খরচ কুলাতে না পেরে শিশুদের পাত থেকে ডিম-দুধ বাদ কেন?
কবি ভরতচন্দ্র রায়গুণাকর সেই মধ্যযুগে লিখেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ সন্তানের মঙ্গল কামনায় বাবা-মায়ের এই এক আকুল বাসনা যুগে যুগে, সন্তান যেন দুবেলা দুমুঠো ভালো-মন্দ খেয়ে বাঁচতে পারে। বাংলাদেশের অনেক মা-বাবারই এই এক গভীর দুঃখ, সন্তানকে তারা অনেক সময় ভালো কিছু খেতে দিতে পারেন না।
আর কিছু না হোক, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এক সময় সন্তানের জন্য একটু ডিম-দুধ বরাদ্দ ছিল। নিম্নআয়ের মানুষও তাদের সন্তানের মুখে সুযোগ পেলে একটু দুধমাখা ভাত তুলে দিতেন। একটি ডিম ভেজে তিন-চার ছেলেমেয়েকে খাইয়েছেন এমন মা বাংলাদেশে বিরল নয়; কিন্তু আজ আর সেটুকুও জুটে না অনেক পরিবারের।
গত বুধবার (২৩ অক্টোবর) পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, খরচে কুলাতে না পেরে শিশুদের পাত থেকে ডিম-দুধ বাদ দিয়েছে অনেক পরিবার। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারই এখন দৈনন্দিন বাজার খরচ কুলিয়ে উঠতে পারে না। সেখানে নিম্নআয়ের মানুষের কী অবস্থা? প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে নিত্যপণ্যের চড়া দামের কারণে দরিদ্র মানুষ সংকটে রয়েছেন। সেসব পরিবারে থাকা শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে পুষ্টি থেকে।
অনেক দিন ধরেই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। ডিম, ব্রয়লার মুরগি, তরল দুধ, চাষের মাছ- সবকিছুর দামই চড়া। স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর প্রাণিজ আমিষের উৎস মূলত ডিম, ব্রয়লার মুরগি ও চাষের মাছ। পরিবারগুলোর উপার্জনকারী সদস্যরা জানিয়েছেন, তাদের দৈনিক আয় ৩০০ থেকে ৬৫০ টাকা। আয়ের প্রায় পুরোটাই চলে যায় ঘরভাড়া ও খাবার খরচের পেছনে।
খাবার খরচ অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় তারা মূলত প্রাণিজ আমিষ খাওয়া কমিয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, দেশের মানুষের গড় আয়ের ৪২ শতাংশ ব্যয় হয় খাবারের পেছনে। পরিবারগুলোর আয় যত কম, খাবারের পেছনে ব্যয়ের অংশ তত বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দরিদ্র পরিবারের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব আরও বেশি।
কিন্তু শিশুর জন্য তো পুষ্টি জরুরি। মূলত বাড়ন্ত শিশুর খাদ্যতালিকায় ডিম, দুধের পাশাপাশি মাছ, মাংস এবং বিভিন্ন শস্যবীজ থাকা চাই। এগুলোর অভাব হলে শিশুকে বয়সের তুলনায় ছোট দেখায়। শিশুর মস্তিষ্ক গঠনের জন্য ছয় মাস বয়স থেকে প্রতিদিন একটি করে ডিমের কুসুম খাওয়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বৈশ্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজ করার জন্য ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার স্ত্রী এস্তের দুফ্লো। তারা দুজন একসঙ্গে একটি বইও লিখেছিলেন। বইটির নাম ‘পুওর ইকোনমিক্স’। সেই বইয়ে তারা দেখিয়েছেন, গরিবের ছেলেমেয়েরা বছরের পর বছর স্কুলে পড়েও কিছু শিখে না কেন? কারণ, প্রথমত পুষ্টিহীনতার কারণে তারা অসুস্থ থাকে বেশি, দ্বিতীয়ত পুষ্টিহীনতার কারণে তারা নতুন কিছু শিখতে পারে না।
তাদের মস্তিষ্ক সেভাবে কাজ করে না। দরিদ্রতার আরও অনেক সমস্যা তারা দেখিয়েছেন বটে, তবে ওই পুষ্টিহীনতা দরিদ্রতার একটি বড় চক্র। যেহেতু গরিব পুষ্টিহীন থাকে, তাই নতুন কিছু শিখতে পারে না, তাই তারা গরিব থাকে, আর গরিব থাকে বলেই তারা পুষ্টিহীন থাকে- এটাকে দরিদ্রতার একটি দুষ্টচক্র হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন।
তাই দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়; কিন্তু দরিদ্রতা দূর হয় না। দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ে, বড় বড় কথা হয়, সরকার বদল হয়; কিন্তু গরিবের দিন ফিরে না। আমরা চাই রাষ্ট্র আমাদের সন্তানদের দায়িত্ব নিক। কারণ তারা রাষ্ট্রেরও সন্তান। বিপুল বৈষম্য ঘুচিয়ে সমাজে কিছুটা সমতা প্রতিষ্ঠিত হোক।
আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্রগুলো অন্তত নাগরিকদের পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করেছে। যদি আমরা আমাদের সন্তানদের একটু পুষ্টিকর খাবার না দিতে পারি, এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কিছু হয় না। তাই আমরা চাই, যে করেই হোক দ্রব্যমূল্য কমানো হোক। বাজারে দুধ-ডিমের চাহিদা বাড়ানো হোক। শেষ প্রার্থনা এতটুকুই, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে