আইনের মধ্যে থেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সম্ভব
ছাত্র ও জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করায় তার মন্ত্রিসভার সব সদস্য পদত্যাগ করেছেন বলে ধরে নিতে হয়। এরপর গত মঙ্গলবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তাই এখন দেশে কোনো সরকার নেই। দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হতে যাচ্ছে। শুনেছি সেই সরকারের প্রধান হিসেবে এরই মধ্যে মনোনীত করা হয়েছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। তার নেতৃত্বে গঠিত হতে যাচ্ছে নতুন এই সরকার।
দেশের নতুন এই অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়টির অধিকতর বৈধতা দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টে একটি রেফারেন্স পাঠাতে পারেন। রেফারেন্সে রাষ্ট্রপতি লিখবেন, দেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ এবং দেশত্যাগ করেছেন এবং সংসদের অন্যান্য সদস্যকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারবিহীন থাকতে পারে না। সেহেতু জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী এবং দেশের সব রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী এবং গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদাণকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভিপ্রায় অনুযায়ী জনস্বার্থ এবং জনশৃঙ্খলার স্বার্থে একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের আদেশ, নির্দেশ, রায় ও নির্দেশনা সংবিধানের অংশ। সেহেতু দেশের সার্বভৌমত্ব এবং জনস্বার্থে এই কার্যক্রমের অনুমোদনের প্রয়োজন। নতুবা দেশ এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পতিত হবে। সুতরাং দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই রেফারেন্স অনুমোদন করা একান্ত আবশ্যক। সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন পাওয়া গেলে সংবিধানের এ-সংক্রান্ত সব জটিলতার অবসান ঘটবে এবং জাতীয় সরকার গঠনে এবং তার কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো সাংবিধানিক সংকট বা বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপিত হবে না।
এই বৈধতা নতুন সরকার গঠনের আগে এবং পরে করা যেতে পারে। অন্য যে পথটি রয়েছে, তা হলো জনস্বার্থ এবং জনশৃঙ্খলার স্বার্থে ক্রান্তিকালীন বিধান অনুযায়ী একটি জাতীয় সরকার গঠন করা। সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর পূর্বে সংবিধানে ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা ছিল। এই ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯০ সালে প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল।
পরে সংবিধানের ১১তম সংশোধনীর মাধ্যমে অস্থায়ী সরকারের সব কার্যক্রমের বৈধতা এবং প্রধান বিচারপতি পদে ফেরার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং অতীতের রেফারেন্স অনুযায়ী এখন একটি জাতীয় সরকার গঠন এবং পরবর্তী সময় ওই সরকারের সব কার্যক্রমের বৈধতা দেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতামূলক একটি জাতীয় ঘোষণা স্বাক্ষরিত হওয়া প্রয়োজন।
এই ঘোষণায় সব রাজনৈতিক দল এই মর্মে একমত হবে যে, জাতীয় সরকার এবং এর সব কার্যক্রমের বৈধতা পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে অনুমোদন করা হবে। এই কাজকে আরও মজবুত এবং সাংবিধানিক ভিত্তি দিতে হলে সুপ্রিম কোর্টে একটি রেফারেন্স পাঠিয়ে অথবা রিভিউ পিটিশনের মাধ্যমে ১৪তম সংশোধনীর আগে যে ক্রান্তিকালীন বিধানাবলি ছিল, তা পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে। জাতীয় সরকার যতদিন খুশি ততদিন ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারে শুধু পরবর্তী সময় সংসদ তার সব কার্যক্রমের বৈধতা দেবে।
আর একটি জরুরি কথা আমি বলব, এখন যে অবস্থা এটা একটা গণঅভ্যুত্থান বা রেভলিউশনারি সিচুয়েশন। গণঅভ্যুত্থান কোনো আইন না। সংবিধানের কোথাও গণঅভ্যুত্থান নেই। তবে গণঅভ্যুত্থানে যারা জয়লাভ করে, তাদের ইচ্ছা মতোই সবকিছু হবে। যে ইচ্ছা তারা করবে, সেটা আইনে যাওয়ার সুযোগ আছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যেটা হবে পরবর্তীতে তা আইনের মাধ্যমে বৈধতা দেয়া যেতে পারে।
ড. শাহদীন মালিক: সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে