Views Bangladesh Logo

অর্ধবছরের পুরোটাই পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলনে উত্তাল ছিল শিল্পাঞ্চল

বেতন বাড়ানোর দাবিতে জুনে, এরপর জুলাইয়ে বিরতি দিয়ে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও নানা দাবিতে আন্দোলন করেছেন সাভার-আশুলিয়ার বেশকিছু কারখানার শ্রমিকরা। ফলে ২০২৪ সালের অর্ধবছর জুড়েই শিল্পাঞ্চলের রাজপথ ছিল তাদের দখলে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও ইনক্রিমেন্ট ৯ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাবনা এবং বার্ষিক ছুটির আর্থিক পাওনা নিয়ে তৈরি জটিলতা নিরসনসহ কয়েকটি দাবিতে নতুন বছরের প্রথম মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন শ্রমিকরা।

বিশেষ করে বেশি শ্রমিক অধ্যুষিত এবং ছোট ছোট কারখানাগুলোতে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। এতে দীর্ঘ অস্থিরতার পর বর্তমানে স্বাভাবিক থাকা শিল্পাঞ্চলের পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হওয়ার শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। প্রশাসনের দাবি, অতিদ্রুত পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।

গত বছর শ্রমিকদের এ আন্দোলন ছিল সাভার-আশুলিয়ার সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, কর্মবিরতি, কারখানা ভাঙচুরসহ বিক্ষোভ মিছিলের। নিত্যদিন যুক্ত হয়েছে সাধারণ ছুটির তালিকায়। আন্দোলনে মারাও গেছেন চারজন।

আন্দোলনের সূচনাকালে বেতন বাড়ানোর দাবিতে জুনের অধিকাংশ দিন পোশাকশ্রমিকরা মাঠে নামলেও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে ছিল পরিস্থিতি। তবে আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন পরবর্তী প্রায় পাঁচ মাসের প্রতিদিনই নিত্যনতুন দাবিতে তাদের মহাসড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ চলাকালে ঘটে সংঘর্ষের ঘটনাও। এতে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরজুড়ে সকালে চালু থাকলেও আন্দোলনের জেরে দুপুরে বন্ধ রাখতে হয়েছে কারখানা। অক্টোবর ও নভেম্বর দুটি কারখানার শ্রমিকরা নামেন মহাসড়ক অবরোধের প্রতিযোগিতায়। বকেয়া বেতন ও সার্ভিস বেনিফিটসহ নানা দাবিতে ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ৫২ ঘণ্টা নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন বার্ডস গ্রুপের শ্রমিকরা। ২১ ও ২২ অক্টোবর আশুলিয়ার বাইপাইল বাসস্ট্যান্ড অবরোধ করে রাখেন জেনারেশন নেক্সট লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা। তারা রাজপথে ছিলেন টানা ৩২ ঘণ্টা। এর এক দিন বাদেই বাংলাবাজার কারখানার সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন চারজন শ্রমিক। পরে একজন মারা যান।

নভেম্বর ও ডিসেম্বরেও অনেক কারখানার ভেতরে-বাইরে ছিল কর্মবিরতি ও বিক্ষোভসহ শ্রমিক আন্দোলন। এর মধ্যে বকেয়া বেতন, ওভারটাইম ও ছুটির টাকা পরিশোধের দাবিতে প্রায় চার ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখেন সাভারের বসুন্ধরা গার্মেন্টস কারখানার কয়েক শতাধিক শ্রমিক।

ডিসেম্বরের শেষ দিকে মালিকপক্ষ এবং বিজিএমইএ-বিকেএমইএ দাবিগুলোর অধিকাংশ মেনে নিলেও এখনো স্বাভাবিক উৎপাদনের ধারায় ফেরেনি শিল্পাঞ্চল।

আশুলিয়ার শারমিন গ্রুপের কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে ২০টি দাবি তুলে ধরেছিলেন শ্রমিকরা। তাদের দাবি ছিল, বৈষম্য ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধিসহ শ্রমিক মারা গেলে কোম্পানির দায়িত্বে গ্রামের বাড়িতে মরদেহ পাঠানো, চাকরিকালে কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার খরচ কোম্পানিকে বহন এবং মাতৃত্বকালীন ছুটির টাকা দিতে হবে আগেই। একই এলাকার নরসিংহপুরে নাসা গ্রুপের কাছে শ্রমিকরা দাবি রেখেছিলেন ১৫টি। এর মধ্যে ছিল বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) ১০ শতাংশ এবং ঈদের ছুটি ১২ দিন করা। এর কয়েকটি দাবির সঙ্গে মিল থাকলেও জিএবি লিমিটেড কারখানার শ্রমিকদের দাবিনামায় যুক্ত হয় আরও কিছু শর্ত। কর্তৃপক্ষকে দেয়া তাদের ১০ দফায় কারখানার খাবারে সপ্তাহে দুদিন গরুর মাংস, দুদিন মুরগির মাংস এবং দুদিন সবজির সঙ্গে ডিম দেয়ার দাবি তোলা হয়। পাশাপাশি জ্বর, মাথাব্যথার মতো সাধারণ সমস্যায় চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে এক দিনের ছুটি, বছরে একবার পিকনিকে যাওয়া, কমপক্ষে ১০ বছরের চাকরির নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছে।

আশুলিয়া ও সাভার থানা সূত্রের তথ্য, জুন এবং আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনায় ১৭টি মামলা করেছে পুলিশ ও কারখানা কর্তৃপক্ষ। শিল্পপুলিশ ৯টি ও থানা পুলিশ ৮টি মামলার তদন্ত করছে। আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪০ জনেরও বেশি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পোশাকশ্রমিক ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের ন্যায্য পাওনা আদায়ে আন্দোলন করছি। কিছুটা ভোগান্তি হলেও সাধারণ মানুষ আমাদের সমর্থন করেছেন। আমাদেরও পরিবার রয়েছে। একটা মাস কাজ করার পর বেতন সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা। এটা দিয়ে কীভাবে সংসার চালাবো? রয়েছে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচও। বেতনও মাঝে মাঝে ঠিকমতো পাওয়া যায় না। চার মাসেও টাকার মুখ দেখা যায় না। কিন্তু মালিকরা তো না খেয়ে থাকেন না।’

একটি কারখানায় বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয়বহুল দুপুরের খাবার দেয়ার দাবির স্বপক্ষে তারা বলেন, ‘আমরা দেশের সবচেয়ে মূল্যবান রপ্তানিপণ্য তৈরির কাজ করি। আমাদের চাহিদা সবার আগে পূরণের আগ্রহ থাকতে হবে। আমাদের শারীরিক সুস্থতা জরুরি। তাই দাবি জানিয়েছি।’

শিল্পপুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, ‘শ্রমিকদের আন্দোলন হয়েছে, এখনো হচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক করেছি। আরও চেষ্টা চলছে।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ