সোজা কথায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের কর্মপদ্ধতি
যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুপার পাওয়ার এতে কারও কোনো সন্দেহ নেই। তাকে ম্যাকডোনাল্ড আইল্যান্ড, চুখোতকা অখরুক থেকে শুরু করে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা পর্যন্ত নজর রাখতে হয়। ওই যে দুটি অতি ক্ষুদ্র দূরদ্বীপের নাম বললাম, আমরা সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, হয়তো আমাদের ফরেইন অফিসও জানে না; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জানতে হয়। ওইসব স্থানের অর্থনীতি, কৌশলগত অবস্থান, বেনিফিট সম্পর্কে নিয়মিত পলিসি অবলম্বন করতে হয়।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, সিআইএসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, বিভিন্ন নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখে। সে অনুসারে রিপোর্ট তৈরি হয়, সেই রিপোর্ট সংক্ষিপ্ত হতে হতে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত চলে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টকে ব্রিফ করা হয় মাত্র। এসব কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই নিজের বিশ্বস্ত লোক নিয়োগ দিয়ে থাকেন এবং তারা যা ব্রিফ করেন, সেটা তিনি আমলে নেন এবং সেই অনুসারে তিনি তার পররাষ্ট্রনীতি এগিয়ে নেন। তিনি মুখে যা বলেন, সেটা টিপ অফ দি আইসবার্গ মাত্র। আর তার সেই মুখের দুটি বাক্য অথবা হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র বা সেক্রেটারি অব স্টেটের ছোট্ট বিবৃতি থেকেই সারা বিশ্বের মানুষ বুঝে নেয়, প্রেসিডেন্টের পলিসি কোন দিকে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সাধারণত সমমনা, বিশ্বস্ত এবং তার গুডবুকে থাকা মানুষদেরই নিয়োগ দিয়ে থাকেন এবং নিয়োজত ব্যক্তির নিজস্ব মতামত অনেকটাই প্রতিফলিত যুক্তরাষ্ট্রের পলিসিতে। সেটা শুধু বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রেই নয়, সব প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রেই। যেহেতু এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্য অত্যন্ত জটিল ও কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ রয়েছে তাই এই অঞ্চলের বিষয়েই বলা যেতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক স্পেশাল এনভয় হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন স্টিফেন ভিচকফকে। ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য ট্রাম্প সৌদি আরবে যে আলোচনা বা বৈঠকের মনস্থ করছেন, সেখানে প্রতিনিধিত্ব করেছেন সেক্রেটারি অফ স্টেট মার্কো রুবিও, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালজ এবং মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি স্টিভ ভিচকফ। এই আলোচনা ১৮ ফেব্রুয়ারি শুরু, এ নিয়ে এখন ঝড় চলছে। ইউরোপ এমনকি খোদ ইউক্রেন অংশগ্রহণ করবে, নাকি করতে পারবে তা নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। বিশেষ করে ইউরোপ ও ইউক্রেন যে বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর অসন্তুষ্ট তা ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড ও ইউক্রেনের বিবৃতি থেকে বোঝা যাচ্ছে। ইউকে তো ইতোমধ্যে ঘোষণাই দিয়েছে যে, তারা ইউক্রেনে সেনা পাঠাতে প্রস্তুত।
যাই হোক এখন এই আলোচনায় প্রতিফলিত হবে মার্কো রুমিও, ওয়াল্জ এবং ভিচক্রফ কীভাবে বিষয়টি দেখতে চান তার ওপর। রাশিয়াকে তারা কতটা ছাড় দিতে চান, ইউরোপকে কতটা ইনভলভ করতে চান তার ওপর এবং প্রেসিডেন্ট পরবর্তী সিদ্ধান্ত সেই অনুসারেই গ্রহণ করবেন।
কে এই ভিচক্রফ, কী তার মানসিক গঠন সেটা বুঝতে পারলেই তার ভূমিকাও খানিকটা বোঝা যেতে পারে। ইহুদি বংশোদ্ভূত ভিচক্রফ ৮০র দশকে আইনশাস্ত্রে পাস করে তিনি রিয়েল স্টেট কোম্পানি ড্রেয়ার অ্যান্ড ট্রাউব-এর ল’ ফার্মে চাকরি নেন। সেখানেই তার ক্লায়েন্ট হিসেবে পরিচয় হয় ডোনাল্ড জে. ট্রাম্পের সঙ্গে। ট্রাম্পকে দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হন রিয়েল স্টেট ব্যবসায় এবং ম্যানহাটনে শুরু করেন এই ব্যবসা। দেখতে দেখতে তার ব্যবসা ফিলাডেলফিয়া, ডালাস, শিকাগো থেকে শুরু করে লন্ডন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এক সময় তিনি রিয়েল স্টেট ব্যবসায় ভাড়ার টাকা সংগ্রহ করতে যেতেন অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে। তিনি আব্রাহাম অকোর্ডের ঘোর সমর্থকই শুধু নন, ২০২০ সালে নেয়া এই চুক্তি সম্প্রসারণের পক্ষপাতি। একই সঙ্গে তিনি রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল, অনেকটা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতোই।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেট মার্কো রুবিও কিউবার বংশোদ্ভূত। তার পিতা-মাতা কিউবা ছেড়েছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সময়ে নয়, বরং ফুলগেনসিও বাতিস্তার সময়, যিনি ২০ হাজারের বেশি বিপ্লবীকে হত্যা করেছিলেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কিউবার সঙ্গে রাশিয়ার সখ্য সর্বজনবিদিত। ফলে রুবিও যে তীব্র রাশিয়াবিরোধী নয়, সেটা পরিষ্কার।
এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একটি বৈঠক হবে সামনে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। আর সেই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিয়োজিত এসব কর্মকর্তার মতামত প্রতিফলিত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে যেভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে, সেখান থেকে ট্রাম্প প্রশাসন পরিষ্কার বেরিয়ে আসতে চাইছে। এমনকি এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের চরম মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। ইউক্রেন প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউরোপ তো বটেই, খোদ ইউক্রেনকেই আলোচনায় রাখছেন না। ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউরোপীয় নেতারা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে জরুরি বৈঠকে বসেছিলেন; কিন্তু প্রশ্ন হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প টিম কি তাদের অবস্থান থেকে সরে আসবেন? কারণ ট্রাম্পের টিমে ইউক্রেনের প্রতি চরম সহানুভূতিশীল কেউ নেই। প্রায় সবাই ট্রাম্পের ইউক্রেন নীতির সমর্থক।
যে কথা শুরুতে বলছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের কেবিনেটের বাইরে পররাষ্ট্র বিষয়ে আরও যে দুটি পদ থেকে প্রেসিডেন্টকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হয় তার একটি হলো ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স পরিচালক এবং এফবিআই পরিচালক। এ দুটি পদে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন যথাক্রমে তুলসি গ্যাবার্ড এবং কশ্যপ প্রমোদ বিনোদ প্যাটেলকে, যিনি ক্যাম প্যাটেল নামে পরিচিত। ডেমোক্র্যাট দল থেকে বেরিয়ে এসে রিপাবলিকান দলে যোগ দেয়া তুলসি গ্যাবার্ডের রয়েছে চরম বৈরিতা। একসময় ট্রাম্পের প্রতিও তার বিরোধিতার অন্ত ছিল না; কিন্তু একটি জায়গায় দুজনের মিলে গেছে। দুজনই ইসলামিক জঙ্গি দমনে সর্বোচ্চ করতে প্রস্তুত এবং দুজনই হিলারি ক্লিনটনকে সমানভাবে অপছন্দ করেন। ইয়োগা গুরু ক্রিস বাটলারের শিষ্য গ্যাবার্ড মনেপ্রাণে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী এবং হরেকৃষ্ণ ভক্ত, যদিও তার বাবা-মা কেউই ভারতীয় নন। জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসনে গ্যাবার্ডের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে ভারতের গুজরাটের বংশোদ্ভূত আইনজীবী, আইস হকি খেলোয়াড় ক্যাশ প্যাটেলকে এফবিআইর দায়িত্ব দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি বিশ্বাস করেন এবং বারবার উল্লেখ করেছেন যে, এফবিআইর কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। তিনি বিশ্বাস রেখেছেন প্যাটেলের ওপর এবং বারবার তার প্রশংসা করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন, প্যাটেলের অধীনে এফবিআই মহামারিতে পরিণত হওয়া অপরাধের অবসান ঘটবে। মাদক ও মানব পাচারকারীরা এবং অভিবাসিত অপরাধীরা ধ্বংস হবে। এক মাস পার হতে চলল প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেট-আপ পরিবর্তন করেছেন। এখন এসব কর্মকর্তা নতুন করে তাদের পরিকল্পনা সাজাবেন। তারপর নেমে পরবেন যার যার ফিল্ডে। এখনো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেবল বিবৃতি ও সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো জানানো হচ্ছে। হয়তো বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরিবর্তনগুলো দেখতে কয়েক বছর পার হয়ে যাবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা কখনো রাতারাতি হয় না। প্রেসিডেন্ট একা সে সিদ্ধান্ত নেন না। তার বিশ্বাস স্থাপন করা লোকদের ওপর ছেড়ে দেন।
মহসীন হাবিব: লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে