দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু মানবিক উন্নয়ন হয়নি
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। তিনি বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও দ্য ডেইলি সান পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিইউপিতে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও শিক্ষা পদ্ধতিসহ নানা বিষয় নিয়ে ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন। ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন লেখক ও সাংবাদিক রণজিৎ সরকার।
ভিউজ বাংলাদেশ: একটি গণতান্ত্রিক দেশের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভোট ও ভোটারের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: বাংলাদেশের জনগণের ভূমিকা ও ভোট সম্পর্কে আমার ধারণা স্পষ্ট সংবিধানের ৭/১ ধারায় বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল মালিক জনগণ’। প্রজাতন্ত্র শব্দটি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত এ দেশের ভোটারদের ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা খুব বেশি সুখকর নয়। সেজন্য ভোটারের হাতে ক্ষমতা দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। ভোটাররা নির্ধারণ করবে, কে থাকবে সরকারে আর কে থাকবে না।
ভিউজ বাংলাদেশ: স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট চলছে, উত্তরণের উপায় কী?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: বাংলাদেশে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নজর কাড়া। সেজন্য সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আদর্শের বিচ্যুতি ঘটেছে। আমার মনের বেদনার জায়গায় এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু মানবিক উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। সেজন্য কবির কথায় বলি, ‘জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা’। বাংলাদেশের জনগণকে প্রকৃত মানুষ গড়ে তোলার জন্য যে নীতি ও কার্যক্রম প্রয়োজন তা কোনো সরকার করেনি। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর আমলে কিছুটা দেখেছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সংকট দেখা দিয়েছে নির্বাচন নিয়ে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সংকট দূর করতে বড় দুই দলের কী করা উচিত বলে মনে করেন?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: দুটি দলের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি ও মতভেদের কারণে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আমি মনে করি, তাদের উচিত এই মুহূর্তে দেশ এবং মানুষের কল্যাণের জন্য সংকট নিরসনের জন্য যেকোনো পথ ও পন্থা খুঁজে বের করা দরকার। রাজনৈতিক সংকট রাজনীতিবিদদেরই মেটাতে হবে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ১৯৭১ সালের মার্চে যখন ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আলোচনা করছিলেন। বঙ্গবন্ধু সুগন্ধায় ভুট্টোকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘দেখো সংকটটা রাজনৈতিক। তুমি-আমি রাজনীতিবিদ, আমরা নিজেরাই এই সংকট নিরসন করি আলোচনার মাধ্যমেই। তা না হলে কিন্তু সেনাবাহিনীর লোকজন তোমাকেও মারবে, আমাকে মারবে।’ কথাটা সত্যি হলো। রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে সামরিক পদ্ধতিতে করতে চেয়েছিল পাকিস্তানিরা কিন্তু হয়নি। আমরা বিজয়ী হয়েছি। বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টোকে সামরিক বাহিনী হত্যা করেছে। সেজন্য আমি মনে করি, রাজনৈতিক সংকট যদি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করা হয় তাহলে অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজনৈতিক সমাধান অনিবার্য হয়ে উঠবে। এটা আমাদের কারও কাম্য নয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: আওয়ামী লীগ-বিএনপি পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশ করছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত হবে কীভাবে?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের শঙ্কা আছে। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা আছে। এই মুহূর্তে রাজনীতি আছে বলে মনে হয় না। আছে ক্ষমতা নীতি। যারা ক্ষমতায় আছে, তারা ক্ষমতায় থাকাটা দীর্ঘায়িত করতে চায়। আর যারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় নেই, তারা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে চায়। দুটি পদ্ধতি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না।
আমি যদি ভিন্ন প্রসঙ্গে বলি, যেমন-ফিলিস্তিনে যে সংকট চলছে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকারের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত ম্রিয়মাণ। প্রধানমন্ত্রী ওষুধ পাঠাতে বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে। ওষুধ গেল কি-না আমরা তা জানি না। অথচ বঙ্গবন্ধু নিজে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছিলেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বক্তব্য, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। সেই মানুষটি ১৯৭৩ সালে ২৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি মেডিক্যাল টিম পাঠালেন ফিলিস্তিনে এবং সৈন্যদের জন্য চা পাঠালেন। তখন বাংলাদেশে চায়ের সংকট চলছিল। সেই তুলনায় বর্তমান বাংলাদেশের যে অবস্থান তা অত্যন্ত ম্রিয়মাণ। আর বিএনপি-জামায়াত ফিলিস্তিনি ইসরায়েল নিয়ে কোনো মন্তব্যই করেনি। এটা আমাদের কাছে খুবই বেদনাদায়ক। একটি দেশের রাজনীতিতে দেশের কথা যেমন থাকবে তেমনি গোটা বিশ্বের কথাও থাকবে। নইলে সেটাকে আমি রাজনীতি বলতে নারাজ।
ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি তৃতীয় বা বিকল্পধারা তৈরি করলে দেশ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকট দূর হবে কি মনে করেন? তৃতীয় শক্তি কে বা কারা তৈরি করতে পারে?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: তৃতীয় শক্তি কথাটা বহুদিন ধরে শুনে আসছি। সামরিক বাহিনী নয়। রাজনীতির বিকল্প রাজনীতি। রাজনীতিতে যদি তৃতীয় শক্তি আসতে হয় তাহলে সেটা রাজনীতির শক্তিতে আসতে হবে। এটা করতে পারত বামরা। কিন্তু বাম দলগুলোর মধ্যে আদর্শিক ভ্রান্তি, যার ফলে তারা সামনে আসতে পারছে না। আওয়ামী লীগ বলি, বিএনপি বলি, জাতীয় পার্টি বলি সবই তো পুঁজিবাদী দল। বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মূলনীতির একটি মূলনীতি হলো ‘সমাজতন্ত্র”। কিন্তু বাংলাদেশে একটা জিনিস চলমান তা হলো নগ্ন পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদীরাই দেশটাকে চালাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, বামদের সামনে আসা উচিত। ক্রান্তি কাটিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে যাতে তারা রাজনৈতিক বিকল্প শক্তি হিসেবে যোগ দিতে পারে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে শিক্ষা নিয়ে কী বুঝতে পারলেন। আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থাটা কী? আর শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যটা কী?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: আমার শিক্ষকতা জীবনে বেশ কিছু উপলব্ধি হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে গুণগত মানের ওপর নির্ভর করবে শিক্ষার্থীর গুণমান। যদি শিক্ষকের গুণগত মান না থাকে তাহলে শিক্ষার্থীর গুণমান হবে না। শিক্ষা ক্রমাগতভাবে ধ্বসে গেছে আমার মনে হয়। এই উপলব্ধি আমার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে-এ কথা ঠিক কিন্তু আমাদের মানুষের মনের উন্নতি হচ্ছে না কেন? দ্বন্দ্ব-সংঘাত সব সময় লেগে আছে। এর জন্য আপনি কাকে দায়ী করবেন পরিবার, সমাজ নাকি রাজনীতিকে?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: আমি তো শুরুতেই বলেছি, বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়নি, প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বৈষম্য রেখে কখনো উন্নয়ন হয় না। এটা সম্পূর্ণ এক শ্রেণির মানুষের উন্নয়নের জন্য, প্রথমত পরিবার তার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একজন শিক্ষক আচরণ-বচন-বিচারণে গুণগত মানে অনুসরণীয় হবেন। তেমন শিক্ষক কজন আছেন এখন বাংলাদেশে। শিক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের জীবনে শিক্ষকের প্রভাব অনেক। বাংলাদেশে প্রকৃত মানুষ তৈরি হচ্ছে না। তার প্রমাণ প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে সংবাদ দেখলেই বোঝা যায়। এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শৈথিল্য আছে। আরেকটা হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতিতে কখনই আদর্শ কিছু পাচ্ছি না। আদর্শ যদি থাকত তাহলে এ দেশের মানুষ এমন হতে পারত না। একটা আদর্শিক নেতৃত্ব দরকার আছে বলে মনে করি।
ভিউজ বাংলাদেশ: মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছরেও কি আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: আমার সোজাসাপ্টা উত্তর, এর কারণ হচ্ছে আমার সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আছে। তার পর অন্যান্য ধর্ম পালন করা যাবে। এটি অত্যন্ত আপত্তিকর একটি বিষয়। সব ধর্মের, সব মানুষের সব ধরনের অধিকার আছে। স্বাধীনতা আছে। আমরা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে পারিনি। বঙ্গবন্ধু নিজে বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িক তারা হীন, নীচু’। বঙ্গবন্ধু নিজে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। এখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আমলে গোবিন্দগঞ্জ, নাসিরনগর ও রামুর মতো ঘটনা কেন ঘটে? সেজন্য সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার যে স্বপ্ন সেটা সোনার পাথর বাটির মতোই মনে হচ্ছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, পত্রিকার সম্পাদকসহ প্রশাসনের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এর পরও কি এই দীর্ঘ জীবনটায় কোনো অপূর্ণতা বা হতাশা কাজ করে?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: অতৃপ্তি অবশ্যই মানুষের থাকে। অতৃপ্তি না থাকলে কোনো সৃষ্টি হয় না। আমার নিজেরও অনেক অতৃপ্তি ও অপূর্ণতা আছে। চেষ্টা করছি কাটিয়ে ওঠার। এ জীবনে পারব কি-না জানি না। যাবতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। প্রশাসক হিসেবেও একেবারে মন্দ কাজ করিনি। সব মিলিয়ে শিক্ষক ও প্রশাসক হিসেবে আমার নিজের জীবনটাকে আমি দেশ এবং মানুষের জন্য কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এটাই আমার বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল আর কী। এখনো সেই আকাঙ্ক্ষা আছে। যেমন আমি ১/১১-এর সরকারের কল্যাণে কানে ভালো শুনি না, যন্ত্র দিয়ে শুনি। আঙুল নষ্ট করে দিয়েছে। সেজন্য দুই আঙুলে লিখি। আমার সেক্রেটারি সেটা কম্পিউটারে কম্পোজ করে। তবুও আমি লিখছি। আমার দাঁত নেই। দাঁত ফেলে দিয়েছিল ঘুষি মেরে। ক্যাপ লাগিয়ে কথা বলছি। সেজন্য আমি এগিয়ে যাব সামনের দিকে। আমার অদম্য কর্মস্পৃহা টিকিয়ে রেখেছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: দীর্ঘ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: তোমাকেও ধন্যবাদ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে