Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

”মূল্য বেঁধে দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সফল হবে না”

Dr Qazi Kholiquzzaman   Ahmad

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

রবিবার, ১ অক্টোবর ২০২৩

বীরমুক্তিযোদ্ধা, অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশ  বিশেষজ্ঞ  ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান ও পল্লিকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি বাংলাদেশ উন্নয়নপরিষদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতিসহ উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ২০০৯ সালে দারিদ্র্য বিমোচনে একুশে পদক লাভ করেন এবং ২০১৯ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জাতীয় বেসামরিক সম্মাননা, স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।

সম্প্রতি তিনি দেশের অর্থনীতির অবস্থা,বৈদেশিক মুদ্রার  রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতির প্রভাবনিয়ে ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অর্থনীতি বিষয়ক লেখক এম এ খালেক ও ভিউজ বাংলাদেশের সহকারি সম্পাদক গিরীশ গৈরিক।

 ভিউজ বাংলাদেশ: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ দ্রুত কমে যাচ্ছে। এই অবস্থা কেন সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: দেখাই যাচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে স্থিতি কমে যাচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ২১ বিলিয়নে নেমে এসেছে, কয়েক সপ্তাহ আগেও ৩০ বিলিয়নের মতো ছিল। এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। আমি লক্ষ্য করি, অধিকাংশে ক্ষেত্রে দেশের অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সমস্যা সরকারিভাবে ঠিক মতোই চিহ্নিত করা হয় এবং সমস্যা দূরীকরণের জন্য নীতিগত বা কৌশলগত দিক নির্দেশনাও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সেই নীতি-কৌশল বাস্তবায়নে অনেক সময় নানা ঘাটতি বা অবহেলা ঘটে। যারা নীতি-কৌশল বাস্তবায়ন করেন তাদের কারো কারোর মধ্যে দক্ষতার অভাব থাকে অথবা অঙ্গিকারের অভাব থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং অঙ্গিকার উভয়ই অনুপস্থিত থাকে। ফলে সাফল্য অর্জনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। স্বভাবতই বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে স্থিতির দু’টি দিক হয়েছে: অর্জন বা তহবিলে জমা পড়া এবং বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় বা তহবিলে থেকে বিয়োজন। যে সব উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রা এই তহবিলে জমা পড়ে সেগুলো প্রধানত হচ্ছে রপ্তানি আয়, প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রেরিত রেমিট্যান্স এবং বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ, ঋণ ও সহায়তা। বৈদেশিক সহায়তা এখন অনেকটাই কমে গেছে।

 ভিউজ বাংলাদেশ: আমরা জানি, সরকার রপ্তানি বহুমুখী করার বিষয় দীর্ঘবছর ধরে শুধু আলোচনা করে যাচ্ছে, কিন্তু তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। সে ক্ষেত্রে দায় কার?

 কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ:বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আয় ৮০ থেকে ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাকের উপর নির্ভরশীল। এই খাতটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আমদানি নির্ভর হওয়ায় বার্ষিক বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তি থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খরচ হয়ে যায়। যা এই খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রায় ৪০ শতাংশ। রপ্তানি বহুমুখী করার বিষয় দীর্ঘদিন ধরে বহুল আলোচিত একটি বিষয় কিন্তু অগ্রগতি তেমন হয়নি এখনও এ কথা সত্য। তবে ঔষধ এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। দেশীয় কাঁচামাল ভিত্তিক পণ্য রপ্তানিতে প্রচেষ্টা আছে, অগ্রগতি সীমিত। দেখাই যাচ্ছে, এক্ষেত্রে করণীয় অর্থাৎ রপ্তানি বহুমুখীকরণ চিহ্নিত, কিন্তু অগ্রগতি সীমিত। রেমিট্যান্স থেকে প্রতি বছর যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে তার প্রায় শতভাগই বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলে নীট সংযোজন। কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রতি বছর যে বিপুল সংখ্যক জনশক্তি বিদেশে প্রেরণ করে তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ এবং অর্ধদক্ষ শ্রমিক। পেশাজীবী এবং দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানি করা হয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তাই তারা বিদেশে গিয়ে আয় করতে পারেন খুবই কম। পেশাজীবী এবং দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ করতে পারলে তাদের আয় এবং সেই কারণে রেমিট্যান্স অনেক বৃদ্ধি পেতো পারতো। এ বিষয়টি জানা এবং এই লক্ষ্যে নীতি এবং পদক্ষেপ রয়েছে। কিন্তু  এযাবৎ অগ্রগতি স্বল্পই হয়েছে। এছাড়াও বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে দুর্নীতিতে আক্রান্ত থাকায় যারা যান তাদের অনেকেই নানাভাবে প্রতারিত হয়ে থাকেন। উপরন্তুবাংলাদেশে বিভিন্ন শিল্প, ব্যবসায় ও সেবা প্রতিষ্ঠানে যে সব বিদেশি দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা কাজ করছেন তারা প্রতি বছর প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে জনশক্তি রপ্তানি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে প্রায় দেড় কোটির মতো বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন। তারা বিদেশে যেতে না পারলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তো হতই না বরংদেশের শ্রম বাজারে বেকারত্বের চাপ অনেক বেড়ে যেতো।

 ভিউজ বাংলাদেশ:: তারপরও তো ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশানুরূপভাবে বাড়ছে না বরং হুন্ডি পদ্ধতির প্রাধান্য অব্যাহত রয়েছে?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: এ কথা সত্য, রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ সরকারি প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ ব্যাকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে আসে না, আসে হুন্ডির মাধ্যমে। ফলে তা বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে জমা হয়না। সরকার ইতোমধ্যে প্রেরণ কি মওকুফ এবং মুদ্রা বিনিময় হারে যথেষ্ট ছাড় দিয়েছে (সম্প্রতি এক মার্কিন ডলারের বিপরিতে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ১১০ টাকা, রপ্তানি ও আমদানি ক্ষেত্রে কিছু কম)। কিন্তু তারপরও ব্যাংকিং খাতেরেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে না, বিপরীতে হুন্ডি পদ্ধতির প্রাধান্য বেড়েই চলছে।এমনটি কেন হচ্ছে? ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ প্রেরণ করলে প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে ১১০ টাকা পাওয়া গেলে ও হুন্ডির মাধ্যমে অনেক বেশি পাওয়া যায়। কার্ব মার্কেটে ডলার প্রতি বর্তমানে পাওয়া যায় ১১৮ টাকা বা তারও বেশি। তারা বিদেশে অক্লান্ত পরিশ্রম করে উপার্জন করে দেশে অর্থ প্রেরণ করেন, কাজেই তারা সাধারণত যেভাবে অর্থ প্রেরণ করলে ডলার প্রতি বেশি টাকা পাওয়া যায় সে পথই অনুসরণ করেন। তাদেরকে দেশপ্রেমের সবক দিয়ে লাভ নেই। বিশেষ করে, যখন দেশে দায়িত্বশীল পদে বা অবস্থানে থাকা অনেকে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি-চুরি করছেন এবং বিদেশে পাচার করছেন, যারা আরাম আয়েশে থাকেন, নানা সুযোগ-সুবিধাভোগ করেন।যারা বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ উপাজর্ন করেন তারা এক ডলারের বিপরীতে যেভাবে বেশি টাকা পাবেন সেপথই কেন অনুসরণ করবেন তা সহজেই অনুমেয়। এর সমাধান সহজ নয়, তবে সব দিক বিবেচনায় নিয়ে এর সুরাহা করার জন্য অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে চেষ্টা করতে হবে।  

ভিউজ বাংলাদেশ:: সে ক্ষেত্রে কি আমদানি ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: ইতোপূর্বে আমদানি ব্যয় অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে স্থিতি কমে যাওয়া ঠেকানোর লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ হিসেবে আমদানি কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ফলে আমদানি ব্যয় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অনেকটাই কমে গেছে। তবে আমদানি ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয়ার ফলে উন্নয়ন আমদানি যথা মেশিনারি, যন্ত্রাংশ এবং শিল্পে ব্যবহার করা হয় এমন কাঁচামাল আমদানি কমে যাচ্ছে বলে দেখা যায়। ফলে দেশজ উৎপাদন এবং প্রবৃদ্ধির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। সরকারের আমদানি নীতিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে কোন পণ্য আমদানি করা যাবে, কোনটি আমদানি করা যাবে না। কিন্তু কিছু ক্ষমতাবান অসাধু আমদানিকারক তাদের ইচ্ছে মতো আমদানি পণ্য তালিকা তৈরি করে সেই মোতাবেক পণ্য আমদানি করেন।  অনেক সময় ভূয়া ডিক্লারেশন দিয়ে পণ্য আমদানি করা হয়। অর্থাৎ সরকারি নির্দেশনা সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না। ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং-এর মাধ্যমে বিদেশে অর্থ জমানোর (পাচার) বিরুদ্ধে নেয়া সরকারি পদক্ষেপ অকার্যকর থেকে গেছে।সরকারি অর্থে বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করার নীতি গ্রহণ করা হলেও বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের বর্জনযোগ্য বিদেশ ভ্রমণ নানা অজুহাতে অব্যাহত রয়েছে। উল্লিখিত এবং অন্যান্য বিভিন্ন কারণে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্র্রা তহবিলে স্থিতির ক্ষেত্রে অস্থিরতা বিদ্যমান রয়েছে, অবনতি হচ্ছে। 

মনে রাখতে হবে, বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি বৃদ্ধির আরো একটি উৎস হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ এবং সহায়তা। বিদেশি বিনিয়োগ  সম্প্রতিকিছু বাড়লেও তা এখনো সীমিত। নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলেও বাংলাদেশে বিদেশি বিনিযোগ সীমিত থেকে যাচ্ছে নানান কারণে। একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, সময়ে সময়ে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা রাজনৈতিক অস্থিরতা। সম্ভাব্য বিদেশি বিনিযোগকারীদের এটা পছন্দ না করারই কথা। এছাড়া তাদের সামনে অন্যান্য দেশ রযেছে যেগুলো স্থিতিশীলতার বিবেচনায় অগ্রগণ্য। ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে এক ধরণের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করলেও আড়ালে অস্থিরতা বিরাজমান ছিল, যা বিশেষ করে নির্বাচনের সময় জেগে ওঠে। এছাড়া বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে এবং কিছু সহায়তাও আসছে তাও অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। যারা প্রকল্প বা কর্মসূচিগুলো বাস্থবায়নের দায়িত্বে থাকেন, তাদের কেউ কেউ গাফিলতি করেন, অপচয়ে লিপ্ত হন এবং দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে থাকেন।

 ভিউজ বাংলাদেশ: এসব নীতির ফলে তো দেশজ উৎপাদনের ইউনিট প্রতি খরচ বেড়ে যাবে। তাতে মূল্যস্থিতিও আরো বেড়ে যেতে পারে কি?

 কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: একটি মত আছে, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সম্পূর্ণভাবে বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া উচিৎ। যার ফলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়বে এবং বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।কিন্তু আমার কাছে এই মত খুব একটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। কারণ বর্তমান সময়ে বৈদশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের উপর পুরোপুরি ছেড়ে দিলে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটতে পারে। এতে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য অনেক বৃদ্ধি পাবে। সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। জাতীয় পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর যে চেষ্টা করা হচ্ছে তা আরো কঠিন হবে, বরং মূল্যস্থিতি আরো বেড়ে যেতে পারে। উন্নয়ন আমদানি খরচও বেড়ে যাবে, যার ফলে দেশজ উৎপাদনের ইউনিট প্রতি খরচ বেড়ে যাবে, যা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। এদিকে টাকা ছাপিয়ে সরকারি খরচ মেটানো মূল্যস্ফীতিআরো উস্কে দিয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এটা বন্ধ করা হবে। বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি বিষয়ে ফিরে আসি। আমদানি ব্যয় বাবদ প্রতি মাসে বর্তমানে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো খরচ হয়। ফলে যে স্থিতি রয়েছে তা দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হতে পারে। যেহেতু চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রারস্থিতি রয়েছে, কাজেই অবস্থা তেমন নাজুক নয়। অভিজ্ঞতার আলোকে সাধারণত তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি থাকলে তা গ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি বলে ধরা হয়ে থাকে। তবে সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে কিভাবে এই স্থিতি বাড়ানো যায়। যেভাবে অধোগতি ঘটছে, তা চলতে থাকলে এক্ষেত্রে বাস্তবতা একটি কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে।

ভিউজ বাংলাদেশ: বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশ থেকে অর্থ পাচার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। অনেকেই মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে এক শ্রেণির মানুষ যারা বিভিন্নভাবে সরকারি ছত্রছায়ায় অর্থ-বিত্ত কামিয়েছেন তারা তাদের সেই অর্থ বিদেশে প্রেরণ করছেন নিরাপত্তার কারণে। রিজার্ভ কমে যাবার পেছনে এটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করছে। আপনি কি বলবেন?

 কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: আপনি যে কথাটি বললেন এটা সত্যি হতে পারে। তবে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না। কারণ এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত আমার হাতে নেই। হুন্ডির মাধ্যমে অনেক অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। আমদানিকালে ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানিকালে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করা হচ্ছে বা  বিদেশ থেকে দেশের প্রাপ্য বৈদেশিক মুদ্রা আসছে না। বিভিন্ন পদ্ধতিতে অর্থ পাচার বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি জটিল সমস্যা। শুধু যে জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থ পাচার বেড়ে যায় তা নয়। সারা বছরই অর্থ পাচার হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলের স্থিতি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে বিদেশে পাচার করা সহজ নয়, তবুও আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইন ভয়েসিং-এর মাধ্যমে তা করা হয়। কার্ব মার্কেট থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করেও যে যোগসাজসের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হতে পারে। তবে আমি বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছি না। কারণ এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য আমার হাতে নেই।

 ভিউজ বাংলাদেশ:: এ সমস্যার পিছনে কি সরকারি নজরদারির অভাব রয়েছে?

 কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ:বস্তুত, বাংলাদেশে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যে যেভাবে পারছে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। বিদেশে পাচার করছে। দুর্বল হলেও সরকার নজরদারি করছে, কিন্তু কত জায়গায় নজরদারি করবে। আসলে আমাদের মূল্যবোধে প্রকট সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই যেভাবে পারছে নিজের সম্পদ ও ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টায় রত রয়েছেন। সরকার নীতিমালাও আইন প্রণয়ন করবে এবং বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু যারা প্রণীতনীতি ও আইন বাস্তবায়ন করবেন তাদের মধ্যে যদি নৈতিকতার সঙ্কট থাকে, অর্থাৎ সর্ষের মধ্যে যদি ভূত থাকে তাহলে সমস্যার সমাধান কেমনে হবে! সর্বস্তরে আমাদের নৈতিকতা সমুন্নত রাখতে হবে। যারাবিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাস্তবায়ন পর্যায়ে আছেন তাদের অনেকের মাঝে নৈতিকতার সঙ্কট আছে। এটা দূর করতে হবে। তবেই সম্মিলিতভাবে সমস্যার সমাধান এবং লক্ষ্য অর্জনে আরো সফলতা আসবে। অবস্থাদৃষ্টে আমার মনে মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে হয়তো এমন কিছু মানুষ বসে আছেন যারা শেখ হাসিনা সরকারের বিগত এক যুগের অর্জনকে প্রশ্ন বিদ্ধ করতে চান।

 ভিউজ বাংলাদেশ:: বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। বর্তমানে ১২ থেকে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। সম্প্রতি সরকার কিছু পণ্যের মূল্য বেঁধে দিয়েছে। এভাবে কি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব?

 কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: মূল্য বেঁধে দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা সফল না হওয়ারই কথা। কেননা দেশব্যাপী, এমনকি একটি শহরের যথা ঢাকার সর্বত্র বাজার নজরদারি করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। সুযোগ সন্ধানীরা নানা অজুহাতে অধিক মূল্য আদায় করে। সম্প্রতি কয়েকটি পণ্যের মূল্য বেঁধে দেয় সরকার, কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না বলে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির পেছনে মুদ্রা বিনিময় হার এবং বাজারে অধিক অর্থপ্রবাহ ছাড়াও একটি বড় ভূমিকা পালন করছে এক শ্রেণির ব্যবসায়িদের গড়ে তোলা চক্র। তারা বাজারকে ইচ্ছে মতো নিয়ন্ত্রণ করছে। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হয় শীঘ্রই বা আগামী মাস থেকে মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। এটা মূলত রাজনৈতিক বক্তব্য। এলক্ষ্যে দ্রুতঅগ্রগতির জন্যসরকারের গৃহীত পদেক্ষেপগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হতে হবে এবং বাজারে যারা কারসাজিতে লিপ্ত তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে যাতে বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে স্বাভাবিক আচরণ ফিরে আসে।

 ভিউজ বাংলোদেশ: আপনাকে ধন্যবাদ

 কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: ভিউজ বাংলাদেশেকেও ধন্যবাদ।

 

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ