Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

উদ্যোগ, উদ্যোক্তা এবং অন্যান্য

Waresa Khanam Prity

ওয়ারেছা খানম প্রীতি

সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩


আইডিয়া, ইনোভেশন এবং ইমপ্লিমেন্টেশন; শব্দ তিনটা বর্তমানের হটকেক। মূলত উদ্যোক্তাদের কার্যক্রম আবর্তিত হচ্ছে এই তিনটা শব্দের মধ্যে।

স্টার্টআপ ইতিহাস খুব বেশিদিনের না। বিগত পনেরো বছরে স্টার্টআপ সংস্কৃতি গ্রো করেছে তবে সেসবের বেশিরভাগই বাজারে টিকে থাকতে পারেনি। স্টার্টআপ জগতে এক বিলিয়ন ডলার ভ্যালুয়েশন একটা মাইলফলক যেটাকে স্টার্টআপের ভাষায় ইউনিকর্ন বলা হয়। বিকাশ হলো স্টার্টআপ জগতের প্রথম ইউনিকর্ন। এছাড়া চালডাল, শপআপ, নগদ, পাঠাও, টেন মিনিট স্কুল, কিংবা সেবার মতো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানই বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপে পরিণত হয়েছে। প্রমিজিং বহুবিধ সেক্টর নিয়ে কাজ করছে উদ্যোক্তারা। উদ্যোগের মধ্যে ই-কমার্স অনেক দ্রুত ও আস্থার সাথে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পেরেছে যেমন; রকমারি, আজকের ডিল, সিন্দবাদ, চালডাল, খাসফুড, প্রিয়শপ, সাজগোজসহ আরো অনেক আছে। লজিস্টিক্স ও পরিবহন সেক্টরে এগিয়ে আছে ই-কুরিয়ার, রেড এক্স, পেপার ফ্লাই, ট্রাক লাগবে, ফেব্রিক লাগবে।

সার্ভিস অরিয়েন্টেড মার্কেটপ্লেস হিসেবে হ্যালো টাস্ক, হ্যান্ডি মামা, সেবা পছন্দের শীর্ষে চলে এসেছে।টেক স্টারআপে উঠে এসেছে জুমশেপার, সফটওয়্যার ব্রেইনস্টেশন ২৩, ওপেনরিফ্যাক্টরি, মার্কোপোলো এআই সহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান ইউনিকর্ন হওয়ার পথে আছে। হেলথ টেক স্টার্টআপ যেমন;  প্রভা, মনের বন্ধু, ডকটোরোলা, ডক্টরকই,পালস, ডকটাইম এর মতো উদ্যোগ জীবনযাপনকে সহজ করে তুলেছে। এরকম আরো অনেক উদ্যোগ এখন স্পটলাইটের নিচে।

ইনোভেশনের এই ধারাকে উৎসাহিত করতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যে গ্র্যান্ট দেয়া হয় সেটা স্টার্টআপ ধারণাকে প্রবলভাবে গতি দিয়েছে। আর একারণেই আমাদের পেশাগত সংস্কৃতির মধ্যে একটা বিরাট বিবর্তন এসেছে। টাকা না থাকলে ব্যবসা করা যায়না এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এখন একজন কলেজ ছাত্রও চেষ্টা করে চাকুরি না করে কিভাবে নিজের আইডিয়াকে ব্যবসাতে রূপান্তর করা যায় এবং তারা সেভাবেই নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করছে। আশার কথা হলো সবার জন্য তেমন একটা স্টার্টআপ পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলেই তারা সাহস করতে পারছে একেবারে আনসার্টেন একটা আইডিয়া নিয়ে সামনে আগাতে এবং ক্যারিয়ার তৈরি করতে।

স্টার্টআপের পাশাপাশি করোনাকালীন ও তার পরবর্তী সময়ে অনলাইনে ট্রেডিং ব্যবসা জনপ্রিয় হয়েছে। দোকানে গিয়ে দরদাম করে কিনতে পছন্দ করা টিপিক্যাল বাঙালি ক্রেতাদের কাছেও অনলাইন অর্ডারের বিষয়টা অনেকখানি আদৃত হয়েছে। সুতরাং দ্রুততার সাথে বেড়ে উঠেছে ট্রেডিং সেক্টর। দেশব্যাপী হাজার হাজার নারী যুক্ত হয়েছে ট্রেডিং ব্যবসার সাথে।

তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে আরও একটা ব্যবসা খাত সেটা হলো এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা এডুটেক। স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটির প্রতিটা টেক্সট বুকের বিপরীতে প্রয়োজনীয় গাইডলাইন থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে আসা উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসায় প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়সহ যাপিত জীবনের সম্ভাব্য সবরকমের শিক্ষণ সমাধান এডুটেকের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। আর সেই সুযোগে হু হু করে এই সেক্টরে উদ্যোক্তা বাড়ছে। ভোক্তা ও সেবাগ্রহীতাদের প্রয়োজন অনুযায়ী উদ্যোক্তারা সার্ভিস সেক্টরকে ডেভেলপ করে চলেছে।

পাশাপাশি পাবলিক ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোও তাদের বিষয়ভিত্তিক পড়ালেখার বিষয়গুলোকে স্টার্টআপ ইন্ডাস্ট্রির জন্য ঢেলে সাজাচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন ডিপার্ট্মেন্ট। ঢাকা ইউনিভার্সিটির তেমনই একটা ডিপার্ট্মেন্ট হলো অরগানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি এন্ড লিডারশিপ। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে লিডারশিপজনিত দক্ষতা উন্নয়নের যে কোন বিকল্প নেই সেই উপলব্ধিটা আমাদের ভবিষ্যতের টেকসই স্টার্টআপের খাতিরেই ডেভেলপ করেছে। 

দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। প্রচুর সংখ্যক নারী কাজ করছে টেকনোলজি নিয়ে। আইটি, হেলথ টেক, এগ্রো টেক, ফিন টেক, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কোথায় নেই তারা! পুরুষের তুলনায় সুযোগসুবিধা ও মূল্যায়ন বিষয়ে নানাবিধ তর্কবিতর্ক থাকলেও নারীরা সমান্তরালে কাজ করছে। এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে একেবারে প্রান্তিক নারীরাও নিজের দক্ষতার জায়গা থেকে এখন ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছে। পরিসংখ্যান বলছে বর্তমানে দুই লাখের বেশি নারী এফ কমার্স বিজনেস করছে। তবে আমাদের দেশে অনেক বড় একটা ঘাটতির জায়গা হলো সঠিক তথ্য উপাত্তের অভাব। প্রতিবছর পরিসংখ্যান ফলোআপ করা হয়না বলে আমাদের কাছে উদ্যোক্তাদের সঠিক সংখ্যাটা নেই। নারীরা উপার্জনমুখী হয়েছে এটা সার্বিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য শুভ যোগ।

তবে যেকোন পেশার জন্য প্রয়োজন হয় সেই বিষয়ের ওপরে সামগ্রীক জ্ঞান। নারীর চ্যালেঞ্জের জায়গাটা আসলে এখানেই। যেহেতু হাতের কাছে ইন্টারনেট। হয়ত পরিবারের কাউকে দিয়ে পেইজ খুলে নিয়েছেন। অমুকে বাড়ির লাউ এর ছবি  পেইজে দিয়ে বেচে, তমুকে জামা সেলাই করে পেইজে দিয়ে বেচে সুতরাং তিনিও পারবেন বলে খুশিতে দুই চারদিনের জন্য ব্যবসা করতে আসেন- এমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নারীর সংখ্যাই বেশি। এসে যে কয়দিন টিকে থাকেন তাতে নিজের অজ্ঞতার কারণে শুধু মার্কেটই নষ্ট করেন।

প্রান্তিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই ব্যবসায় পরিকল্পনা বিষয়ক জ্ঞান রাখেন না, পণ্যের প্রাইসিং করার নিয়ম জানেন না, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর ব্যাপারে কোন ধারণা রাখেন না। বাজার থেকে কোন পণ্য কিনে এনে মূল দামের চেয়ে ১০০ টাকা বেশিতে বিক্রি করলেই ভাবেন যাক অনেক লাভ করেছেন।  কোন বিজনেস মডেল নেই। প্রতিদিনকার বুক কিপিং নেই। ক্যাশ ফ্লো, ব্যালান্স শিট, বিজনেস ফোরকাস্ট এসবের কোনকিছু সম্মন্ধেই তাদের ধারণা নেই। আর ধারণা না থাকার কারণে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা কিংবা ঋণ প্রাপ্তি থেকে তারা প্রতিবছর বঞ্চিত হন।

এ কারণে ব্যবসায় আগ্রহী প্রান্তিক এই নারীদের জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় নানাবিধ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও গ্র্যান্ট প্রদান করে তাদেরকে সাসটেইনেবল বিজনেস করতে প্রস্তুত করে তুলছেন।  কারণ সারা দেশব্যাপী যে বিশাল ই-কমার্স বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেখানে সিংহভাগ অবদান রাখবে ক্ষুদ্র ও তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তারা। বাজারটা ক্রমবর্ধমান তাই এই খাত থেকে সরকারের বড় রকমের একটা রাজস্ব আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমাদের বর্তমান ই-কমার্স মার্কেটের সাইজটাও অভিভূত হওয়ার মতো। ২০২২ সালের শেষে ই-কমার্স মার্কেট সাইজ ছিল ৬৬০ কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞদের ধারণা আগামী চারবছর পর ২০২৬ সালে বাজার আকৃতি বেড়ে হয়ে যেতে পারে ১ হাজার ৫০ কোটি ডলার। টাকার অংকে হিসাব করলে এই সংখ্যাটা ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি হবে। 

এইযে কোটি কোটি ডলারের নিখুঁত হিসাব নিকাশ করছি তার পেছনে রাষ্ট্র কিংবা কর্পোরেট বডির সাপোর্টটা কেমন? একটু জেনে নেই। সরকারের আইসিটি ডিভিশনের প্রজেক্ট ইনোভেশন ডিজাইন এন্ড অন্ট্রাপ্রেনরশিপ একাডেমি (IDEA) উদ্যোক্তাদের জন্য প্রি-সিড ফান্ড প্রদান করে থাকে। ব্যবসাকে দাঁড় করানোর জন্য প্রত্যেক উদ্যোক্তার জন্য এখানে ১০ লাখ টাকা করে বরাদ্দ। এছাড়া বিশাল আকারে বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্ট কন্টেস্ট পরিচালনা করে আইসিটি ডিভিশন। যেখানে একজন বিজয়ী মোট এক কোটি টাকা গ্র্যান্ট পেয়ে থাকে। সরকারি মালিকানাধীন প্রথম ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’ আইসিটি ডিভিশনের একটি প্রজেক্ট। এখানে পিচিং এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা পর্যন্ত ইনভেস্টমেন্ট পেয়ে থাকে। ইনভেস্টমেন্টের বিপরীতে ইকুইটি শেয়ার করতে হয়।

উদ্যোক্তাদের জন্য আছে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে এক্সেলেটর প্রোগ্রাম। নতুন আইডিয়াকে তারা কীভাবে ব্যবসায় রূপান্তর করবেন সেসব বিষয়ে সেখানে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যাকে বলে একেবারে ইনটেনসিভ কেয়ার প্রশিক্ষণ। দুই থেকে তিন মাসব্যাপী এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম উদ্যোক্তাদের জন্য বড় রকমের একটা সুযোগ। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি যেটা হয় তা হলো নেটওয়ার্কিং। এক্সেলেটর প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের ফলে ক্রমাগত তথ্যভান্ডার যেমন সমৃদ্ধ হয় সেইসাথে পরবর্তী ধাপ ফেলাটা সহজ হয়য়ে যায়। টেলকো কোম্পানির মধ্যে গ্রামীণফোন, বাংলালিঙ্ক ও রবি এক্সেলেটর প্রোগ্রাম করে থাকে। প্রশিক্ষণ শেষে বিনিয়োগকারীদের সামনে পিচিং করে সিড ক্যাপিটাল পাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয় উদ্যোক্তাদের জন্য। 

আসলে যেকোন উদ্যোগ গ্রহণের আগে নিজেকে দক্ষ করে প্রস্তুত করার কোন বিকল্প নেই। দক্ষ হলেই কেবল জানবেন আপনাকে সুযোগ দেয়ার জন্য অনেক অনেক প্রতিষ্ঠান অপেক্ষা করছে। 

--

ওয়ারেছা খানম প্রীতি

প্রেসিডেন্ট, হার ই-ট্রেড




মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ