অসমতা ও শাসনকার্যে ঘাটতি
কয়েক যুগ ধরে সুশাসনের ধারণা বেশ গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে। যদিও তা সবসময় অধরাই ছিল। একটি দেশের উন্নয়নে অর্থনীতি ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ক্ষমতার ব্যবহারই শাসনকার্য বলে গণ্য হয়। সমস্যা হলো, বাংলাদেশে শাসন পরিচালন প্রক্রিয়া স্রেফ অকার্যকর। স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছর পেরোলেও ক্ষমতায় আসা সরকারগুলো জীবন বা সম্পদ, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যে নিরাপত্তা প্রদানে সক্ষম হয়নি। কঠিন সত্যটা হলো, যেসব সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারা দেশের বড় মাপের কোনো সমস্যারই সমাধান টানতে পারেনি। যদিও বাংলাদেশের জিডিপিতে অগ্রগতি ঘটে চলেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের দিকে গভীর নজর দিলে দেখতে পাই, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তারা ক্ষমতাসীন দল হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এতে দুর্নীতির অবসান, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনয়নের নিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক নীতিমালার মনোমুগ্ধকর প্রতিশ্রুতি থাকলেও যৎসামান্য অথবা কোনো পরিবর্তনের আশা নেই।
বর্তমান সরকার বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির দিকে বেশি আসক্ত; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই বাস্তবতা যে, সীমাহীন অসমতা যখন বিরাজমান তখন এই প্রবৃদ্ধি সবাইকে লাভবান করে না। অসমতা কেবল প্রবৃদ্ধিতেই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না, দারিদ্র্য বিমোচনের পথকেও সংকুচিত করে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরও অসমতা এবং দরিদ্রতা বৃদ্ধির অসংখ্য চিত্র রয়েছে বটে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সর্বোচ্চসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশীর দেখা মিলেছে, যাদের অস্থাবর বা তরল সম্পদের পরিমাণ এক কোটি টাকা বা তারও বেশি, এমনটাই জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। এবার প্রার্থীদের এ সংখ্যাটি ৫৭১, যা ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ২৭৪ জন ছিল। ওই বছরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি টাকার বেশি এমন প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৫২২ জন। ১ কোটি টাকার বেশি অস্থাবর সম্পদের মালিক সর্বোচ্চসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশী পেয়েছে আওয়ামী লীগ।
আমাদের সরকারের অকার্যকর ভূমিকায় রাজনীতি যেন কালো জাদুর শিকার হয়েছে। নামমাত্র দায়বদ্ধতা, সেকেলে শাসন পদ্ধতি, অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, বিচারিক ও আমলাতান্ত্রিক অযোগ্যতা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখতে পাই। বাংলাদেশে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আমরা অবলোকন করি; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর সুফল সবাই ভোগ করতে পারে না। আর এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সরকারের নীতিমালার মাধ্যমে বৈষ্যমূলক হয়ে উঠেছে, যা ব্যাপকভাবে অসমতা বৃদ্ধি করে। অসমতা বেড়ে যাওয়ার কারণে এখানে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আসন্ন ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশ। নির্বাচনি পরিবেশে উত্তেজনা বিদ্যমান। এখানে বিরোধী দল থেকে উদ্ভূত গতানুগতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির চাইতেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই দৃশ্যমান। বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের কারণে এই অস্বাভাবিক পরিবেশ ছেয়ে রয়েছে।
বিরোধী দল নির্বাচনি প্রতিযোগিতায় না থাকায় এই ভোট ‘অব দি আওয়ামী লীগ, ফর দি আওয়ামী লীগ অ্যান্ড বাই দি আওয়ামী লীগ’ নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই অনন্ত লড়াই এখন বাংলাদেশের সামাজিকব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। দেশের নানা সমস্যা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের যবনিকাপাতের দিকে রাজনৈতিক নেতাদের ধাবিত করেনি। নেতাদের প্রতি সংশ্লিষ্ট দলের সমর্থকদের অন্ধ বিশ্বাস গড়ে উঠেছে বলেই মনে হয়। এই অবস্থা তাদের অনেকটা ‘মৌলবাদী চরিত্রে’ পরিণত করেছে। ফলে সমাজে চরম পর্যায়ে মেরুকরণ ঘটছে। আর এ পরিস্থিতিই সুশাসনের পথে মূল চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশকে এমন এক বাস্তবতার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যেখানে সুশাসনব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ ও সুযোগকে প্রাসঙ্গিকভাবে এক সুতোয় বেঁধেছে। সত্যিকার কোনো বিরোধী পক্ষ না থাকায় আওয়ামী লীগের জন্য সুশাসন নিশ্চিতকরণ কঠিন হবে। আবার বিরোধী দলের বাধার সম্মুখীন না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য সুশাসন নিশ্চিতকরণের একটা সুযোগও তৈরি হবে বৈকি।
প্রথম এবং বৃহত্তম চ্যালেঞ্জটা হবে দুর্নীতি, যার বিষয়ে ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সম্মতি প্রকাশ করেছে। পৃথিবীর অনেক দেশ দুর্নীতির ভয়াল থাবার শিকার হলেও আমাদের ক্ষেত্রে এর পেছনে নিজস্ব কারণ বিদ্যমান। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণটা হলো দেশে আইনের শাসন ও এর প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ব্যক্তিরাই ক্ষমতার বলয়ে বিরাজ করছে। বেশিরভাগ সময়ই এই দুর্নীতিগ্রস্তদের পরিচয় প্রকাশ হয় না। বরং নিজেদের ক্ষমতা, পদ ও প্রভাব বিস্তার করে তারা শাস্তি থেকেও নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়। দুর্নীতিগ্রস্তদের শক্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণগত মান এবং প্রতিশ্রুতি না থাকায় বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র দুর্নীতি জাল বিস্তারের মূল হোতায় পরিণত হয়েছে। সমস্যা বা দুর্যোগ মোকাবিলায় সবচেয়ে দুর্বল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দেশ হিসেবে প্রায় সময়ই উঠে আসে বাংলাদেশের নাম। এর কারণ এই নয় যে আমাদের প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের অভাব রয়েছে। বরং এর কারণ এই দেশ ব্যবস্থাপনায় দুর্বল।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুটি বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। প্রথমটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নির্বাচনের বছরে মেরুকরণ। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত, যেহেতু মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। টাকার মানে ধস নেমেছে এবং এদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপজ্জনকভাবে তলানিতে রয়েছে। তবে দেশেটিতে ক্রমবর্ধমান ও শক্তভাবে টিকে থাকা অসমতা সৃষ্টির পেছনের মৌলিক কলাকৌশলগুলো সরকার না খুঁজে বের করলে সবকিছুই ভেস্তে যাবে। আর এ অসমতা রোধে কাজ করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় সৃষ্ট বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত এলিটদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ বাঞ্ছনীয়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে