের ২০ ডিসেম্বর পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রধান প্রকৌশলীদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর অধীনে, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, ভারত দেশভাগের আগের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানকে জলের একটি নির্দিষ্ট অংশ প্রদান অব্যাহত রাখবে। ১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল, যখন চুক্তিটি আর কার্যকর ছিল না, তখন ভারত দুটি প্রধান খালের জল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। যার ফলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাবের প্রায় ১৭ লাখ একর জমির পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে যায়।


যদিও পরবর্তী চুক্তির পর, ভারত জল সরবরাহ অব্যাহত রাখতে সম্মত হয় এবং আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় টানা ৯ বছরের আলোচনার পরে ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সই হয়েছিল ভারত-পাক সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তিতে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খান চুক্তি করেছিলেন। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় সই হওয়া ওই দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু এবং তার দুই উপনদী, বিতস্তা (ঝিলম) ও চন্দ্রভাগার (চেনাব) জলের উপরে পাকিস্তানের অধিকার ও কর্তৃত্ব থাকবে। ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকবে তিন উপনদী- বিপাশা (বিয়াস), শতদ্রু (সাটলেজ) এবং ইরাবতীর (রাভি) জল। চুক্তির শর্ত বলছে ভারত বা পাকিস্তান নিজেদের প্রয়োজনে ওই জল ব্যবহার করলেও কোনো অবস্থাতেই জলপ্রবাহ আটকে রাখতে পারবে না। এছাড়া এই চুক্তিতে সিন্ধু কমিশনও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই কমিশনের অধীনে, উভয় দেশের কমিশনারদের বৈঠকের প্রস্তাব ছিল। এতে আরও বলা হয়েছে যে যখন একটি দেশ কোনো প্রকল্পে কাজ করে এবং অন্যটির এতে কোনো আপত্তি থাকে তখন প্রথম দেশটি তার প্রতিক্রিয়া জানাবে। এর জন্য উভয় পক্ষের বৈঠক হবে। যদি বৈঠকে কোনো সমাধান না পাওয়া যায় তাহলে উভয় দেশের সরকারকে একসঙ্গে বিষয়টি সমাধান করতে হবে। এছাড়াও, এই ধরনের যে কোনো বিতর্কিত বিষয়ে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।


চুক্তির শর্ত বলছে ভারত বা পাকিস্তান নিজেদের প্রয়োজনে ওই জল ব্যবহার করলেও কোনো অবস্থাতেই জলপ্রবাহ আটকে রাখতে পারবে না; কিন্তু কিষেণগঙ্গা এবং রাতলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে ভারত জল আটকে দিচ্ছে বলে ২০১৬ সালে অভিযোগ করে পাকিস্তান। প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে নিরপেক্ষ দেশের পর্যবেক্ষকের দাবি তুলেছিল পাকিস্তান। ভারত ১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তির অ্যানেক্সচার এফ-এর ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ মেনে ‘নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ’ নিয়োগের প্রস্তাব মেনে নেয়; কিন্তু তারপরই একতরফাভাবে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল পাকিস্তান সরকার। ঘটনাচক্রে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নয়াদিল্লির অবস্থানে সায় দিয়েই ‘নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক’ জানান, পাকিস্তানের প্রাপ্য জল আটকাতে নয়, ভারত নিজেদের প্রয়োজনেই কিষেণগঙ্গা এবং রাতলে প্রকল্প নির্মাণ করেছে।

কী প্রভাব পড়তে পারে?


ভারতের এই জলচুক্তিতে স্থগিতাদেশ যদি দীর্ঘকালীন হয় তবে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে জলসেচ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ভয়ংকর প্রভাব পড়বে সেখানের কৃষিতে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ সংকট বাড়বে। সর্বোপরি সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত পাকিস্তানের ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হতে পারে। কারণ, সিন্ধু ও তার উপনদীগুলোর জলের ওপর পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ কৃষিই নির্ভরশীল! অন্যদিকে এই চুক্তি একেবারে বাতিল হলে বহুলাংশেই লাভবান হবে ভারত, এমনটাই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে মঙ্গলবারের পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় আদতে পাকিস্তানের সঙ্গে সাড়ে ছয় দশকের পুরনো সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তিতে স্থগিতাদেশ দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ