বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
সংবাদ বন্ধ এবং সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতির ‘অনিবার্য কারণ’
৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের ঠিক চার দিন আগে গত ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলে যা ঘটেছে- তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সরকারের সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের বক্তব্যকে যেমন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে, তেমনি সাংবাদিকের প্রশ্ন করার স্বাধীনতা, এখতিয়ার ও সীমারেখার বিষয়টিও সামনে এসেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়ার এক মাস পরে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতিমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করুন। আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মিডিয়া যাতে কোনোরকমের বাধাবিপত্তি ছাড়া নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে, সেজন্য একটি মিডিয়া কমিশন করার ইচ্ছা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে।’
এর ঠিক দুই মাস পরে গত বছরের ১২ নভেম্বর সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম (পরবর্তীতে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক) বলেছিলেন, ‘গণমাধ্যমের ওপর সরকারের কোনো চাপ নেই। এই স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে গণমাধ্যমকে সাহসের সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে হবে।’ তথ্যের অবাধ প্রবাহের ওপর গুরুত্বারোপ করে নাহিদ বলেন, ‘সঠিক তথ্য ব্যাপকভাবে প্রচার না হওয়ায় গুজব ও অপতথ্যের দ্বারা মানুষ প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত হচ্ছে। গুজব ও অপতথ্য প্রতিরোধে গণমাধ্যমকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।’(প্রথম আলো, ১২ নভেম্বর ২০২৫)। গত বছরের ২৯ জানুয়ারি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে আবারও নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন প্রধান উপদেষ্টা। এদিন ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের নেতারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি তাদের বলেন, ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন নজিরবিহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে; কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্যের বন্যা বয়ে গেছে।’ (ইত্তেফাক, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫)।
আক্রান্ত গণমাধ্যম
জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে, বিশেষ করে গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে তার পরবর্তী সময়কালে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি গণমাধ্যমও আক্রমণের শিকার হয়েছে। তার জন্য প্রধানত সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠাগুলোকেই দায়ী করে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান ‘ফ্যাসিস্ট’ হাসিনা সরকারের অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। আরেকটি অভিযোগ এই যে, এইসব প্রতিষ্ঠানের কিছু সাংবাদিক ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য সরকার ও সরকারি দলের তোষামোদি করতে গিয়ে গণমাধ্যমের পেশাদারিকে ক্ষুণ্ন করেছেন। উপরন্তু তারা জুলাই আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনকারীদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের আক্রমণের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এসব কারণে বেশ কিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে।
অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে গত বছরের ২১ আগস্ট থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র অর্ধ মাসের মধ্যে শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রায় একশ সাংবাদিককে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ। বাকিগুলো রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সাতক্ষীরার থানায় দায়ের করা মামলা। এরপরে আরও একাধিক মামলায় সাংবাদিকদের আসামি করা হয়েছে। সবশেষ গত ২৭ এপ্রিল রাজধানীর মিরপুর থানায় দায়েরকৃত একটি হত্যা মামলায়ও শেখ হাসিনার সঙ্গে যে ৪০৮ জনকে আসামি করা হয়েছে, সেখানে ২৪ সাংবাদিকও রয়েছেন, যারা এর আগে দায়েরকৃত বিভিন্ন মামলার আসামি। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে ব্যাপক রদবদলও হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে কী হলো?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ২৮ এপ্রিল সোমবার সচিবালয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশি শর্টফিল্ম ‘আলী’র প্রদর্শনীর আমন্ত্রণ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন অংশ নেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত একাধিক সাংবাদিকের বরাতে বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে সাংবাদিকরা সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টার কাছে সাম্প্রতিক নানা ইস্যুতে প্রশ্ন করেন। সেখানে এক পর্যায়ে চ্যানেল চ্যানেল আইয়ের সাংবাদিক রফিকুল বাসার পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রায় শেখ হাসিনার মোটিফ প্রসঙ্গ তুলে সংস্কৃতি উপদেষ্টার কাছে জানতে চান, চারুকলায় পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রায় শেখ হাসিনার মোটিফ প্রদর্শন করার বিষয়টি ঠিক হয়েছে কি না এবং এর মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে কি না? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৪শ মানুষ খুন করার করার প্রসঙ্গ তুলে বলেন, তার সঙ্গে জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয়। এই ইস্যুতে তখন তার সঙ্গে তর্কে জড়ান দীপ্ত টিভির সাংবাদিক মিজানুর রহমান এবং এটিএন বাংলার রিপোর্টার ফজলে রাব্বিও।
এই ঘটনার পরে ওই তিন সাংবাদিকের ছবি দিয়ে পোস্ট করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানায় জুলাই রেভলিউশনারি অ্যালায়েন্স (জেআরএ)। চ্যানেলগুলো তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে তা দ্রুত জানানোরও দাবি জানানো হয় অ্যালায়েন্সের ফেসবুক পেইজে। যে পোস্টটি ওইদিন রাত থেকে অনেকে শেয়ার করেন। অনেকেই পোস্টের নিচে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। পরদিন ২৯ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুরে ওই তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেয়ার আল্টিমেটাম দিয়ে আবারো ফেসবুকে পোস্ট দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ‘মার্চ টু দীপ্ত টিভি, চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা’ কর্মসূচি পালনের হুমকি দেয়া হয়। মূলত এরপরেই দীপ্ত টিভির স্ক্রলে ঘোষণা দেয়া হয় যে, ‘অনিবার্য কারণবশত দীপ্ত টিভির সকল সংবাদ পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত স্থগিত।’ যদিও বেশ কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকার পরে ওইদিন রাত ১১টায় সংবাদ প্রচার শুরু হয়।
একই দিন দীপ্ত টেলিভিশন এবং এটিএন বাংলার দুজন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়। একই ঘটনায় চ্যানেল আইয়ের একজন সাংবাদিককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তদন্ত শুরুর কথা জানায় টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ। প্রসঙ্গত, একই দিন জুলাই রেভ্যুলিউশনারি অ্যালায়েন্স নামে এই ফেসবুক পেইজে দীপ্ত টিভির ডিজিটাল ইনচার্জ মাহমুদ শাওন (মাহমুদুর রহমান)-এর বিরুদ্ধেও একটি পোস্ট দিয়ে তাকে বিগত সরকারে দোসর আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়। এর কিছুক্ষণই পরেই এই পেইজে আরেকটি পোস্ট দিয়ে লেখা হয়: ‘ফ্যাসিবাদের দোসর দীপ্ত টিভির নিউজ ডিজিটাল ইনচার্জ মাহমুদুর রহমান শাওনের অব্যাহতিপত্র।’ সেখানে মাহমুদ শাওনের অব্যাহতিপত্রের স্ক্রিনশটও যুক্ত করে দেয়া হয়।
‘অনিবার্য’ কারণের ব্যাখ্যা কী?
বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ‘অনিবার্য’ শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে যা নিবারণ করা যায় না। অর্থাৎ এমন কিছু যা রোধ করা যায় না, অপরিহার্য বা অনিবার্যভাবে ঘটবে। অনিবার্য কারণের ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় এমন কারণ বা পরিস্থিতি, যা কোনোভাবে এড়ানো বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এই ধরনের কারণ সাধারণত বাইরের এমন প্রভাব থেকে সৃষ্টি হয়, যা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে এবং যার ফলে নির্ধারিত কোনো কাজ, সিদ্ধান্ত বা কার্যক্রম সময়মতো বা যথাযথভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হয় না। যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা হঠাৎ সরকার ঘোষিত জরুরি অবস্থা, পরিবহন ধর্মঘট বা যাতায়াতব্যবস্থায় বিপর্যয়, আকস্মিক অসুস্থতা বা দুর্ঘটনা, প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা বিদ্যুৎ বিভ্রাট ইত্যাদি কারণে কোনো একটি কাজ বা অনুষ্ঠান বাতিল বা স্থগিত করা হলে বলা হয়, অনিবার্য কারণবশত কাজটি করা গেল না।
কিন্তু কোনো টেলিভিশন চ্যানেল যখন ‘অনিবার্য কারণে’ তাদের সংবাদ প্রচার বন্ধ করে দেয়, তখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কী সেই অনিবার্য কারণ? সাধারণত টেলিভিশনের সংবাদ প্রচার বন্ধ করে দিতে পারে সরকার (বিশেষ করে বিটিআরসি) অথবা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেও এটি হতে পারে; কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় দীপ্ত টিভিসহ তিনটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকের প্রশ্নের বিষয় নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পরেই যখন কোনো টিভি চ্যানেল সংবাদ প্রচার বন্ধের ঘোষণা দেয়, তখন বুঝতে হবে ওই অনিবার্য কারণের পেছনে হয় সরকার কিংবা তার কোনো স্টেকহোল্ডারের চাপ রয়েছে, অথবা টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ সেলফ ডিফেন্স বা আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে কাজটি করেছে। দীপ্ত টেলিভিশন এই ক্ষেত্রে কী করেছে, সেটি তারাই ভালো জানে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখানে অনিবার্য কারণ বলতে তারা টেলিভিশন চ্যানেলে আক্রমণের ভয় পেয়েছে।
কেননা পেইজ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল যে, যদি ওই তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া না হয়, তাহলে ‘মার্চ টু দীপ্ত টিভি, চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা’ কর্মসূচি পালন করা হবে। সুতরাং সেই একই অনিবার্য কারণে যে তিনটি চ্যানেলের চার জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, এক সাংবাদিক গণহত্যার পক্ষ নিয়ে প্রশ্ন করার পরিপ্রেক্ষিতে দীপ্ত টিভির সংবাদ বিভাগ নিজেরাই সংবাদ সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। এতে সরকারের কোনো হাত নেই। আর সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতির বিষয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন: তাদের চাকরির ব্যাপারে সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোরকম সংশ্লিষ্টতা নেই।
অব্যাহতির কারণ
দীপ্ত টিভির সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে দেয়া মাত্র দুই লাইনের অব্যাহতিপত্রে লেখা হয়েছে, আপনাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো এবং কাজী মিডিয়া লিমিটেডের করপোরেট অফিস থেকে আপনার পাওনা বুঝে নেয়ার অনুরোধ করা হলো; কিন্তু কী কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো, তার কোনো ব্যাখ্যা এই চিঠিতে নেই। একইভাবে দীপ্ত টিভির মাহমুদুর রহমানকেও (মাহমুদ শাওন) যে অব্যাহতিপত্র দেয়া হয় সেখানেও একই ভাষায় তাকে চাকরিচ্যুত করা এবং অফিস থেকে পাওনা বুঝে নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়।সাধারণত কোনো সাংবাদিককে তার অপরাধের জন্য চাকরিচ্যুত করা হলে তাকে প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হয়। জবাব সন্তোষজনক না হলে তারপরে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হয়; কিন্তু দীপ্ত টিভি কর্তৃপক্ষ এখানে যা করেছে, সেটি প্রথমত সাধারণ নীতিমালা ও নীতি-নৈতিকতার যেমন পরিপন্থি, তেমনি শ্রম আইনেরও লঙ্ঘন। এদিন চ্যানেল আইয়ের ডিজিটাল পেইজের একটি ফটোকার্ড প্রকাশ করা হয়, যেখানে লেখা ছিল: ‘সংস্কৃতি উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন উত্তরপর্বে পেশাদারিত্ব প্রদর্শন না করার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের বিষয়ে চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষের তদন্ত শুরু ও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান।’
এখানে চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষ পেশাদারির পরিচয় দিয়ে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত না করে বরং বিষয়টি তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় এবং তদন্ত চলাকালীন ওই সাংবাদিককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তার মানে এটি ধরে নেয়া যায় যে, তদন্তে যদি তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন তাহলে তার চাকরিটা থাকবে। আর দোষী প্রমাণিত হলে চাকরিচ্যুত হবেন। একই ঘটনায় এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি ফজলে রাব্বিকে চাকরি থেকে বরখাস্তের চিঠিতে কারণ হিসেবে অফিস শৃঙ্খলা পরিপন্থি কার্যকলাপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, গত ২০১৬ সালের ৫ জুন এবং ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর তাকে সতর্কীকরণ এবং পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর ও ২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট পরপর দুবার তাকে চাকরি থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল; কিন্তু তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মানবিক কারণে বিশেষ বিবেচনায় চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়; কিন্তু এরপরেও তিনি রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ পেশাগত দায়িত্ব পালন না করায় গত ২৯ এপ্রিল থেকে চাকরি হতে বরখাস্ত করা হয়।এখানে তাকে বরখাস্তের কারণটি স্পষ্ট যে, এই সাংবাদিক এর আগেও একাধিকবার সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন এবং বিভিন্ন সময়ে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে; কিন্তু এবার যে ঘটনাটি ঘটলো, সেটি ‘অনিবার্য কারণ’। অর্থাৎ যা নিবারণ করা গেল না।
প্রশ্ন করার স্বাধীনতা
সংবাদ মাধ্যমের কাজই হলো প্রশ্ন করা। সে প্রশ্ন করবে ক্ষমতাকে। যার হাতে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষমতা আছে। রাষ্ট্র ও জনগণ যাদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করেছে বা যারা নানাভাবে ক্ষমতাবান হয়েছে- তাদের ক্ষমতা কোথায় কীভাবে প্রয়োগ হচ্ছে এবং সেই ক্ষমতার প্রয়োগ করতে গিয়ে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বকে তারা কোনো ধরনের অসুবিধায় ফেলছেন কি না; দেশ ও মানুষের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা; পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতিসহ নানা কাজের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ঠিকমতো তাদের কাজ করছেন কি না- সেই প্রশ্ন করাই সংবাদমাধ্যমের প্রধান কাজ।
যিনি এই প্রশ্ন করেন তিনি সাংবাদিক। ফলে তাকে নিরপেক্ষ, নির্মোহ, বস্তুনিষ্ঠ এবং দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। তিনি কোনো এটি বিশেষ দল বা গোষ্ঠী কিংবা কোনো একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দালাল কিংবা প্রতিনিধির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না। প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে তাকে তার পেশাদারি ও নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ড বিবেচনায় রাখতে হয়। ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লোভের ঊর্ধ্বে উঠে তাকে বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রাখতে হয়। যখন এখানে ব্যত্যয় ঘটে, তখন তিনি আর সাংবাদিক থাকেন না। তিনি তখন প্রচারকর্মী বা জনসংযোগ কর্মকর্তায় পরিণত হন। যখন কোনো সংবাদমাধ্যম প্রশ্নের বদলে নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য প্রশংসা ও স্তূতিতে বেশি সময় ব্যয় করে, তখন ওই সংবাদমাধ্যম প্রকারান্তরে কোনো একটি দল বা গোষ্ঠী কিংবা প্রতিষ্ঠানের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়। এখানেই একজন সাংবাদিকের সঙ্গে একজন পিআরও বা জনসংযোগ কর্মীর তফাৎ। এখানেই প্রচারযন্ত্র বা মুখপাত্রের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের পার্থক্য।
সম্প্রতি যে তিনজন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হলো, তাদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, তাদের প্রশ্নগুলো সাংবাদিকসুলভ ছিল না। পেশাদারির মানদণ্ডে উত্তীর্ণ ছিল না। প্রশ্নগুলো এক পর্যায়ে বাহাস বা তর্কে পরিণত হয়েছে। সাংবাদিকের কোনো একটি প্রশ্ন নিয়ে কি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তর্ক বা বাহাস হতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি থাকতে পারে; কিন্তু এখানে ইনটেনশন বা নিয়ত খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, সাংবাদিক কি সত্যিই দেশ ও মানুষের জন্য তার পেশাদারি বজায় রেখে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্নটা করছেন নাকি কোনো একটা বিতর্ক সৃষ্টি কিংবা কোনো একটি দল বা গোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে কথা বলছেন? সেটা অবশ্য প্রমাণ করা কঠিন। যে তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তারাও যে বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর হয়ে প্রশ্নগুলো করেছেন বা সরকারের একজন উপদেষ্টার সঙ্গে বাহাসে জড়িয়েছেন, সেটা প্রমাণ করা কঠিন।
মজার ব্যাপার হলো, ফজলে রাব্বিকে চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক মনিউর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের রিপোর্টার যখন প্রেস কনফারন্সে কাভার করেছে এটিএন বাংলার হয়ে। সে এই প্রশ্ন করার ব্যাপারে আমাদের সাথে কোন পরামর্শ তো করেনি। আমাদের চ্যানেল থেকেও এইরকম প্রশ্ন করতে বলা হয়নি। সেখানে সংস্কৃতি উপদেষ্টা একটা কথা বলেছে। সেটাকে পাল্টা প্রশ্ন করা বা এটাতে ডিজঅ্যাগ্রি করতে তো আমরা রিপোর্টারকে বলে দেইনি। রিপোর্টার হিসেবে আমাদের রিপোর্টার ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্নটা করেছে।’ (বিবিসি বাংলা, ২৯ এপ্রিল ২০২৫)।
তার মানে একজন রিপোর্টার সংবাদ সম্মেলনে কী প্রশ্ন করবেন, তিনি সেটা আগে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে যাবেন? তিনি সরকারের কোনো মন্ত্রী, উপদেষ্টা বা অন্য কোনো পদাধিকারীর বক্তব্যে ভিন্নমত পোষণ করলে সেটি তার ব্যক্তিগত অবস্থান হবে? সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠান তাকে প্রশ্ন করা বা ভিন্নমত পোষণের স্বাধীনতা দেবে না? সাংবাদিক শুধু অ্যাসাইনমেন্টে যাবেন আর সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা যা বলবেন সেটি শুনে এসে রিপোর্ট করবেন?
ধরা যাক, ওই প্রশ্নগুলো সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে করা হয়নি বা প্রশ্নগুলো ত্রুটিপূর্ণ। তারপরও কি শুধু প্রশ্ন করার জন্য একজন সাংবাদিকের চাকরি চলে যাবে? সরকার যতই বলুক যে তাদের চাকরিচ্যুতির পেছনে তাদের হাত নেই, বাস্তবতা হলো, যখন কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রে ভয়ের সংস্কৃতি বিদ্যমান থাকে; যখন মবতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং সরকারের বারবার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও মব বন্ধ হয় না- তখন যেকোনো একটি গোষ্ঠী হুমকি দিলে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যাম্পেইন শুরু করলে তাতে ভয় না পেয়ে উপায় থাকে না। তখন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আত্মরক্ষার্থে নিজেদের কর্মীকে বলী দেয়। ফলে সাংবাদিকের প্রশ্ন করার স্বাধীনতা, এখতিয়ার ও সীমারেখা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি গণমাধ্যমের নিজের সুরক্ষা নিয়েও কথা বলা দরকার।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে